১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
ডেমু ট্রেনের নামে বিপুল লোপাট

যাত্রীসেবায় কোনো কাজে আসেনি

-


লুটপাটের একটি রহস্যজনক নাম ট্রেনের কালো বিড়াল। শব্দজোড়া দীর্ঘদিন মানুষের মুখে মুখে ছিল। সবাই এটিকে হাস্যরস সৃষ্টির জন্য উদাহরণ হিসেবে পেশ করেছে। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে এর ব্যবহার হয়েছে। এখানে জনগণের অর্থের জবাবদিহিহীন তছরূপ চলতেই থাকছে। এই বিভাগে বিপুল দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধে কোথাও থেকে কার্যকর তাগাদা অনুভব করা হয়নি। এ কারণে বিগত এক দশকের বেশি সময়জুড়ে একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ রেলকে তাদের আখড়া বানিয়ে লোপাট করেছে প্রকাশ্যে। লুটপাটের এ ধরনের একটি প্রকল্প ছিল ডেমু ট্রেন। সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে অনুমান করা যায়, একটি চক্র সুকৌশলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য একে সামনে আনে। এই ট্রেন কার্যত যাত্রী ও মাল পরিবহনে কাজে আসেনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের আওতায় বিশেষ ধরনের ২০ ট্রেন কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ জন্য রেলের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে বিপুল উৎসাহ দেখা যায়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ একনেক প্রথমে এই প্রকল্প অনুমোদন দেয়নি। পরে বিশেষ সুপারিশের মাধ্যমে এটিকে পাস করিয়ে নেয়া হয়। ট্রেনগুলোর মেয়াদ ছিল ৩৫ বছর। দেখা গেল দুই বছরের মাথায় এগুলো অকেজো হওয়া শুরু করে। এখন প্রায় সব ট্রেন পরিত্যক্ত হয়েছে। নতুন করে মেরামত করে এগুলো চালু করা যাবে, সেই সম্ভাবনাও আর দেখা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ ট্রেন খোলা আকাশের নিচে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

এগুলোর ইঞ্জিনসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ মরিচা ধরে এমন অবস্থা হয়েছে এগুলো এখন লোহা লক্কড়ের এক জঞ্জাল। অথচ ডেমু কেনার আগে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আট কর্মকর্তা প্রায় দেড় মাস চীন সফর করেন। তাদের পেছনে প্রকল্পের ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। বাংলাদেশে এনে এগুলোর যাত্রা শুরু হলে যাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। চলন্ত অবস্থায় এগুলোর দরজা বন্ধ রাখতে হয়। আবার এগুলোতে নেই এসি। ছিল না জানালা ও ফ্যান। প্রচণ্ড গরমে এগুলোর ভেতরে থাকা মহাকষ্ট। তার ওপর ছিল না ভেতরে টয়লেটের ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ট্রেন শীতপ্রধান দেশের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে- চীন সফর করা কর্মকর্তারা তাহলে কী করেছেন? পত্রিকা জানাচ্ছে, তারা সবাই ব্যাগভর্তি শপিং করে নিয়ে এসেছেন।

এখন সাতটি ডেমু পড়ে আছে ঢাকা রেলওয়ের লোকোশেডে। এগুলোতে লতাপাতা-গাছপালা গজিয়ে গেছে। মরিচা পড়ে প্রতি ডেমুতে পচন ধরেছে। ১২টি ডেমু চট্টগ্রাম ও লালমনিরহাটে শেডে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। একটিমাত্র ডেমু চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে চলে। তবে এটিও এক দিন চলে চার দিন বন্ধ থাকে। যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই প্রকল্পে ৬৫০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এরপর মেরামত ও ব্যবস্থাপনায় গেছে আরো বেশ কিছু টাকা। যাত্রীকল্যাণ দূরে থাক, এখন পুরো অর্থই জলে গেছে- তা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্তে কিছুটা উঠে এসেছে। ডেমু মেরামতে যন্ত্রপাতি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করতে পারে। এগুলো মেরামতের কারিগরি সক্ষমতা রেলওয়ের নিজের নেই। কমিটি তাদের সুপারিশে বলেছে, ডেমু কিছুতেই মেরামত করা সম্ভব নয়। অথচ ডেমু সংগ্রহের সময় এর যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও মেরামতের কারিগরি সহায়তার নিশ্চিয়তা থাকার কথা ছিল। তদন্তে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

সরকারি কোষাগারের বিপুল অর্থ ব্যয় করে একদল লোক বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে, এটিই বোঝা যায়। ২০১৩ সালে যারা এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন কেউ আর চাকরিতে নেই। এখনকার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সব দায়ভার পূর্ববর্তীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। সরকারি তহবিলের অর্থ যেনতেনভাবে তছরূপ করা বাংলাদেশে একটি সংস্কৃতি হয়ে গেছে। যারা এর সাথে জড়িত সবাই এ দেশের মানুষ। সরকার আন্তরিক হলে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে। অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হবে, তাদের শাস্তি দিতে পারে। এমনটি করলেই কেবল সরকারি কাজে বিপুল দুর্নীতির লাগাম টানা যেতে পারে। আপাতত সেই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।


আরো সংবাদ



premium cement