১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আসাদ বিন হাফিজ সত্যের পথে নির্ভীক এক কবি

আসাদ বিন হাফিজ। গত ১ জুলাই ২০২৪ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৫৮ -

সত্যের পথে নির্ভীক স্বাপ্নিক কবি আসাদ বিন হাফিজ ইন্তেকাল করেছেন এ সংবাদে আমার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। মৃত্যু ভয় আমার মাঝেও ভূ-কম্পন সৃষ্টি করেছে। কারণ তিনি এবং আমি দু’জনেই সমবয়সী। কলেজমেট এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে একই কাফেলার সহযাত্রী। আজ এ মুহূর্তে মনের আয়নায় কত স্মৃতি দোল খাচ্ছে তা বলে বোঝানো যাবে না।
ছাত্রজীবন থেকেই আসাদ বিন হাফিজ ছড়া-কবিতা-গান রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সাহিত্য, শিল্প, প্রকাশনা ও সাংবাদিকতায় তিনি নিজের সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন মোটা দাগে। হয়তো বিভাজিত বাংলা সাহিত্যে সার্বিকভাবে তার নাম উচ্চারিত না-ও হতে পারে। কিন্তু কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি গোলাম মোহাম্মদ এবং সত্যের পথে জীবন উৎসর্গকারী কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের মতো এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হৃদয়ে আসাদ বিন হাফিজ চিরকাল জ¦ল জ¦ল উজ্জ্বল বাতিঘরের মতো আলো ছড়িয়ে যাবেন। সে আলোয় পথ খুঁজে পাবে পথভোলা শত সহস্র মানবকুল।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের একনিষ্ঠ অনুসারী কবি আসাদ বিন হাফিজ কৈশোর থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি তার ছড়া-কবিতা, গান ও কথাসাহিত্যে জাতির পুনর্জাগরণ এবং মদিনার কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা পাঠকের মাঝে জাগিয়ে তোলেন।
আসাদ বিন হাফিজকে তার দু’টি কাব্যগ্রন্থ খ্যাতির উচ্চচূড়ায় সমাসীন করে; আর তা হলো- কি দেখ দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর এবং অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার। বিগত তিন দশক থেকে প্রায় প্রতিটি সাহিত্যানুষ্ঠানে ও কবিতা আবৃত্তির প্রতিযোগিতায় বাচিক শিল্পীদের সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ কবিতাটি। ‘ছন্দের আসর’ বইটিও নবীন তরুণ শিক্ষানবিস কবিদের খুবই প্রিয়।
বর্তমান ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে এসে পেনভিশন টেলিভিশনের সুবাদে কবি আসাদ বিন হাফিজের সুখ্যাতি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে।
কবি আসাদ বিন হাফিজের সাথে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। সবগুলো বর্ণনা করতে গেলে আলাদা একটি গ্রন্থ হয়ে যাবে। সমবয়সী হলেও তার সাথে আমার শ্রদ্ধামিশ্রিত প্রীতিপূর্ণ ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল সবসময়। আমরা দু’জন কলেজমেট হলেও ঢাকা কলেজে দু’টি আলাদা সেকশনে পড়ার কারণে একে অপরের সাথে পরিচিত হইনি। সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে কাজ করতে এসে একে অপরের সাথে গভীর সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হই। এ সম্পর্ক বিগত চার দশকের।

ঢাকা গেলেই তার সুপ্রসিদ্ধ প্রীতি প্রকাশনে দেখা হতো, আড্ডা হতো। আমি মূলত দৈনিক সংগ্রাম অফিসে সম্পাদক আবুল আসাদ, কবি আল মাহমুদ, কথাসাহিত্যিক জহুরী (সালেহ উদ্দিন আহমদ জহুরী), কবি সাজজাদ হোসাইন খান, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক ভাষ্যকার মিজানুল করিম এবং ফররুখপুত্র কবি আহমদ আখতার-এর সাথে সাক্ষাৎ শেষে আসাদ ভাইয়ের অফিসে বসে দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ আলোচনায় মত্ত হতাম। এখানে বলে রাখা ভালো, প্রীতি প্রকাশন থেকে বিভিন্ন বিষয়ে স্বরচিত শত শত বই প্রকাশ ও বিপণন করতে গিয়ে আসাদ তার কাব্য প্রতিভার, সৃজনশীলতার, মননশীলতার; এবং সর্বোপরি নিজ স্বাস্থ্যের উপর চরম আঘাত হেনেছেন। তখন থেকেই তিনি নানা ব্যাধি ও হৃদরোগে বারবার আক্রান্ত হয়েছেন। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত তার সঙ্গী ছিল। অথচ তার চেয়ে ১০/২০ বছরের অধিক বয়সেরও অনেক ব্যস্ত মানুষ চির তরুণের মতো বেঁচে আছেন।
আসাদ ভাই চট্টগ্রামে নানা প্রয়োজনে বহুবার এসেছেন। কখনো মেহমান হিসেবে, কখনো সাংগঠনিক কাজে আবার কখনো প্রীতি প্রকাশনের বিপণন কাজে। প্রায় প্রতিবারই তার সাথে দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। প্রাণোচ্ছল সদাহাস্য মুখের আসাদ ভাই শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখতেন তার যশস্বী কথোপকথনে।
চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সে তিনি তিনবার এসেছিলেন। প্রথমবার নিজ প্রকাশিত বই বিপণনের জন্য, দ্বিতীয়বার মাসিক দ্বীন দুনিয়া ও কিশোর দ্বীন দুনিয়ার লেখক-পাঠক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে এবং শেষবার ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর উন্মুখ সাহিত্য অঙ্গনের লেখক সমাবেশ ও সাহিত্য আড্ডায় প্রধান আলোচক হিসেবে। ১৯ মার্চ ২০০৮ মাসিক দ্বীন দুনিয়ার লেখক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে চট্টগ্রাম আগমন করলে তাকে আমরা স্টেশন রোডের হোটেল গোল্ডেন ইন এ থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। পরদিন তিনি লেখক সম্মেলনের মঞ্চ আলোকিত করে তরুণদের প্রতি উদ্দীপনামূলক যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা এখনো আমাদের সবাইকে প্রেরণা দেয়।

এ সময় তার সাথে নানা বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। নানা বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করেছি, তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তাতে ফুটে উঠেছে সত্যের পথে নির্ভীক স্বাপ্নিক কবি আসাদ বিন হাফিজের হৃদয়কন্দরে লুকায়িত সব কথা। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কেন লিখেন? তিনি বলেন, সব মানুষেরই সমাজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা থাকে। এই দায়বদ্ধতা পরিশোধের জন্য আল্লাহ্ বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন রকমের যোগ্যতা দান করেন। মানুষ সে যোগ্যতা দিয়ে চেষ্টা করে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে। আমার লেখালেখি সে দায় শোধের সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র।
আরো বলেছিলেন- আমি স্বপ্ন দেখি প্রেম আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ এক সমাজের। স্বপ্ন দেখি শোষণহীন এক সভ্যতার। ভালোবাসি সুন্দরকে, ঘৃণা করি অসুন্দর। মানুষের নিচুতা আমাকে কষ্ট দেয়। দুঃখ পাই মানুষের ভণ্ডামি দেখলে। ভালো লাগে প্রকৃতির স্নিগ্ধ শ্যামলিমা, সবুজ অরণ্য। ভালো লাগে পাখির কূজন, শীতল ছায়া আর উন্মুক্ত প্রান্তর। সরলতাকে শ্রদ্ধা করি, তবে পছন্দ করি সচেতন মানুষ। বিশ^াস করি নীতি ও নৈতিকতায়। খুশি হই কাউকে আপন অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে দেখলে- আরো খুশি হই অন্যের অধিকারের প্রতি উপযুক্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখানোয়। মানুষকে ভালোবাসি, ভালোবাসি আল্লাহর সীমাহীন সৃষ্টি। অন্যায়, অসত্য ও অমানবিকতা নির্মূল করে মানবতার বিজয় অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে যাওয়াই আমার সাধনা। আমার এই সব বোধ-বিশ^াস, আমার এই সব ভালো লাগা, মন্দ লাগা নিয়েই আমার সব লেখা, আমার যত সুর আর ছন্দ।
আমাদের প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন ও দায়ভার কি? উত্তরে তিনি বলেন, একজন লেখক হিসেবে স্বদেশের মাটি এবং মানুষের প্রতিও রয়েছে আমার দায়ভার। সোনালি ফসল আর সবুজ শ্যামলীমায় ভরা আমার এ দেশ। এ দেশের মাটির শ্যামল রঙ রমণীর মতোই স্নিগ্ধ-কোমল অযুত সম্ভাবনায় ভরা। এখানে মাটির স্পর্শ পাওয়া মাত্র বীজ থেকে জন্ম নেয় বৃক্ষের কচি চারা। এই সম্পদ আর সমৃদ্ধি দেখেই চকচকে লোভ নিয়ে বারবার এখানে হানা দিয়েছে দেশী-বিদেশী দস্যু-ডাকাত। তাদের লুণ্ঠনের ফলে আমার দেশের পলিমাটির মতো নরম আর সরল সোজা মানুষগুলো আজ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। অজ্ঞানতা তাদের ভূষণ, সরলতা অলঙ্কার। তাদের এই অজ্ঞানতা ও সরলতাকে পুঁজি করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে এবং গড়ছে দেশী-বিদেশী লুটেরা ও প্রতারকের দল। আমার ছড়া ও কবিতা এই মাটি এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ। আমি তাদের শোনাতে চাই স্বর্ণালী ঐতিহ্যের কথা। শোনাতে চাই অধিকার আদায়ের সংগ্রামী মিছিলের বিজয়গাথা।
তাই স্বপ্নহীন কঙ্কালসার নিরন্ন মানুষকে জাগানোর গানে মুখর আমার ছড়া-কবিতা। আমাদের আবার জাগতে হবে। নিষ্প্রাণ চোখে ফুটিয়ে তুলতে হবে আশার বিদ্যুৎকণা। আশাহীন বুকে বুনতে হবে আশা ও সাহসের বীজ। আমি চাই, আমার লেখা হোক ঝিমিয়ে পড়া মানুষের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার দুরন্ত সাহস ও প্রেরণা। এক সুখী ও সমৃদ্ধ স্বদেশের স্বপ্ন দেখি আমি। আমার লেখায় ভাষা পায় আমার সে পল্লবিত স্বপ্ন। ভাষা পায় স্বপ্ন পূরণের আরাধ্য সংগ্রামের কাহিনী।

আমি স্বপ্ন দেখি সত্য ও সুন্দরের। যে সুন্দরের পরাগ দিয়ে আমাদের প্রিয় নবী পৃথিবীতে এনেছিলেন স্বর্গের সুখ। গড়েছিলেন প্রেম, ভালোবাসা আর মমতা ভরা এক আশ্চর্য ভুবন। পৃথিবী আবার সে সুখের সাগরে ডুব দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। দিকে দিকে শোনা যাচ্ছে সে বিপ্লবের পদধ্বনি; সমস্ত কলুষ-কালিমা মুছে ফেলে প্রেমময় সে পৃথিবী গড়ার জন্য। আমি আমার লেখাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি যুদ্ধের মাঠে। আমি লিখি, লিখি মানবতার সপক্ষ শক্তি যেন যুদ্ধের মাঠ থেকে বিজয়ের বার্তা নিয়ে ফিরে আসতে পারে। আমি লিখি মুক্তিকামী মানুষকে উদ্বোধিত ও উজ্জীবিত করতে।
আশির দশকের কবিদের মধ্যে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের পর আসাদ বিন হাফিজের কবিতা-গান তরুণ সমাজের মাঝে একটি বিশ^াসে বীজ বপন করতে সক্ষম হয়েছে। তার পাঠকের সংখ্যাও অনেক। পরবর্তী প্রজন্ম তার সৃজনসৃষ্টি থেকে অনুপ্রেরণার পর্যাপ্ত রসদ পাবে বলে আমার বিশ^াস।
আসাদ ভাই জীবনব্যাপী একনিষ্ঠ মনে নিরবচ্ছিন্নভাবে যে সাহিত্য সাধনা করে গেছেন, তা কখনো সম্ভব হতো না, যদি তার আদর্শ স্ত্রী কামরুন্নেছা মাকসুদা বিনাবাক্য ব্যয়ে তাকে সাপোর্ট দিয়ে না যেতেন। তার প্রিয় সন্তান আহমদ শাওকী ও আহমদ শামিল এবং কন্যা নুসাইবা ইয়াসমিন হয়তো পিতার একান্ত সান্নিধ্য সব সময় পায়নি কিন্তু আদর্শ পিতা হিসেবে তিনি তাদের সুশিক্ষিত ও মানুষের মতো মানুষ করে গিয়েছেন। হে প্রভু! তাদের পিতৃহারা শোক সইবার শক্তি দাও। তার স্ত্রীকে দুঃখ-বেদনা ভুলে সুস্থ রেখো, শতায়ু দান করো।
দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ্ কবি আসাদ বিন হাফিজকে সত্যের পথে নির্ভীকভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়ার বিনিময়ে তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের আরাম গাহে চির প্রশান্তিতে রাখুন।


আরো সংবাদ



premium cement