চলতি পেনশন ও সর্বজনীন পেনশন স্কিমের পার্থক্য কোথায়
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৫ জুন ২০২৪, ১৯:৩১
বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেয়ার পর এনিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে।
বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থার সাথে এর পার্থক্য কতটা এবং তাতে নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধায় কোনো হেরফের হবে কী না তা নিয়েও চলছে নানা বিশ্লেষণ।
চলতি বছরের পহেলা জুলাই থেকে স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থার নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ স্কিমে নিয়ে আসার পাশাপাশি ২০২৫ সালের পহেলা জুলাই থেকে অন্য সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের এ স্কিমে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
এর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং অন্যান্য কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা নতুন পেনশন স্কিমকে বৈষম্যমূলক আখ্যায়িত করে প্রতিবাদ করেছেন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এর বিরুদ্ধে কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মনে করছেন, প্রস্তাবিত স্কিম চালু হলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরগ্রহণকারী ব্যক্তিদের অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা অনেক কমে যাবে।
তবে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘যদি আমরা ১৮ বছরের বেশি বয়সী সব নাগরিককে সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের আওতায় আনতে পারি, তাহলে সবাই একটি সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আসবে, যা ভবিষ্যতে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।’
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুতে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে চারটি স্কিম দিয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিম যাত্রা শুরু করে।
পরবর্তীতে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘প্রত্যয়’ স্কিম চালু করা হয়েছে, যা চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়া নতুন কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর হবে, এমনটি জানিয়ে ইতোমধ্যেই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
তবে পেনশন কর্তৃপক্ষ বলেছে, পুরনো কর্মীরা আগের পদ্ধতিতেই পেনশন পাবেন এবং নতুন স্কিম কার্যকর হবে পহেলা জুলাইয়ের পর থেকে যারা যোগ দিবেন তাদের জন্য। ফলে এনিয়ে পুরনো কর্মীদের আলোচনা-সমালোচনার প্রশ্নটিই গুরুত্বহীন বলে মনে করেন তারা।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় পেনশন নানা ধরনের আছে এবং সামরিক-বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রেই চাকরির ধরনে বিভিন্ন পার্থক্য আছে।
‘সবার জন্য যথাযথ পদ্ধতি চূড়ান্ত ছাড়াও চাকরি শেষে একজন কর্মী ভালো অর্থ পাবেন যা দিয়ে তিনি অবসরজীবনে চলবেন এমন নিরাপত্তা বোধ তৈরি করাটাই নতুন স্কিমের জন্য জরুরি বলে আমি মনে করি।’
পেনশন খাতে সরকারের ব্যয় কত?
সরকারের পেনশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়কাল সরকারি চাকরিতে অধিষ্ঠিত থাকার পর বিধি মোতাবেক অবসর গ্রহণ করলে বা চাকরিরত অবস্থায় কিংবা অবসর গ্রহণের পর মৃত্যুবরণ করলে বা নিখোঁজ হলে সংশ্লিষ্ট চাকরিজীবী কিংবা তার পরিবারকে প্রদেয় বেতনভিত্তিক মাসিক ভাতা হচ্ছে পেনশন। এক্ষেত্রে কর্মী নিজে পেলে সেটি পেনশন আর তার পরিবার পেলে সেটিকে পারিবারিক পেনশন বলা হয়।
অবসরগ্রহণের পর একজন কর্মীকে পেনশনের বাধ্যতামূলক সমর্পণকৃত অংশের জন্য নির্ধারিত হারে এককালীন যে অর্থ দেয়া হয় সেটি আনুতোষিক বলা হয়।
বাংলাদেশে সামরিক বেসামরিক সরকারি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, স্বশাসিত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এযাবতকাল পেনশন সুবিধা পেয়ে আসছিলেন।
এবার অর্থমন্ত্রী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করেছেন সেখানে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ পেনশন খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন।
জনপ্রশাসনের পেনশন ও গ্রাচুইটি খাতে ২৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ১৫ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা।
ধারণা করা হচ্ছে, এখন যেহেতু পেনশনের পুরো টাকা সরকারকেই দিতে হয় তার চাপ কমানো এবং পাশাপাশি সব নাগরিককে পেনশন সুবিধার আওতায় আনার যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি সেটি বাস্তবায়নেই সর্বজনীন স্কিমে সবাইকে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং সে বিবেচনায় হয়তো সরকার সবাইকে পেনশনের আওতায় আনতে চাইছে।
‘তবে উদ্বেগের বিষয় হতে পারে যে এ স্কিমে মানুষের দেয়া টাকা কোথায় বিনিয়োগ হবে সেটা নিয়ে। সরকারি ট্রেজারি বিলে বা বন্ডে বিনিয়োগ হলে অর্থটি বেশি নিরাপদ থাকবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
পার্থক্য কোথায়
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো: গোলাম মোস্তফা বলেন, নতুন যারা যোগ দিবেন তারা এটা জেনেই যোগ দিবেন যে, কোন পদ্ধতিতে এবং কিভাবে তারা অবসরকালীন সুবিধা পাবেন।
পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো: গোলাম মোস্তফা বিবিসি বাংলাকে বলেন, এখন যে পদ্ধতিতে পেনশন নির্ধারিত হয় সেটি হলো ‘ডিফাইন বেনিফিট সিস্টেম’ এবং এটা ‘আন ফান্ডেড’, অর্থাৎ কর্মীকে টাকা দিতে হয় না)।
‘এখন পেনশনের জন্য যে টাকা দরকার হয় সেটি সরকারই বাজেটের মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়। এখানে কর্মীকে কিছু দিতে হচ্ছে না। আর নতুন স্কিম চালুর পর যারা চাকরিতে আসবেন তারা একটি পরিমাণ অর্থ জমা রাখবেন, যার সাথে সরকার সমপরিমাণ অর্থ দিবে। এ দিয়ে একটি তহবিল তৈরি হবে। সেখান থেকে বিনিয়োগ হবে এবং লভ্যাংশও যোগ হবে প্রত্যেকের অর্থের সাথে,’ বলেন তিনি।
এখানে বলে রাখা ভালো, পেনশনের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ধরন এখন কার্যকর আছে।
বর্তমানে একজন কর্মকর্তার ২৫ বছরের চাকরি জীবন শেষে তার মূল বেতনকে ২৩০ গুন করে যে মোট টাকা হবে তার ৯০ শতাংশ হলো তার মোট পেনশন। যার মধ্যে ৫০ শতাংশ এককালীন পাবে যেটা গ্রাচুইটি আর বাকি অর্থ মাসিক ভিত্তিতে হবে।
এছাড়া সরকারি কর্মকর্তারা লাম্প গ্রান্ট নামে (ছুটির প্রাপ্যতার ভিত্তিতে) একটি সুবিধা পান চাকরি জীবন শেষে। এর মাধ্যমে তারা শেষ মূল বেতনের ১৮ গুণ টাকা পেয়ে থাকেন অবসর সুবিধার আওতায়।
এর বাইরে তারা প্রভিডেন্ট ফান্ড সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে প্রভিডেন্ট ফান্ড হলো কর্মীর নিজের জমানো টাকা লভ্যাংশসহ পেয়ে থাকেন। অবসরে যাওয়ার পর তিনি সেটি তুলতে পারেন।
আবার চাকরিতে থাকা অবস্থায় কোনো প্রয়োজন হলেও সেখান থেকে টাকা তুলতে পারেন। কর্মকর্তারা বলেন, এসব সুবিধা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সামরিক বেসামরিক ও সরকারি সব কর্মীর জন্য একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা সম্বলিত স্কিম তৈরি করাটাও অনেক বড় চ্যালেঞ্জের কাজ।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভুইয়া বলেন, প্রস্তাবিত স্কিমটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য অসম্মানজনক ও বৈষম্যমূলক। শিক্ষকদের এর বাইরে রাখার দাবিতে তারা কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।
পেনশন স্কিম কিভাবে খোলা যায়
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের জন্য এই ওয়েবসাইটে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে ব্যক্তি তার জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর ও ইমেইল দিয়ে কয়েকটি ধাপে এতে নিবন্ধন করবেন। এসময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য দরকার হবে। কেউ চাইলে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে নমিনি করতে পারবে।
মাসিক চাঁদা ছাড়াও কেউ চাইলে তিন মাস পরপর বা বছরে একবার পুরো চাঁদা দিয়ে দিতে পারবে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে তার পরের এক মাস পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া চাঁদা পরিশোধ করা যাবে। এরপর থেকে প্রতি দিনের জন্য ১% বিলম্ব ফি যুক্ত হবে। কেউ টানা ৩ কিস্তি পরিশোধ না করলে তার অ্যাকাউন্টটি স্থগিত হয়ে যাবে। তবে কেউ যদি নিজেকে অসচ্ছল ঘোষণা করে তাহলে ১২ মাস পর্যন্ত চাঁদা না দিলেও অ্যাকাউন্টটি স্থগিত হবে না।
অনলাইন ও যেকোনো মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে চাঁদা পরিশোধ করা যাবে। আপাতত শুধুমাত্র সোনালী ব্যাংকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের হিসাব খোলা হয়েছে। কেউ চাইলে সরাসরি সোনালী ব্যাংকে গিয়েও নিবন্ধন করতে পারবেন এবং চাঁদা দিতে পারবেন।
পেনশনাররা আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। তবে কেউ যদি ৭৫ বছর বয়স পূরণ হওয়ার আগেই মারা যান তাহলে তার নমিনি পেনশনারের বয়স ৭৫ হওয়া পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পাবেন।
আর যদি পেনশনার ১০ বছর চাঁদা দেয়ার আগেই মারা যান তাহলে তার জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে।
কারো যদি পেনশনে জমাকৃত অর্থ কোনো এক পর্যায়ে উত্তোলনের দরকার হয় তাহলে সেই সুযোগও থাকছে। তার মোট জমার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ অর্থ তিনি আবেদনের প্রেক্ষিতে ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন।
পেনশনের জন্য প্রতিমাসে জমা দেয়া চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হবে এবং সেই অর্থ কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে। আর মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ হবে আয়কর মুক্ত।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা