একজন কবিকে এমনই হতে হয়
- ইউসুফ শরীফ
- ২৮ জুন ২০২৪, ০০:০৫
- কবি ওমর আলীকে ১৯৭৬ সালে আজাদ অফিসে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে মনে হয়েছিল একজন কবিকে এমনই হতে হয়। শেষ যে দিন দেখি সে দিনও এ কথাটাই মনে হয়েছে
কোনো কোনো স্মৃতিচারণ পুরনো হয় না, বরং হয় ইতিহাসেরও সূত্র-উৎস। মায়াময় শ্যামল বাংলার কাব্য-সাহিত্যের অনন্য কবি ওমর আলীকে নিয়ে এই স্মৃতিচারণ যতবারই উল্লেখ করা হোক না কেন পুরনো হবে না বলেই মনে করি।
কবি ওমর আলীর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয় বৈশাখ, ১৪০৮/এপ্রিল, ২০০২-এ। শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশের পর কবি প্রথম ঢাকায় আসেন ২০০৩ সালের শুরুর দিকে। কুরিয়ারে কবিকে বই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ‘গতিধারা’র কর্ণধার প্রয়াত সিকদার আবুল বাশার। কবি ইনকিলাবে আমার কক্ষে ঢুকে বললেন, ঢাকা এসে সোজা আপনার কাছে, আপনাকে নিয়ে যাবো বাংলাবাজার... বাশার সাহেবের ওখানে। এখন মাঝে মধ্যেই মনে হয়... বাশার আমার কথায় রাজি হয়েছিলেন বলেই পাঁচশ’ পৃষ্ঠার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র দুই মলাটের ভেতর কবি ওমর আলীকে পাওয়া যাচ্ছে। কবিকে একসময় নিজ উদ্যোগেও বই বের করতে হয়েছে। তিনি বলতেন, কোনোমতে ছাপার অক্ষরে রেখে যাচ্ছি... তাঁর কণ্ঠে আফসোসের রেশ আমাকে ভাবিত করলেও কিছু হতো না, যদি বাশার রাজি না হতেন।
কবি ওমর আলী ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় লিখেছেন : ‘একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা না বললে এ ভূমিকা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যে কথা বলতে চাচ্ছি তা হলো আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু ইউসুফ শরীফ ও স্নেহাষ্পদ অনুজপ্রতিম সিকদার আবুল বাশারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন। এই মহৎপ্রাণ দুজনের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছা না থাকলে আমার সারাটা সাহিত্যিক জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতো কি না সন্দেহ। আমার বন্ধু ইউসুফ শরীফ আমার জন্য অক্লান্ত ও ধৈর্যশীল, নিজে এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমার সঙ্গে পরিশ্রম করেছেন, পত্রের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন, পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছেন এবং সিকদার আবুল বাশার এই দুর্মূল্যের বাজারে এত বৃহৎ আকারের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশের ঝুঁকি নিয়েছেন।’
‘এদেশে শামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’র কবি ওমর আলীকে জানি ষাট দশকের গোড়ার দিক থেকে... আমার কবিতা লেখার প্রস্তুতি-পর্বের সময়ে জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র পর যে চার কবির চারটি কাব্যগ্রন্থে আমি মগ্ন হয়ে ছিলাম প্রকাশক্রম অনুযায়ী সে চারটি হলো... কবি মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ র ‘জুলেখার মন’ (জুন, ১৯৫৯), শামসুর রাহমানের ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ (১৯৬০), ওমর আলীর ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ ( ১৯৬০), আল মাহমুদের ‘লোক লোকান্তর’ (১৯৬৩)।
কবি ওমর আলীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৭৪ সালে সম্ভবত শুরুর দিকে দৈনিক ইত্তেফাকে। কবি খুঁজছিলেন দাদাভাইকে... পাশে দাদাভাইয়ের রুম ছিল তালাবন্ধ... তখনো আসেননি। সম্পাদকীয় বিভাগের দরজার কাছটায় আমার টেবিল...আমি ডেকে বসালাম। তিনি বললেন, আমি ওমর আলী...কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বললাম, ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’...কবি বসতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ভাই আপনি আমার প্রথম বইটির নাম এত সুন্দর করে উচ্চারণ করলেন! পাশের রুমে শব্দ শোনা যাচ্ছে... দাদাভাই এসে গেছেন। চা খেয়ে যাওয়ার সময় আরেকবার জড়িয়ে ধরলেন। এরপর দেখা ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝির দিকে ঢাকেশ্বরী রোডে আজাদ অফিসে। ওই বছরই শুরুর দিকে দৈনিক আজাদ-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেয়ার পর থেকে এক দশককাল সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বও আমি পালন করেছি। যতদূর মনে পড়ে প্রথম দিকেই ‘ওমর আলীর কবিতা’ শিরোনামে কবির একাধিক কবিতা একসঙ্গে প্রকাশ করি। তিনি লেখা পাঠাতেন ডাকে-- সঙ্গে চমৎকার একটি চিঠি, যে চিঠিতে তার উষ্ণ আন্তরিকতার স্পর্শ পাওয়া যেত। কবি সেদিন আজাদে লাল ভবনের দোতলায় আমার কক্ষে ঘণ্টা তিনেকের বেশি সময় কাটিয়েছিলেন। এর মধ্যে মুজীবুর রহমান খাঁ সাহেবের সঙ্গেও দেখা করেন। আমার সম্পাদকীয় লেখা শেষ হবার পর কবির সঙ্গে তার কবিতা নিয়ে আলোচনা রাস্তা পর্যন্ত গড়ায়। কবি উঠেছিলেন নবাবপুর রোডে এক হোটেলে-- নবাবপুর রোড ছিল তার খুব প্রিয়। পরে যতদূর শুনেছি, কবি আল মাহমুদ আর ওমর আলী প্রথম যৌবনে এখানেই রথখোলার মোড়ের কাছাকাছি কোথাও থাকতেন। তাদের দু’জনের এই সময়কার কথা ওমর আলীও কিছু বলেছেন। আল মাহমুদ আর ওমর আলী...এই দুই কবির মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে সম্পর্কটা বোধহয় ঠিক আগের মতো ছিল না...অবস্থানগত দূরত্বের কারণে অনেক সময় সম্পর্কেও দূরত্ব দেখা দিতে পারে...বাস্তব কারণেই তা হয়। কবি আল মাহমুদকে খুব ভালোবাসতেন কবি ওমর আলী। ঢাকা এসে কয়েকবারই আরামবাগে আমার মেসে ছিলেন। একবার আল মাহমুদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ওমর আলীর চোখ টলমল করতে দেখেছি। ২০০৪ সালে আল মাহমুদ, মোফাজ্জল করিম...এই দুই কবি আর আমি নাটোর গিয়েছিলাম বাংলার পৌনে আটশ’ বছরের ইতিহাসভিত্তিক এক ডজনের বেশি উপন্যাসের লেখক কথাসাহিত্যিক শফীউদ্দীন সরদারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। রাতে নাটোর সার্কিট হাউসে মাহমুদ ভাই আর আমি কথা বলছিলাম। তখন ওমর ভাইয়ের কথা তুললাম। মাহমুদ ভাই থমকে গিয়ে মনে হল অনেক দূর থেকে বললেন, প্রথম যৌবনকে মানুষ চাইলেই ভুলতে পারে না...ও আমার ভাল বন্ধু...পাগল একটা...বড় অভিমানী...লেখে কিন্তু অসাধারণ...একটা ধারা সে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে...। আমার মনে হল অবস্থানগত দূরত্ব কোন বিষয় হতে পারে না...বোধ-চৈতন্যে ফাটল না ধরলে সম্পর্ক সম্পর্কের জায়গায় অটুট থাকে।
কবি ওমর আলীকে ১৯৭৬ সালে আজাদ অফিসে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে মনে হয়েছিল একজন কবিকে এরকমই হতে হয়। শেষ যে দিন দেখি সে দিনও এই কথাটাই মনে হয়েছে। ইনকিলাব অফিসের গেটে তাকে রিকশায় তুলে দেবার সময় বললেন, ইউসুফ, আপনারও কয়েক খণ্ডে উপন্যাসসমগ্র-গল্পসমগ্র বের হোক আমি চাই। না হলে খুব খারাপ লাগবে ভাই আমার। এই ছিলেন আমার দেখা-জানা কবি ওমর আলী।
কবি ওমর আলীর সঙ্গে এবং তার কবিতার সঙ্গেও আমার দীর্ঘকালের অনেক স্মৃতি। আরো অনেকের সাথে চেতনাপ্রবাহ থেকে সেই সব বয়ান এখন লিখছি আমার স্মৃতি-মূল্যায়নমগ্ন গ্রন্থ ‘দেখেছি-জেনেছি যাঁদের’-এ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা