১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

‘কসাই’ গরু বনাম ঈদের গরু : কুরবানির হাটে দাম যেভাবে বেড়ে যায়

কুরবানিতে দেশী গরুর চাহিদা বেশি থাকে - ছবি - বিবিসি

কুরবানির ঈদের আগে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এবছরও চাহিদার তুলনায় বাজারে পশুর সরবরাহ বেশি থাকবে।

মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, এ বছর কুরবানির বাজারে চাহিদার তুলনায় প্রায় ২৩ লাখ পশু বেশি সরবরাহ হবে।

চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকার এমন তথ্য অবশ্য প্রতিবছরই দেয়া হয়। কিন্তু বাজারে যদি সরবরাহ বেশিই থাকে, তাহলে বিশেষত গরুর দাম কেন প্রতিবছরই চড়া সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

এছাড়া গরুর দাম একেকজন একেকভাবে নির্ধারণ করেন। কেউ ওজনে আর কেউবা উৎপাদন খরচে। কিন্তু গরুর বাজারে এমন ভিন্ন ভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি আর চড়া দাম কেন দেখা যায়?

গ্রামেও কেন গরুর দাম বাড়তি?
কুরবানিতে বিক্রির জন্য বাসায় গরু পালন করেন মানিকগঞ্জের সিংগাইরের কৃষক আবু বকর। এ বছর দু’টি গরু কিনে বাসায় লালন-পালন করে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছেন তিনি। একটি কিনেছেন ছয় মাস আগে, আরেকটি একবছর। একটি গরুতে চার মণ গোস্ত হবে এমন আন্দাজেই গরুর বেপারিদের কাছে দাম চেয়েছেন তিনি।

আবু বকর বলছিলেন, দু’টি গরু মিলিয়ে দাম ধরেছেন দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা। অর্থাৎ একটি গরুর দাম এক লাখ ৪০ হাজার টাকা।

তিনি বলেন, ‘বেপারিরা আসছে, দাম বলছে। আমিও আমারটা বলেছি। কিন্তু তারা গরু প্রতি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দাম কম বলছে। তাই এখনো বিক্রি করতে পারি নাই।’

আবু বকর বলছেন, পশু খাদ্যে খরচ বাড়ায় গরুর দামও এবার ১০/১৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে হয়েছে।

কিন্তু গ্রামেও বাড়িতে গরু পালনে খরচ কেন এতো বাড়লো এমন প্রশ্নে আবু বকরের উত্তর, গ্রামেও এখন আর বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না।

‘আগে আমরা বাইরে থেকে ঘাস কেটে এনে গরুকে খাওয়াতাম। তখন পতিত জমি ছিল। এখন সব জমিতেই চাষ হয়। ঘাসের জমি নেই। বরং জমি বর্গা নিয়ে ঘাস চাষ করতে হয়। এতে জমির খরচ, চাষের খরচ, সারের দাম, পানির দাম অনেক কিছুই যুক্ত হয়। এভাবে গরু খাদ্যের প্রায় প্রতিটাই এখন কিনতে হয়। যেহেতু খাদ্যের দাম বেশি, সেহেতু গরু প্রতি ১৫ হাজার টাকা দাম না পেলে খরচ উঠে না।’

‘কসাই গরু’ বনাম ‘ঈদের গরু’
মানিকগঞ্জের আবু বকর যে গরুর দাম এক লাখ ৪০ থেকে দেড় লাখ টাকা হাঁকছেন, সেই একই আকারের গরু স্বাভাবিক সময়ে মানিকগঞ্জেই এর চেয়ে কম দামে বিক্রি হয়।

এসব গরুর একটা বড় অংশেরই ক্রেতা গোস্ত ব্যবসায়ীরা।

মানিকগঞ্জের সিংগাইর বাসস্ট্যান্ড এলাকার গোস্ত বিক্রেতা মোহাম্মদ আলী জানাচ্ছেন, তারা যেসব গরু গোস্ত বিক্রির জন্য কেনে, সেগুলোও মূলত গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ মানুষ কিংবা হাট-বাজার থেকেই কেনা হয়।

তবে তখন গরুর গোস্তের দাম কম থাকে।

চার মণ গোস্ত হবে এমন গরু তারা এক লাখ বিশ থেকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকার মধ্যেই কিনতে পারেন। অথচ কুরবানির জন্য একই ওজনের গরুর দাম আবু বকর চেয়েছেন এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১৫ হাজার টাকা বেশি।

কিন্তু একই এলাকায় কুরবানির সময়ে গরুর দাম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা কেন বেড়ে যাচ্ছে?

এর উত্তরে আসছে ‘কসাই গরু’ তত্ত্ব আর বাজারে চাহিদা কম থাকার কথা।

বিষয়টা খোলাসা করলেন গোস্ত বিক্রেতা মোহাম্মদ আলী।

‘দেখেন আমরা একই জায়গা থেকেই গরু কিনি। কিন্তু আমরা যেটা কিনি সেটা হলো কসাই গরু। অর্থাৎ আমরা গরুর রঙ, সৌন্দর্য ইত্যাদি দেখব না। আমরা দেখবো গোস্ত কেমন হবে সেটা। কিন্তু কোরবানির সময় সুন্দর, দেখতে ভালো, স্বাস্থ্য ভালো এমন গরু বাজারে উঠে বেশি। এসব গরু তারা কম দামে ছাড়বে না।’

‘দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে, ঈদে গরুর চাহিদা বেশি থাকে। ক্রেতা বেশি থাকে। সুতরাং দাম এমনিতেই বেড়ে যায়। আর কৃষক, খামারি সবাই ঈদের জন্য আলাদাবাবে গরু পালে, তারা ঈদের বাজার ধরার জন্যই অপেক্ষা করে। ফলে দাম বাড়ে। এটাকে আপনি স্বাভাবিক সময়ের সাথে তুলনা করতে পারবেন না।’

কৃষক থেকে খামার; আরেক দফায় দাম বৃদ্ধি
একটা সময় গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ কৃষকদের প্রায় সকলেই গরু পালতেন। তখন খুব সহজেই অল্প খরচে গরু পালন করা যেতো।

তবে একপর্যায়ে গরুর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। নিত্যনতুন খামার গড়ে উঠতে শুরু করে।

এটা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় ২০১৪ সালের পর। তখন ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।

এর আগে কুরবানির ঈদে গরুর চাহিদা মিটতো মূলত তিনভাবে।

এক. গ্রামে-গঞ্জে প্রান্তিক কৃষকদের বাড়িতে পালা গরু। যেগুলো কম খরচে পালন করা যেতো।

দুই. ছোট ছোট গরুর খামারে পালন করা গরু।

তিন. ঈদের আগে আগে ভারত থেকে ব্যাপকভাবে গরুর আমদানি। সারাবছর ধরেই ভারতীয় গরু এলেও ঈদের সময় সেটি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেতো এবং কুরবানির চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখতো।

তবে এক দশক আগে যখন ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ হয় যায়, তখন গোস্ত এবং গরুর চাহিদা মেটাতে শহরে-গ্রামে সবখানেই খামার গড়ে উঠতে শুরু করে।

এসব খামারে কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণের বাণিজ্যিক মডেল বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

খামারে গরু পালন করা ব্যয়বহুল। যেহেতু খামারে বিনিয়োগ দরকার হয়, প্রতিটি খাদ্য কিনে খাওয়াতে হয়, ফলে গরু পালনে ব্যয়ও বেড়ে যায়। ফলে খামারগুলোর একটা বড় অংশই উৎপাদন খরচের সাথে লাভ হিসেব করে দাম নির্ধারণ করে।

নারায়ণগঞ্জের সিয়ান এগ্রোর ম্যানেজার আমিন খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রতিবছরই পশুখাদ্যের দাম বাড়ছে। সেইসাথে বিদ্যুৎ, পানিসহ আনুষঙ্গিক খরচও বাড়ছে।

‘আমরা বিভিন্ন খাবার একসাথে মিশিয়ে খামারের জন্য যে খাদ্য তৈরি করি, সেটা একবছর আগেও তৈরি করতে লাগতো ৪৪ টাকা কেজি। তারপর বাড়তে বাড়তে সেটা হয়ে যায় ৫৪ টাকা কেজি। এর সাথে শ্রমিক খরচ, বিদ্যুৎ, পানির খরচ ইত্যাদি তো আছেই। ফলে এবারও গরুর দাম বাড়াতে হবে আমাদের। সেটা না করলে উৎপাদন খরচ উঠবে না।’

এসব খামারে গ্রাম-গঞ্জ থেকে দেশী গরু কিনে মোটাতাজা করা হয়। পরে এগুলো আরো বেশি দামে বিক্রি হয়। আর যেসব গরু উন্নত জাতের, সেগুলোর দাম আরও চড়া থাকে। কাস্টমার বুঝে চলে দাম হাঁকানো এবং বিক্রি।

লাইভ ওয়েট না কি গোস্তের ওজন: গরুর মূল্য কিভাবে নির্ধারণ হবে?
বাংলাদেশে খামারগুলোতে সাধারণত বড় জাতের গরু উচ্চ দামে বিক্রি হয়। গরুর আকার, জাত, গোস্তের পরিমাণ, রঙ, সৌন্দর্য- সবকিছু মিলিয়ে বেশ চড়া দামে বিক্রি হয় এসব গরু।

তবে দাম নির্ধারণ হয় অনেকটা খামারের নিজস্ব হিসেবে। বিদেশী জাত সংগ্রহের সময় এর দাম, লালন-পালন খরচ, গোস্তের হিসেব মিলিয়ে নির্ধারণ হয়। অনেকে একে বলেন চোখের দেখায় দাম নির্ধারণ।

দেশী গরুর ক্ষেত্রেও অনেকটা একইভাবেই দাম ঠিক করা হয়।

এছাড়া গ্রামেগঞ্জেও গরু বিক্রি হয় এভাবেই অর্থাৎ চোখের দেখায়।

তবে কোনো কোনো সময় দেশী গরুর দাম কোনো কোনো খামারে লাইভ ওয়েটেও নির্ধারণ হয় অর্থাৎ গোস্তের ওজন হিসেবে। এমন খামারের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়।

কিন্তু লাইভ ওয়েটে খামারগুলোতে দাম নির্ধারণ কেন হচ্ছে না?

নারায়ণগঞ্জের সিয়ান এগ্রোর ম্যানেজার আমিন খান বলছেন, ছোট জাতের কিছু দেশী গরু এবং ফ্রিজিয়ান গরু ছাড়া অন্য কোনো গরু ওজন হিসেবে বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ এতে লাভ উঠবে না।

‘ধরেন আমাদের একটা গরু যে কি না প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ কেজি খাবার খায়। তাকে যদি আমি লাইভ ওয়েটে বিক্রি করি তাহলে সে আমাকে লস দিয়ে দিবে। কিন্তু ফ্রিজিয়ান ধরনের যেসব গরু আছে, এগুলো খায় কম, গোস্ত দ্রুত বৃদ্ধি পায়, এগুলো লাইভ ওয়েটে বিক্রি করলে দাম উঠবে। কিন্তু যেগুলো বেশি খাবার খায়, সেগুলোকে খাবার খরচের হিসেব করে পিস হিসেবে একটা যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করতে হবে।’

গরুর সরবরাহ বেশি, তাহলে দাম কেন চড়া?
বাংলাদেশে বছরের বিভিন্ন সময় কেজি প্রতি গরুর গোস্তের চড়া দাম নিয়ে এমনিতেই সমালোচনা আছে। কিন্তু শুধু গোস্তের জন্য গরুর যে দাম, কুরবানির সময় তার চেয়েও বেশি দামে গরু বিক্রি হতে দেখা যায়।

যদিও দেশটিতে সরকারি হিসেবেই চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেশটিতে এ বছর গরু, ছাগল, মহিষসহ সব ধরনের কুরবানির পশুর চাহিদা আছে এক কোটি সাত লাখ। এর বিপরীতে সরবরাহ আছে এক কোটি ৩০ লাখ। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি ২৩ লাখ।

এর আগের বছরগুলোতেও চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি দেখা গিয়েছে।

সরকারি হিসেবে ২০২৩ সালে কোরবানির ঈদে অবিক্রীত পশুর সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ।

আর ২০২২ সালে অবিক্রীত পশুর সংখ্যা ২২ লাখ।

কিন্তু সরবরাহ বেশি থাকলেও দাম কেন বাড়তে থাকে? এমন প্রশ্নে প্রান্তিক কৃষক, খামারি সকলেই বলছেন উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কথা। তবে এর সাথে যুক্ত হচ্ছে, ঈদের বাজার।

খামারি থেকে শুরু করে প্রান্তিক কৃষক সবাই আসলে ঈদের বাজারে বেশি দামে বিক্রির জন্য অপেক্ষা করেন।

তবে গরুর দাম কিভাবে নির্ধারণ হবে অর্থাৎ গোস্তের পরিমাণ, লাইভ ওয়েট নাকি চোখের দেখা সেই প্রশ্নে কোনো হস্তক্ষেপ করতে চায় না প্রাণিসম্পদ অধিদফতর।

অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ঈদে গরুর বাজারে দাম অস্বাভাবিক হয়ে গেছে- এমনটা তারা মনে করেন না। ফলে এখানে হস্তক্ষেপ করে বাজারের ভারসাম্য নষ্ট না করার ওপরই জোর দেয়া হচ্ছে।

‘আমরা চাই এখানে দু’পক্ষই জয়ী হোক। প্রান্তিক অসংখ্য মানুষ গরু লালন-পালন করে বছরের এই একটা সময়ের জন্য। এখানে তারা একটা লাভ চায়। এটার ওপরই তারা নির্ভর করে। এখানে অস্বাভাবিক দাম যেন কেউ তৈরি করতে না পারে, কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধি না ঘটে সে বিষয়ে আমরা সচেষ্ট আছি।’

এছাড়া চাহিদার কারণে যে দাম বাড়ে, সেটায় এখনো অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি বলেও মূল্যায়ন তার।

‘কুরবানির বাজারে যত ক্রেতা যায়, অন্য সময়ে তত ক্রেতা থাকে না। এটা একটা লাইভ বিজনেস। একেকজনের উৎপাদন খরচ একেকরকম। এলাকাভেদেও এতে ভিন্নতা হয়। সুতরাং চাইলেই এখানে একটা ন্যায্য দাম ঠিক করা সম্ভব নয়। এটা যতদিন স্বাভাবিক আছে, ততদিন বাজারের উপর ছেড়ে দেয়াই ভালো।’

অধিদফতর বলছে, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকায় গরুর দাম নিয়ন্ত্রণেই থাকবে এবং সেটা অতি মুনাফার প্রবণতা কমিয়ে দেবে।

কিন্তু শেষপর্যন্ত বাজারে গরুর সরবরাহ কতটা থাকে, তার ওপরই নির্ভর করছে গরুর বাজার শেষ পর্যন্ত কেমন থাকবে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement