কাতারের আমিরের সফরে যা যা পেতে পারে বাংলাদেশ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২২ এপ্রিল ২০২৪, ২২:৫৫
কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি দু’দিনের সফরে সোমবার বিকেলে ঢাকায় এসেছেন। প্রায় দু’দশক পর কাতারের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশ সফরে এলেন।
এই সফরটিকে ব্যবসা বাণিজ্য, জনশক্তি রফতানি এবং মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতার এখন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করায় এই গুরুত্ব আরো বাড়িয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, এই সফরে বাংলাদেশের সাথে কাতারের ১১টি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।
এর মধ্যে মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বন্দীবিনিময়, দ্বৈত কর প্রত্যাহার ও শুল্ক বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা- এই চুক্তিগুলো চূড়ান্ত আছে। এর বাইরে বাংলাদেশ থেকে কাতারে জনশক্তি রফতানি, ধর্মীয় বিষয়ে সহযোগিতা, বন্দর ব্যবস্থাপনায় কাতারের প্রতিষ্ঠান মাওয়ানির সংযুক্তি, উচ্চশিক্ষায় সহযোগিতা ও কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।
জ্বালানি নিরাপত্তার জন্যও এই সফরকে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে এখন হামাস-ইসরাইল এবং ইসরাইল-ইরান যে সঙ্কট চলছে তার প্রেক্ষাপটে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে এনার্জির মজুত আরো বাড়ানোর ক্ষেত্রে এবং এনার্জি সিকিউরিটি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমি মনে করি এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
জানা গেছে, বাংলাদেশ এক বছরের বিলম্বিত পেমেন্টে কাতার থেকে জ্বালানি নিতে চায়। বাংলাদেশে এলএনজির জন্য বলতে গেলে পুরোপুরি কাতারের ওপর নির্ভরশীল।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে বিদ্যমান দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর, বন্ধুত্বপূর্ণ ও বহুমুখী। কাতার বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী অন্যতম মুসলিম রাষ্ট্র। এছাড়া কাতার মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার, যেখানে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশী কর্মরত।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মো: শহীদুল হক মনে করেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের যা পরিস্থিতি তাতে এই সফরে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় সবচয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। বাংলাদেশ এলএনজির জন্য বলতে গেলে পুরোপুরি কাতারের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ যদি এখন লং টার্ম পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্টে যেতে পারে তাহলে সস্তা দামে এলএনজি পাবে। আর জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। আর এখন যে স্পট মার্কেট থেকে কেনা হচ্ছে যার দাম বেশি পড়ছে। বাংলাদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর একটি অংশ এখন এলএনজিতে চলছে। তাই এর সাপ্লাই নিশ্চিত হলে আমাদের বিদ্যুতের ক্ষেত্রে একটা ভালো অবস্থা তৈরি হবে।’
আর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো: তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘অনেক বছর পর কাতারের কোনো আমির বাংলাদেশ সফর করছেন এই কারণেই এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এলএনজি আমদানি ছাড়াও কাতারে আমাদের এখানকার অনেক লোক কাজ করেন। এর জন্য আমাদের সম্পর্ক ভালো থাকা দরকার। সরকার চেষ্টা করছে কাতার থেকে এক বছরের বিলম্বিত পেমেন্টে এলএনজি আনতে। এটা হওয়া অনেক কঠিন। তবে যদি পারে তাহলে অনেক ভালো হবে। এছাড়া যেসব চুক্তি বা এমওইউ হবে সেগুলো দৃশ্যমান সম্পর্কের জন্য ভালো।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে কাতার বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে নবম অবস্থানে আছে। চলতি অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) প্রথম নয় মাসে প্রবাসীরা দেশটি থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৮৩৮ দশমিক ২২ মিলিয়ন ডলার।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতারের অবস্থান সপ্তম। ২০০১ সাল থেকে কাতারে জনশক্তি রফতানি ব্যাপকভাবে কমে গিয়ে ২০১৫-১৬ সালে আবার ভালো অবস্থানে চলে আসে। এরপরের চার বছর আবার কমে যায়। ২০২০ সাল পর্যন্ত এই খারাপ অবস্থা চলতে থাকলেও কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরকে কেন্দ্র করে ২০২১ সাল থেকে আবার বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৬ হাজারেরও বেশি জনশক্তি কাতারে গিয়েছে। তবে কাতারে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও বাংলাদেশী কর্মীদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বিশ্বকাপ আয়োজনের গৌরব অর্জনের পর থেকে কাতারে প্রতি সপ্তাহে গড়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৯২৭ জন প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকের সংখ্যা এক হাজার ১৮ জন। এই তথ্য দ্য গার্ডিয়ানের।
তাই কাতারের আমিরের বাংলাদেশ সফরের এই সময়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে।
এইচআরডব্লিউর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার উপ-প্রধান মাইকেল পেজ বলেন, ‘কূটনৈতিক শুভেচ্ছার চেয়ে এই সফরে কাতারে প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষা এবং হয়রানি বন্ধে পদক্ষেপের ব্যাপারে কার্যকর আলোচনা দরকার। আর এই সফর থেকে ফিরে কাতারের আমিরের উচিত হবে প্রবাসী কর্মীরা যেখানে চিকিৎসা নেয় সেই কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে যে শ্রমিকেরা মারা গেছেন তাদের পরিবারের সাথে কথা বলা।’
এইচআরডব্লিউ বলছে, ‘কাতারের মোট জনসংখ্যার ৮৮ ভাগই অভিবাসী কর্মী। তাই তাদের সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া উচিত।’
মো: তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘কাতারে অন্যদেশের কর্মীদের চেয়ে বাংলাদেশের কর্মীরা কম মজুরি পান। এর কারণ হলো তারা কোনো ব্যক্তির অধীনে ওই দেশে যান। যে ব্যক্তি তাদের নিয়োগকর্তা তিনি তাদের আয়ের একটি অংশ রেখে দেন। সরকারের উচিত হবে এই বিষয়গুলো নিয়ে কতারের সাথে কথা বলা। যাতে আমাদের শ্রমিকেরা না ঠকেন।’
শ্রমিকদের প্রসঙ্গে মো: শহীদুল হক বলেন, ‘আর সেখানে এখন দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা। আমাদের উচিত হবে দক্ষ শ্রমিক সেখানে পাঠানো। যারা সেখানো বাংলাদেশ থেকে যান তারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন। কাতার গড়ে তুলেছে বাইরের শ্রমিকেরা। এখন আমাদের উচিত দক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে তাদের পরবর্তী উন্নয়নে অংশীদার হওয়া। এবারের সফরে সেই দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং অ্যাজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘কাতারে লোক পাঠানোর প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল। ফলে সেখানে ধীর গতিতে বাংলাদেশের কর্মীরা যাচ্ছেন। এই প্রক্রিয়াটা সহজ করলে সেখানে কর্মী যাওয়া বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘সেখানে সার্ভিস সেক্টরে কর্মীদের চাহিদা বাড়ছে। সরকার সহযোগিতা করলে আমরা এখন সেই সেক্টরগুলো ধরতে পারি।’
কূটনীতিবিদেরা বলছেন, ২০১৭ সালে আরব লিগ, বিশেষ করে সৌদি আরবের ভূমিকায় মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোর সাথে কাতারের সম্পর্কের ভয়াবহ অবনতি ঘটেছিল। ওই সময় কাতারের বিপক্ষে অবস্থান নিতে বাংলাদেশের ওপর সৌদি আরবের প্রবল চাপ ছিল। তারপরও বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল। তাই দেশটি বাংলাদেশের ওপর সন্তুষ্ট। আর এখন মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কাতার সবচেয়ে বড় প্লেয়ার।
মো: শহীদুল হক মনে করেন, ‘এটা বাংলাদেশের জন্য একটা সুবিধা। কাতারের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বাংলাদেশকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নানা সুবিধা নিতে সহায়তা করতে পারে।’
এর আগে ২০০৫ সালে কাতারের তৎকালীন আমির হামাদ বিন খলিফা আল থানি বাংলাদেশে এসেছিলেন।
সূত্র : ডয়চে ভেলে