১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আসমা আব্বাসী তার স্মৃতি ও সমাধি

আসমা আব্বাসী। ৪ জুলাই ২০২৪ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। জন্ম ৪ জানুয়ারি ১৯৪২ -

৪ জুলাই ২৪ বৃহস্পতিবার বিকেলে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ আসমা আব্বাসী। পরদিন শুক্রবার বাদ জুমা গুলশানে নামাজে জানাজা। আজাদ মসজিদের বৃহত্তর প্রাঙ্গণে নিকটাত্মীয়, শুভান্ধ্যুয়ীদের ভিড়। পরিবারের পক্ষে ছিলেন কণ্ঠগর্ব ফেরদৌসী রহমান, ড. নাশিদ কামাল। ছিলেন আব্বাসী-আসমা দম্পতির কনিষ্ঠা কন্যা শারমিনী আব্বাসী লাবনীও। ‘আমার মেয়েকে বলি, আদৃতার চিঠি’র লেখিকা।
মৃত্যু নিয়ে মিডিয়াজুড়ে ব্যাপক প্রচারণা, দেশে-প্রবাসে। শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক আসমা আব্বাসীর প্রয়াণ। সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দিনের খ্যাতিমান পুত্রবধূ। কিংবদন্তী সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাগ্নী। মৃত্যুকালে বয়স ৮২, ১৫ গ্রন্থের লেখিকা... ইত্যাদি।
আমার ফুপাতো ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসীর স্ত্রী তিনি। অসাধারণ সব গুণপনায় অভিষিক্ত জীবন। যেমন লিখতে পারেন, বলতেও পারেন। দেশ-বিদেশে ভ্রমণানন্দে চলতেও পারেন। উত্তরবঙ্গ, সিলেট ও সুদূর অ্যামেরিকা সফরে ছিলাম সঙ্গী।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের মধ্যস্থতায় পরিণয়। আব্বাসী দম্পতির লেখালেখি ও সংস্কৃতিচর্চার প্রধান মেন্টর দু’জন। ‘চাচা জসীমউদ্দীন’ ও ‘মামা মুজতবা আলী’। ১৯৬৩-তে বিয়ে, আমার সাথে সম্পর্ক ১৯৬৬ থেকে। ফুপাতো বোন কণ্ঠগর্ব ফেরদৌসী রহমানের বিবাহোৎসব। পৈতৃকবাস রংপুরের ডোমার থেকে ঢাকায় প্রথম আসি। একেবারে কৈশোরকাল, উঠেছিলাম উনাদের বাড়িতে। হিরামন মনজিল, ৬৮ পুরানা পল্টন, ঢাকা। ভিড়ের ভেতর থেকে আসমা ভাবী আপন করে নিলেন। লেখালেখির গুণপনায় আমি উনার স্নেহধন্য হলাম।
বিবাহবর্ষ ১৯৬৩ থেকে ভাবী অধ্যাপনায় সম্পৃক্ত। ‘পুরানা পল্টন গার্লস কলেজ’কে দিলেন পুরো পেশাজীবন। ১৯৯৫-এ শিক্ষকতায় পেলেন ‘রাষ্ট্রপতি পদক’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স, মাস্টার্স। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ধর্মবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা। ব্যবহারিক জীবনে ছিলেন ধর্মপ্রাণ। সামাজিক পারিবারিক বিষয়ে লিখেছেন শতাধিক নিবন্ধ। টিভি-বেতারে দৈনন্দিন বিষয়ে মুগ্ধতামুখর বক্তা। ‘চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে’র সদস্যও ছিলেন নব্বই দশকে। সমাজসেবা করতেন রোটারী ও ইনার হুইল ক্লাবের ব্যানারে। ব্যক্তিগত দান-অনুদানে কখনও পশ্চাৎপদ ছিলেন না।

সাহিত্যচর্চায় গল্পচ্ছলে মনের কথা বলতে পারতেন। ১৫টি গ্রন্থের অধিকাংশই গদ্যের, হৃদকাড়া বাক্যের। মনকাড়া গানগুলোর বাণী দিয়েও শিরোনাম করেছেন। যেমন- আমার মল্লিকা বনে, বকুল বিছানো পথে। কিংবা কমলা রঙের দিনগুলো, পথিক মেঘের দল, হাসনরাজা। ধর্মবিশ্বাসের ওপর লিখেছেন ‘ভ্রমর কইও গিয়া’। রাধারমণের গানের বাণী, ভেতরে ধর্মচর্চার জোর আহ্বান। মামা মুজতবা আলীর অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রভক্তিও গভীরতর। লিখেছেন বই- রবীন্দ্রনাথ : প্রকৃতির গান। উপশিরোনাম : আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম আলো।
মৃত্যুর পরদিনই সমাধিস্থ করার উদ্যোগ-আয়োজন। বাদ জুমা আমি অতিদ্রুত চলে যাই বনানী কবরস্থানে। দেখলাম কবর খুঁড়ে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা। বনানীতে নতুন কোনো কবর দেয়ার জায়গা নেই। পুরনো কবরেই শায়িত করানো হয় নতুন লাশ। আসমা ভাবীর সৌভাগ্য- ওখানে উনার মায়ের কবর ছিল। সৈয়দা হিফজুন্নেসা খানম (১৯০৯-১৯৮০)। ভাবীর আব্বা অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান চৌধুরীর কবর সিলেটে। হয়রত শাহাজালাল রহ:-এর মাজার প্রাঙ্গনে। উনি ছিলেন সিলেট আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল।
সমাধিপ্রাঙ্গণে পেলাম ভাবীর ছোট জামাতা আশরাফ কায়সারকে। আশির দশকের মেধাবী সাংবাদিক, পরে বিজ্ঞাপন নির্মাতা। গোরখোদক ডেকে সামগ্রিক দায়িত্ব পালন করেছে। পেলাম নাফিজ নামে আরেক প্রকৌশলীকে। জানালো আসমা ভাবীকে সে খালাম্মা ডাকতো। বড় মেয়ে সুমি বা সামিরা আব্বাসীর শ্রেণিবন্ধু। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট-এ একই ব্যাচ। সামিরার স্বামী খালেদ সোবহানেরও শ্রেণিবন্ধু, ঢাকা কলেজে। উল্লেখ্য, ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েটে খালেদ ও সামিরা স্ট্যান্ড করেছিল। খালেদের বাবা আব্দুস সোবহান সরকারের তথ্য অধিদফতরের প্রধান ছিলেন। পেশাগত কারণে আমার সাথে ছিল সেতুবন্ধ সম্পর্ক। খালেদ-সামিরা দম্পতি অ্যামেরিকার ফ্লোরিডায় বসবাসরত। কিছু দিন আগেই ঢাকা সফরে এসেছিল সপরিবারে। তাদের অপেক্ষা না করেই আসমা ভাবীকে সমাধিস্থ করা হলো।
কবরে নারীদের লাশ নামাতে সামিয়ানা ধরতে হয়। আমার সৌভাগ্য হলো একটি কোনা ধরে রাখবার। মুনাজাত পরিচালনা করলেন মুফতি মাহবুবুর রহমান। মায়ের কবরে শায়িত হচ্ছেন আমাদের ‘ভাবীশ্রেষ্ঠ’। অনেক স্মৃতির ভিড়ে মনে পড়ছে উনার লেখনী। ‘মহান মাতাকে’ নিয়ে চমৎকার স্মৃতিকথা লিখেছেন। সাদা শাড়িতেও দারুণ মুগ্ধতা ছড়াতেন। সিলেটে দরগাহ শরিফে শায়িত বাবাকে নিয়েও লিখেছেন। টিলার ওপারে কবরস্থানে নারীদের ওঠা নিষেধ। তারপরও দূর থেকে দেখতেন- গাছের পাতা পড়ছে। পবিত্র গন্ধে ম ম করছে সমাধিপ্রাঙ্গণ।
এভাবেই বাবা, মা, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর, ভাবী, অগ্রজেরা সবাই চলে গেছেন। জীবনচক্রের ধারাবাহিকতায় আসমা ভাবীও সমাধিস্থ হলেন। বেলা সাড়ে তিনটায় সবাই মুঠো মুঠো মাটি ফেললেন। মুনাজাত ছাড়াও উচ্চারিত হয়েছিল কবরস্থ করার দোয়া- ‘বিসমিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রাসূলিল্লাহ’। বনানী থেকে আমরা গেলাম ভাই-ভাবীর শোকভরা বাড়িতে। গুলশান লেকের সন্নিকটে পার্কের পাশেই বাড়ি ‘সিলভার স্প্রিং’। ফুপাতো ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসী এমনিতেই অসুস্থ। তদুপরি প্রিয় পতœীর আকস্মিক বিদায়। সমবেদনা জানাতে আমরা পাঁচ নিকটাতœীয় হাজির। সন্তানসহ পৈতৃকবাস বৃহত্তর রংপুরের ডোমারের বজু‘দা। আমার চাচাতো ভাই, আব্বাসী ভাই-এর মামাতো সহোদর। বজু‘দা যুদ্ধবর্ষের বীর মুক্তিযোদ্ধা, হজব্রত পালনকারী। উনার বাবা মোজাম্মেল হোসেন ডোমার ‘আব্বাসউদ্দিন একাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা। ২০২৪-এ পালিত হচ্ছে ‘অর্ধশতাব্দী পূর্তির অনুষ্ঠান’। আব্বাসী ভাই, আসমা ভাবী একাধিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। ৩০ বছর পূর্তিকালে রাজকীয় আয়োজনেও উনারা ছিলেন। প্রায় ৩০ বছর যাবৎ আমি একাডেমির ‘গ্লোবাল সভাপতি’। আসন্ন ‘রজত জয়ন্তী’তে উনারা অনুপস্থিত থাকবেন, আহা...!
সহোদরের গাড়িতে দীর্ঘ দিন পর আবার আব্বাসীভবনে আগমন। ছিল সন্তানসহ অনুজ মাযহারুল আলম কিসলু। সে মুদ্রক ও প্রকাশক হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছে। শোকের বাড়িতে নাকি তিন দিন রন্ধনকর্ম বন্ধ থাকে। এ জন্য আমরা বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে নিই। বাসায় তখন শোককাতর কন্যা শারমিনী আব্বাসী লাবনী। নিকটাত্মীয় চন্দনা প্রধান, দু’জন গৃহকর্মী।

গৃহকর্তা মুস্তাফা জামান আব্বাসী ভাই শয্যশায়ী, বিষণœকাতর। একজীবনে প্রায় ৫৫টি প্রামাণ্য বই লিখেছেন। গান-গরিমায় দেশে-বিদেশে কোটি ভক্ত-অনুরক্ত। প্রায় ৫০০০ বর্গফুটের সরব বাসাটি নীরব, নিথর। এ বাসায় বহুবার এসেছি, বরাবর প্রাণবন্ত পেয়েছি। কী ড্রয়িং রুম, রিডিং রুম, রেয়াজ রুম, গেস্ট রুম। কথা, কবিতা, গান কৌতুক মিলিয়েই ‘ভাই-ভাবী’। কিন্তু ৫ জুলাই থেকে ভালোবাসার প্রিয় ভাবীটি নেই। দরাজ কণ্ঠের অর্ধশত গ্রন্থের আব্বাসী ভাই শোকশয্যায়। ছ’তলার আলোকোজ্জ্বল বড়িতে বাতিগুলোও নেভানো।
গুণে গুণে পাঁচটি নতুন মাস্ক এনে দিলো চন্দনা প্রধান। বললো, চাচু এগুলো সবাই পরেন, বেডরুমে চলেন। আস্তে কথা বলবেন, কোনো ছবি তোলা যাবে না। উনার মুখে ‘ক্যামেরার রে’ ফেলতে ডাক্তারের নিষেধ আছে। আপনাদের সাথে কথা বলেই উনি ঘুমিয়ে পড়বেন।
আমরা ধীর পায়ে ভেতরের শয়নকক্ষে প্রবেশ করলাম। প্রথমেই চোখে পড়ল সদাপ্রস্তত ‘হুইল চেয়ার’। আর আব্বাসী ভাই চোখ মুদে উঁচু বিছানায় শায়িত। বজুদা, কিসলু ও আমাকে দেখলেন, তিনটি পৃথক চাহনি। মূলত আমরাই সেদিন কথা বলে গেলাম। আজ তিনি যেন শুধুই নীরব শ্রোতা। অথচ একদা একসাথে কত ঘুরেছি, বেড়িয়েছি, থেকেছি। কথা, কবিতা, গানে সর্বদা মুখরিত দেখেছি তাকে।
নব্বই-এর দশকে আব্বাসী ভাই রোটারী ক্লাবের গভর্নর। বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুরের জন্যে শীতবস্ত্র নিলেন। সব জেলার পণ্য কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিতরণ। নীলফামারী ও পঞ্চগড়ে উনি-আমি দিলাম সরাসরি। মধ্যরাত পর্যন্ত শীতার্ত মানুষকে কম্বলে জড়ানোর স্মৃতি। রাতে আমাদের ডোমারের বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ। আমার আব্বা সরকার সোলায়মান উনার ‘প্রিয় মামু’। রাতে এক বিছানায় আব্বাসী ভাই আর আমি। বললেন, তারুণ্যে কতবার এসেছি, থেকেছি, হাটে গ্যাছি। আজ যেন সেই স্বর্গীয় শান্তি ফিরে পেলাম।
আরেকবার ভারতের কোচবিহার থেকে ডোমার এলেন। পরদিনই উড়াল দিলেন ঢাকার উদ্দেশে। বললেন, কাল চার জানুয়ারি, আসমার জন্মদিন। মন চলে গেছে সেই মহতী পতœীর করকমলে। অতএব এবারে আর থাকা হচ্ছে না, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
১৯৬৩ থেকে ২০২৪- ৬১ বছরের দাম্পত্য। পারস্পরিক বন্ধন ছিল অত্যন্ত প্রগাঢ়। বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে এর প্রমাণ পেয়েছি। দাম্পত্যসুখের প্রিয়মুখ আব্বাসী ভাই একা হয়ে গেলেন। ব্যক্তিজীবনে উভয়েই পারিবারিক বন্ধনকে গুরুত্ব দিতেন। সন্তান, নিকটাত্মীয়-সবাই পর্যাপ্ত সমাদর পেয়েছে। শোককাতর থেকেও দেখা করলেন, কথা বললেন। মূলত সবার কাছ থেকে দোয়া প্রার্থনা করলেন।
ভেতরবাড়ি থেকে বাইরে আসতেই দুটো চমক। সমবেদনা জানাতে এসেছেন কৃতবিদ্য ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রদূত মসউদ মান্নান। রোটারী ক্লাব, নজরুল একাডেমি, বুক ক্ল¬াবের কর্ণধার। কিন্তু আব্বাসী ভাই ততোক্ষণে নিদ্রাজনিত অবকাশে। দ্বিতীয় চমকটি হলো- আমাদের জন্যে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন। শোকের বড়িতে খাদ্য গ্রহণে দ্বিধা থাকলেও উপেক্ষা চললো না । চন্দনা প্রধানের তদারকিতে পূর্বের মতোই ‘মাংস-পোলাও’ আপ্যায়ন।
অতঃপর সমবেদনা জানাতে কণ্ঠগর্ব ফেরদৌসী রহমানের উদ্দেশে রওনা। গুলশান থেকে ২৯-সি বনানীর ‘মেলোডী হাউজে’। সোয়াঘণ্টার পারিবারিক আড্ডায় অসংখ্য আজানা কথা, কাহিনী। চমকপ্রদ বিষয়গুলো জানাবো ভিন্ন এক লেখায়। তবে উনার কষ্ট, ‘জুনিয়র হয়েও আসমা কেনো আগেই গেলো।’ বললেন, আব্বাসী ভাই, আমরা স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘ দিন অসুস্থ। কিন্তু রোগী না হয়েও ‘শান্তিপূর্ণ মৃত্যু হলো আসমা আব্বাসীর। (সেই ১৯৪২-এর ৪ জানুয়ারি থেকে ৪ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার)।’ মহান আল্লাহ ওর বেহেস্ত নসিব করুক, আমিন।’


আরো সংবাদ



premium cement