জননী
- লিপি মনোয়ার
- ৩১ মে ২০২৪, ০০:০৫
বেলগাছি রেলস্টেশনে সকাল ৮টার ট্রেন আসার আগেই রহিসউদ্দিন স্টেশনে পৌঁছে যায় তার সিদ্ধ ডিমের ঝুড়ি নিয়ে। স্ত্রী হরিতুন প্রতিদিন এ কাজে সাহায্য করে। কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বাসি ঘর-দুয়ার ঝাড়– দিয়ে উনুনে আগুন ধরিয়ে ডিম সিদ্ধ বসায়। এক ঝুড়ি হাঁস ও মুরগির ডিম সিদ্ধ করে গরম গরম ঝুড়িতে সাজিয়ে লবণ আর লঙ্কার গুঁড়া বোতল ভর্তি করে সাথে টুকরো করা খবরের কাগজ । তারপর স্বামীর খাবার তৈরি।
রহিসউদ্দিন সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে ফিরে রাত ৮টার ট্রেন স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর। তার ছেলে অন্তু তখন থাকে ঘুমিয়ে। ছেলের সাথে খুব একটা দেখা হয় না। খেতে বসে ছেলের কথা মনে পড়ে। রহিস ডাকে- অন্তুর-মা। হরিতুন ভাঁজা শুকনো লঙ্কা পাটায় পিষতে পিষতে ঝাঁঝালো স্বরে বলে, ‘আমার নাম নাই? সে নামে ডাকন যায় না?’ রহিসের কণ্ঠে মিনতি, হরিতুন, তুমিই তো এহন আমার অন্তুর মা।
‘তোমার এমন দস্যু পোলার মা হওনের আমার কোনো সাধ নাই।’
‘কি কও হরিতুন। অন্তুর মা মরে যাওয়ার পর তোমারেই তার মার দায়িত্ব দেয়ার জন্য ঘরে আনছি। তুমিই তো ওর মা। ও একটু দুরন্ত, তুমি রাগ কইরো না। ছেলে মানুষ, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ওকে একটু শিক্ষা দীক্ষা দিও।’ রহিস স্ত্রীকে বোঝায়।
‘তোমার এমন বদ পোলারে শিক্ষা দেয়ার ক্ষেমতা আমার নাই।’
হরিতুন কিছুতেই স্বামীর প্রথম পক্ষের মৃত স্ত্রীর সন্তান অন্তুকে মেনে নিতে পারে না। চিরাচরিত সৎমায়ের ভূমিকায় হরিতুন জাজ্বল্যমান। বয়সেও হরিতুন রহিসের তুলনায় বেশ ছোট। সেটি রহিস হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সে বউকে খুশি করার জন্য স্টেশন থেকে চুড়ি-ফিতা কিনে প্রায়ই উপহার দেয়। তবুও হরিতুনের প্রস্তরকঠিন মন অন্তুর প্রতি প্রসন্ন হয় না। সাত-আট বছর বয়সের অন্তু বুঝতে পারে তাকে নতুন মা সহ্য করতে পারে না। ওর কারণে প্রায়ই নতুন মার সাথে বাবার ঝগড়া বাধে। তাই তো সে পারতপক্ষে নতুন মায়ের চোখের সামনে আসতে চায় না। সারা দিন বাইরে বাইরে খেলাধুলা করে কাটায়। তার একমাত্র খেলার সাথী গোলাকার লোহার রিঙের চাটকি, যেটা একটা লম্বা চিকন সামনে বাঁকানো রডের হাতল দিয়ে ঢেলা দিলে সামনে গড়গড়িয়ে চাকার মতো এগিয়ে চলে। চাটকি নিয়ে কখনো দৌড়ে কখনো হেঁটে হেঁটে দূর থেকে বহুদূরে চলে যায় একাকী মাঠ ঘাট প্রান্তর পেরিয়ে। ইচ্ছে হয় সারাদিন এভাবে থাকতে, শুধু ক্ষুধায় পেট চ্যাপটা হয়ে আসলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ি ফিরতে হয়। রাতে ঘরে না ফিরে উপায় নেই, যাবে কোথায়। উঠতে বসতে তার দোষ খুঁজে সৎমা। প্রতিদিন বকুনি খাওয়া তার বাঁধা রুটিন। দেরিতে ঘরে ফিরলে সৎমা বাবাকে নালিশ দেয়। স্ত্রীর নালিশে অসহ্য হয়ে রহিস মা-মরা অন্তুর গায়ে বেশ কয়েকবার হাতও তুলেছে। বাড়িতে অন্তু সদা ভয়ে-সংশয়ে নতুন মায়ের কাছে খাবার চাইতে পারে না।
সকালে ঘুমের মধ্যে অন্তু শুনতে পায় তার বাবা আর মায়ের কথোপকথনে তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। তড়িঘড়ি করে ওঠে পড়ে। এখুনি বুঝি আবার ঝগড়া শুরু করে দেবে। ঝগড়া শেষে বাবা বাড়ির বাইরে চলে গেলে ওমনি সৎমা সেই শোধ নিতে তার উপর চড়াও হয়ে আসবে। সেই আশঙ্কায় আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে যায় তার প্রিয় চাটকিটা সাথে নিয়ে।
রহিস খেতে বসে জিজ্ঞেস করে, অন্তু ঘরে নাই ?
নাহ।
কই গেছে?
কি জানি।
স্কুল গেছে?
তোমার গুণধর পুত্র কি স্কুলে যাওনের? দেখ চাটকি নিয়ে কোন মুল্লুকে গেছে দৌড়াতে।
কিছু খাইছে? হরিতুন কোনো উত্তর দেয় না কারণ প্রায় দিনই অন্তু না খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। বাড়ি ফিরলেও তাকে ডেকে খাবার দেয়ার মানুষ হরিতুন নয়।
অন্তু ঘর থেকে বের হয়ে লাঠির ডগায় ঘূর্ণায়মান চাটকি ধরে হাঁটতে থাকে। মাঠের আল পেরিয়ে ইট বিছানো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে একটি ট্রেন রেলস্টেশনের দিকে এগিয়ে আসছে। সেও রেললাইনের পাশাপাশি পথ ধরে ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে চাটকি নিয়ে দৌড়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ট্রেনের চাকার গতি আর তার চাটকির চাকার গতি প্রায় কাছাকাছি। প্রায় একই সময়ে সে আর ট্রেন এসে পৌঁছল রেলস্টেশনে। অন্তু চাটকি থামিয়ে দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখতে থাকে। থামা মাত্রই স্টেশনটা কেমন চাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে। হইহুল্লোড়, চিৎকার, ডাকাডাকি, যাত্রীরা দ্রুত ওঠানামা করছে। কেউ কেউ জানালার ধারে সিটে বসার জন্য আগেভাগে বসে পড়ছে। সে দেখতে পেলো ট্রেনের ভেতর বসা তার বয়সী একটি সুন্দর ছেলেকে। বেশ ফিটফাট শহুরে পোশাকে। জানালার পাশে বসে ছেলেটি বাইরের স্টেশনের লোকসমাগম, কুলিদের যাত্রীব্যাগ ধরে টানাটানি, হরেক রকম ফেলিওয়ালার সব দৃশ্যই কৌতূহলবশে দেখছে। ছেলেটির পাশে বসে তার মা হাতের পেপার দিয়ে তাকে বাতাস করছে মাঝে মধ্যে। অন্তু তার দিকেও তাকিয়ে রয় খানিকক্ষণ।
‘এই ডিম, সিদ্ধ ডিম...।’ অদ্ভুত আওয়াজে গলার গামছার সাথে বাঁধা ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্টেশনে রহিসউদ্দিন। সেই ছেলেটির জানালার সামনে গিয়ে রহিস দাঁড়ায়।
‘ডিম গরম ডিম, খাবে বাবু ?’ ছেলেটি মৃদু মাথা নাড়িয়ে না সূচক ভঙ্গি করে। দূর থেকে তার বাবাকে দেখে নিজেকে আড়াল করে। তবুও তার মুগ্ধদৃষ্টি সেই ছোট ছেলেটির দিকে। বালকটি দেখতে কেমন সুশ্রী! তার গায়ের জামাটাও সুন্দর। কেমন পরিপাটি করে মাথার চুলে সিঁথি কাটা। অন্তু নিজের অজান্তে তার উষ্কখুষ্ক মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো গুছিয়ে নেয়।
ছেলেটির মা দুটো সিদ্ধ ডিম কিনল। ভদ্রমহিলা সাথে কাগজে লবণ-লঙ্কাগুঁড়ো নিতে ভুল করলেন না। খোসা ছাড়িয়ে সন্তানের মুখে তুলে ধরলে সে মুখ ফিরিয়ে খাবার অনীহা প্রকাশ করছে। কয়েকবার সাধাসাধি করে মা বলেন, খাও বাবা, পরে খিদে পাবে। সকাল থেকে কিছুই মুখে দিচ্ছ না।’
ছেলেটি এক কামড় দিয়ে বলে , ‘আর খাব না’। মা তাকে খাওয়ানোর জন্য সেধেই যাচ্ছেন।
এখন অন্তুর পেটে অনন্তক্ষুধা। সেই কখন বাড়ি থেকে বের হয়েছে। এরই মধ্যে চাটকি নিয়ে খেলতে খেলতে স্টেশনের কাছে আসতে প্রায় মাইল খানেক পথ অতিক্রম করে ফেলেছে। ভাবছে, ছেলেটা কি বোকা! ওমন ১০টা ডিম সে এখন একসাথেই খেতে পারবে। হয়তো বাবার পুরো ঝুড়ির ডিম এখন সে খেতে পারবে। যদি তার মা থাকত বুঝি এমনি গরমে বাতাস করত, আদর করে মুখে তুলে খাওয়াত।
জানালার কাছ দিয়ে চানাচুর, ঝালমুড়ি, বাদাম, বুট, ছোলা ভাজা, আইসক্রিম ইত্যাদি নানা স্বরে নানা ভঙ্গিতে হাঁক দিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা ছেলেটিকে দেখে তাদের এই ঘনঘন আসা যাওয়া। ইস । যদি অন্তুর কাছে পয়সা থাকত তাহলে এ মুহূর্তে সবই কিনে খেতে পারত।
ট্রেনটা চলে গেল। রহিসউদ্দিনও ট্রেনে চড়ে বসেছে। এই ট্রেন ধরে ডিম বিক্রি করতে করতে এই লাইনের কোনো এক স্টেশনে নেমে পড়বে, আবার ফিরতি ট্রেনে চড়ে রাতে বাড়ি ফিরবে সে। প্রতিদিন সব ডিম যে বিক্রি হয়ে যায় তা নয়, সেগুলো আবার গরম করে পরের দিন বিক্রির ঝুড়িতে ভরে নেয়। সেদিন হরিতুন ডিম সিদ্ধ করতে গিয়ে তিনটি ডিম ফেটে খোসা থেকে সাদা ভেতরের অংশ বের হয়ে গিয়েছিল। রহিস বউয়ের ওপর ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিল। অন্তু মনে মনে খুশি হয়েছিল এই ভেবে যে, ফাটা ডিমগুলোর একটা অন্তত আজ তার পাতে পড়বে। কিন্তু তা হয়নি।
রহিস একটু কম মূল্যে চটপটি বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্তুর পাতে জুটেছে শুধু আলুভর্তা।
স্টেশন থেকে পড়ন্ত দুপুরে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরেছে অন্তু। পেটে বড্ড ক্ষিদে। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। হরিতুন কিছুতেই খাবার দিচ্ছে না। রান্নাঘরের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। তবুও ভয়ে মুখ ফুটে ভাত চাইছে না। সৎমায়ের কাছে ভালো ছেলে সাজার জন্য গোছল সেরে আসে। তবুও হরিতুনের খাবার দেয়ার কোনো লক্ষণ নেই। একসময় সইতে না পেরে সঙ্কোচ ভেঙে সে নিজে বলে, ক্ষিদে পাইছে মা।’
অমনি হরিতুন চেঁচিয়ে ওঠে’, ক্ষিদে লাগছে সিধে হয়ে বসে থাক। আমার কামকাজ শেষ হইলে খাবার পাবি। আর শোন, খবরদার আমারে মা বলবি না। এত বড় ডাঙ্গর ছেলের মুখে মা ডাক আমার ভাল্লাগে না।’
একটি থালায় ভাত এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই নে খা। কিন্তু খাওয়ার পর এই কাগজগুলো কাইটে সুন্দার করে ভাঁজ করে ঠোঙায় ভরে রাখবি কলাম।’ এক গাদা খবরের কাগজ তার সামনে হরিতুন দিয়ে চলে গেল। ক্ষুধার্ত অন্তু গোগ্রাসে খাবারগুলো আগে খেয়ে ফেলে। এরপর কয়েকটি কাগজ নিয়ে ভাঁজ করে কাটে কিন্তু তার এখন ঘুম পা”েচ্ছ। বড্ড ঘুম। বহু পথ হেঁটেছে, ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে।
‘ওরে হারামজাদা। ভাত গিলেই ঘুমাচ্ছিস। দাঁড়া তোকে ঘুম পাড়াচ্ছি।’ হঠাৎ ধেয়ে আসা হরিতুনের বীভৎস চিৎকারে ঘুম ভাঙে অন্তুর। ওমনি তড়িঘড়ি করে উঠে দৌড়ে বাড়ি থেকে পালায় কিন্তু যাওয়ার সময় চট করে চাটকি সাথে নিতে ভুল করে না।
চাটকি গড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার স্টেশনের পাশ দিয়ে রেললাইনের পথে। কাদামাটি, ধুলাবালি, স্টেশনের থুথু, কাশি, চুইংগামের আঠা গায়ে জড়িয়ে তার হাতের চাটকি গড়িয়ে চলে। এই গোলাকার চাটকিই একমাত্র পথচলার সাথী, সুখে দুঃখে পরম বন্ধু। চাটকি এগিয়ে চলে গোলাকার পৃথিবীর সামনের দিকে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে কিন্তু তার মনে বাড়ি ফেরার ভয়! সৎমায়ের আদেশ পালনে ব্যর্থ হওয়ার ভয়! মায়ের নালিশে বাবার পিটুনির ভয়! আবার সন্ধ্যার পর অন্ধকারের ভয়! নানান রঙের ভয় ভিড় করছে চারপাশে। মন চাইছে না বাড়ি যেতে। এত বড় পৃথিবীতে তার এতটুকু নিরাপদ স্থান কোথায়! অবশেষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ির পথে পা বাড়ায়। ফেরার পথে বাড়ির পাশের গাছতলায় বসে খানিকটা সময় কাটায়। প্রিয় চাটকি পরিষ্কার করতে গিয়ে সে দেখে চাটকির সাথে চুইংগামের আঠা। আঠার সাথে একটি ভাঁজ খাওয়া কাগজ লেগে আছে। সে কাগজটা খুলে ফেলতে গিয়ে দেখে এটি কাগজ নয়, টাকার নোট। কাগজটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখে। সত্যিই তো! এক হাজার টাকার নোট! এবার নোটটির ধুলো ঝেড়ে পকেটে নিলো। চুপ করে ঘরে ফিরে বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে।
মনের মধ্যে এত খুশি এত আনন্দ! রাতে টাকার ভাবনায় ঘুম আসছে না। ক্ষিদে পাচ্ছে না। এতগুলো টাকা! তা দিয়ে কি করবে সে? এতগুলো টাকার একমাত্র মালিক এখন সে! মালিকই তো। সে ভাবনাতে কোনো দোষ নেই। কারণ টাকাটা তার ভাগ্যেই জুটেছে। ইচ্ছা করলেও আসল মালিককে সে ফিরিয়ে দিতে পারছে না। সে তো চুরি করেনি যে দোষের টাকা হবে। সে ভিক্ষাও করেনি যে অপমানবোধ করবে। কিছুতেই কুল কিনারা ভেবে পাচ্ছে না এই টাকাটা কিভাবে সে ব্যয় করবে? বারবার প্যান্টের পকেটে সাবধানে হাত দিয়ে দেখে টাকাটা এখনো তার কাছে আছে কি না।
উল্লসিত মনে ভাবছে সকালে উঠে তার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস কিনবে। কিন্তু কোন জিনিসটা তার সবচেয়ে পছন্দের? অনেক অনেক কিছুই তার পছন্দের। মুহূর্তেই তার সারা জীবনের সব সাধ-আহলাদ একত্রে এসে জমা বাধল। সে প্রথমে শহরে যাবে, ট্রেনে বসে থাকা সেই বালকটির মতো সুন্দর একটি জামা কিনবে। নিজের মনের আয়নায় নিজেকে পরিপাটি সিঁথিকাটা সুন্দর শহরের ছেলের রূপে দেখতে পেয়ে মনে মনে লজ্জা পেল যেন।
আবার ভাবে বাজারে গিয়ে মানিক কাকার দোকানের সবগুলো চকোলেট কিনে এনে সারা দিন শুধু চকোলেট খাবে। আবার মত পাল্টিয়ে ভাবে- স্টেশনের পাশে সগির চাচার দোকানে লম্বা মালার মতো ঝুলিয়ে রাখা দোকানের সব চিপস কিনে এনে ঘর ভর্তি করবে আর খাবে। আবার ভাবে- আইসক্রিমওয়ালার পুরো আইসক্রিমের বাক্সটা কিনে একা একা খাবে। সারা রাত ধরে নানান পরিকল্পনা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে তার বাবা রহিস বাজার থেকে এক ঝুড়ি ডিম কিনে কখন বাড়ি ফিরেছে অন্তুর জানা নেই। সকালে অন্তুর ঘুম ভাঙে হরিতুনের বিকট চিৎকারে।
‘হায়! হায়! হায়! আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে রে! এ কি হলো!’
কান্নামিশ্রিত হরিতুনের চিৎকারে অন্তু ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে ওঠে। সন্তর্পণে গিয়ে দেখে হরিতুন চুলোয় আগুন জ্বালিয়েছে মাত্র ডিম সিদ্ধ দেয়ার জন্য। পাশে উঠোনে কাঁচা ডিমের ঝুড়ি উল্টিয়ে দিয়েছে বিড়াল আর কুকুরে মারামারি করে। সব ডিম ভেঙে গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হরিতুন ভাঙা ডিমগুলো তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুই আর অবশিষ্ট নেই যা নিয়ে আজকে ডিম বিক্রি করতে পারবে। এদিকে রহিস বাড়ি নেই, গেছে পাশের বাড়ির পুকুরে গোছল করতে। বাড়ি এলে কি যে করবে আজ হরিতুনকে। চিন্তায় ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপছে। এতগুলো ডিম যে নষ্ট হয়ে গেল। ডিম বিক্রির টাকা থেকে রোজ রাতে বাজার করে আনে রহিস, যা দিয়ে প্রতিদিনের সংসার চলে। কি হবে এখন? হরিতুন কিছুই চিন্তা করতে পারছে না।
বিমর্ষ হরিতুনের এ অবস্থা দেখে মুহূর্তেই অন্তুর মাথায় কি যেন খেলা করল! সে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। হরিতুন নিজেকে আর রাখতে পারছে না। চুলায় পানি ফুটছে টগবগিয়ে। তার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর অন্তু বাড়ি ফিরে এলো এক ঝুড়ি ডিম নিয়ে। মাথায় হাত তুলে ক্রন্দনরত হরিতুনের পাশে আস্তে করে রেখে ঘরের ভেতর গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। হরিতুন হঠাৎ পাশ ফিরে দেখে নতুন এক ঝুড়ি ভর্তি ডিম। সে অবাক! কি করে সম্ভব? পেছনে তাকিয়ে দেখে অন্তু দরজার পাশ ধরে দাঁড়িয়ে কেমন মিষ্টি চাহনিতে চেয়ে আছে তার দিকে। হরিতুন বুঝতে পারে কাণ্ডটা তারই। কিন্তু এতগুলো ডিম কোথা থেকে নিয়ে এলো! টাকা সে কোথায় পেলো! বুঝি হরিতুনের গোপনে জমানো টাকার সন্ধান এই দুরন্ত ছেলে পেয়েছে। সেখান থেকে কি নিয়েছে? রেগে ছুটে যায় অন্তুর কাছে।
কোথায় পাইলি এতগুলো ডিম?
দোকান থেকে।
চুরি করে আনছস?
না আমি কিনছি।
টাকা পাইলি কই? চুরি করসছ? কষে এক থাপ্পড় অন্তুর গালে বসিয়ে দেয়।
না না, আমি চুরি করিনি। বিশ্বাস করো আমি চোর না। কাঁদতে কাঁদতে বলে।
তাইলে এতগুলা ডিম আনলি কিভাবে বল? কার টাকা চুরি করসছ? অন্তু গতকালের সব ঘটনা খুলে বলে, এ ডিমগুলো এহন কিনে না আনলে আব্বায় যে বাড়ি আইসা তোমারে মারব। শুনে হরিতুন অবাক! যে ছেলেটির সাথে এতদিন সে দুশমনের মতো ব্যবহার করেছে। সেই তার বিপদে কেমনে পাশে দাঁড়ায়! হরিতুন বলে তোরে আমি বুঝতে পারি নাই রে। তুই তো একটি পোলা নারে, তুই তো আস্ত একটি সোনার টুকরো।
অন্তু এবার নির্ভয়ে বলে, আমি তো সোনার টুকরো হতে চাই না। শুধু তোমার ছেলে হতে চাই। তোমাকে মা বলে ডাকতে চাই। বলো তুমিই আমার মা।
হরিতুন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। অন্তুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে, কান্নামিশ্রিত স্বরে বলে- হ হ আমিই তোর মা। এ দৃশ্য দেখে অদূরে দাঁড়ানো রহিসউদ্দিনের চোখ পানিতে ঝাঁপসা হয়ে ওঠে ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা