১৭ জুন ২০২৪
`

তালতলা লেনের বাড়ি ও বিদ্রোহী কবিতা

-

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর তার কবি খ্যাতি পুরো বাংলায় খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কবিতাটি তিনি রচনা করেন ৩/৪ সি তালতলা লেন, কলকাতায় দ্বিতল ভবনের নিচতলার একটি ছোট কক্ষে। তালতলা থানা, ইতিহাসখ্যাত আলিয়া মাদরাসা, বেকার হোস্টেল, মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ও ইসলামিয়া কলেজের খুবই কাছে এই বাড়ি। ১৫ বছর আগে এই বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। পাশেই সাপ্তাহিক নতুন গতির অফিস। আমার সাথে ছিলেন নূর জামাল নামক এক বন্ধু, যার নিবাস কলকাতা। দিনটি ছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার পবিত্র জুমাবার। ধর্মতলায় ঐতিহাসিক টিপু সুলতান শাহী মসজিদে নামাজ আদায় করে রওনা হই। সঙ্গী বন্ধু-সাংবাদিক নূর। প্রশস্ত গলিপথ ধরে আমরা এগোতে থাকি। সুপ্রশস্ত আঙিনায় এসে আমরা দাঁড়াই। বেশ ক’টি চার-পাঁচতলা বাড়ি, শতবর্ষের প্রাচীন-কোনো কোনোটি বেশ জরাজীর্ণ। প্রবশমুখে বাঁ দিকের বাড়ির দেয়াল ঘেঁষা একটি নামফলক। ১৯৯৯ সালের ২৪ এপ্রিল তালতলা নজরুল জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি কর্তৃক স্থাপিত এই প্রস্তরফলকে লেখা হয়েছে- ‘চির যৌবনের প্রতীক কবি নজরুল ইসলাম তার জঙ্গম জীবনের কিছুকাল (১৯২১-২২ খ্রি.) অতিবাহিত করেন এই প্রাঙ্গণের ভেতর, ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িতে। এখানেই রচিত হয় তার বাঁধনহারা কবিমনের প্রথম উদ্দাম উচ্ছ্বাস ‘বিদ্রোহী’ কবিতা।

এ স্থান থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরেই একটি ছোট্ট দ্বিতল বাড়ি। তারই নিচতলার এক কক্ষে সারা রাত জেগে কবি নজরুল রচনা করেন অসংখ্য জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কবিতার একটি ‘বিদ্রোহী’। কক্ষটি বর্তমানে তালাবদ্ধ, চাবি কোথায় বা কার কাছে রয়েছে তা প্রতিবেশীদের কেউ জানাতে পারেনি। ১৯২১ সালের জুলাইয়ের শেষ বা আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বাড়িটি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয়। এই বাড়িতে সে সময়ে ভাড়াটিয়া হয়ে ওঠেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের সন্দ্বীপ নিবাসী কমরেড মুজফফর আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩ খ্রি.)। তার সাথে এসে বসবাস শুরু করেন সদ্য ব্রিটিশ বাঙালি পল্টন ফেরত হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম। তাদের পরিচয় খুব দীর্ঘ দিনের না হলেও সহসাই দু’জন ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। মুজফফরের সাথে পরিচয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি ও চিঠি যোগাযোগের মাধ্যমে। পরবর্তী কয়েক মাসে আরো কয়েক স্থানে থাকার জায়গা বদলান তারা। মার্কুইসলেন, ৬ টার্নার স্ট্রিট (নবাব আবদুর রহমান স্ট্রিট), দৈনিক নবযুগ পত্রিকা অফিসও। একই রোডে ৮/১ নম্বর বাড়িতে ভাড়া থাকেন তারা। এসব বাড়িতে বসে নজরুল রচনা করেন তার বহু বিখ্যাত রচনা। চারটি কক্ষ নিয়ে ছোট্ট বাড়ি, ওপর-নিচ মিলিয়ে চারটি কক্ষ। পুরো বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন কুমিল্লার (তৎকালীন ত্রিপুরা) লাকসামের পশ্চিমগাঁও নিবাসী নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর দৌহিত্ররা। মুজফফর আহমদ প্রথমে নিচতলার দুটো কক্ষ ভাড়া নেন, কিছুদিন পর একটি কক্ষ ছেড়ে দিতে হয়। নিচতলার পূর্ব দিকের কক্ষে কমরেড মুজফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলাম থাকতেন। নজরুল ততদিনে কবি খ্যাতি পেতে শুরু করেছেন। তার কক্ষে কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের আনাগোনা ও আড্ডা শুরু হয়। কবি মোহিত লাল মজুমদার, নলিনীকান্ত সরকার, সাংবাদিক আফজালুল হক, শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হকের পুত্র ও মোসলেম ভারত পত্রিকার পরিচালক, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যসহ অনেকেই আসতেন।

১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ; খ্রিষ্টানদের বড়দিনের ছুটি চলছে। কোনো এক রাতে মুজফফর আহমদ ঘুমিয়েছিলেন। সে রাতে কবি নজর নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেন। সকালে মুজফফর ঘুম থেকে উঠলে নজরুল তাকে জানান যে, তিনি রাতে একটি কবিতা লিখেছেন।
নজরুল সাথে সাথে মুজফফরকে কবিতাটি পড়ে শোনান। কবিতাটি ছিল পেন্সিলে লেখা। মুজফফরকে বিদ্রোহী আবৃত্তি করে শোনাবার কিছুক্ষণ পর কক্ষে প্রবেশ করেন বিখ্যাত ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার পরিচালক ও নির্বাহী সম্পাদক কবি বন্ধু আফজালুল হক। তিনি কুমিল্লা নিবাসী কংগ্রেস নেতা ও (পরবর্তীকালে মন্ত্রী) মৌলভি আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর সাথে যৌথভাবে ৩ নং কলেজ স্কোয়ারে মোসলেম পাবলিশিং হাউজের মালিক ছিলেন। নজরুল ইসলাম হক সাহেবকেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ে শোনান। পড়া শেষ হলে আফজালুল হক হইচই করে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেন। বললেন, ‘এখনই এর একটি কপি করে দিন। আমি সাথে নিয়ে যাবো।’ নজরুল সাথে সাথে পেন্সিল দিয়ে মূল কপি দেখে আরেকটি কপি লিখে হক সাহেবকে দেন। তিনি চলে যাওয়ার পর ঘরে এসে ঢোকেন প্রখ্যাত সাংবাদিক অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য। কাজী নজরুল ইসলাম সদ্য রচিত কবিতাটি তাকে পড়ে শোনান। অবিনাশ বাবু ছিলেন বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত এবং প্রখ্যাত বিপ্লবী বারীন ঘোষের সাথে বোমা মামলার আসামি। তিনি নজরুলের মুখে বিদ্রোহী কবিতা শুনে খুব উল্লসিত হন এবং অনুরোধ করে পেন্সিলে এর একটি কপি নজরুলকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে যান। বলে যান, কবিতাটি শিগগিরই সেকালের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় ছাপাবেন। মুজফফর আহমদ এ প্রসঙ্গে তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথায়’ লিখেছেন ‘পরম ধৈর্যের সহিত কবিতাটি কপি করে নজরুল তা আফজাল সাহেবকে দিলো। তিনি এই কপিটি নিয়ে চলে গেলেন।’
১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ শুক্রবার কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম এবং পরবর্তী সময়ে মোসলেম ভারত পত্রিকাসহ প্রবাসী (মাঘ, ১৩২৮), সাধনা বৈশাখ ১৩২৯), দৈনিক বসুমতি ও ধূমকেতু প্রভৃতি পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়। এই বিষয়ে বিদ্রোহী কবিতার প্রথম শ্রোতা ও কলকাতায় নজরুলের একান্ত সুহৃদ কমরেড মুজফফর আহমদের জোরালো যুক্তি ও দাবি- (১৩২৮ বঙ্গাব্দ তারিখে, শুক্রবার) ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি (মুতাবিক ২২ পৌষ) বিদ্রোহী বিজলীতেই প্রথম ছাপা হয়েছিল। বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও কাগজের চাহিদা এত বেশি হয়েছিল যে, শুনেছিলাম সেই সপ্তাহের কাগজ দু’বার ছাপা হয়েছিল। অনেকে যে লিখেছেন ‘বিদ্রোহী’ মোসলেম ভারতে প্রথম ছাপা হয়েছিল সেটি ভুল। আফজাল সাহেব কার্তিকের ‘মোসলেম ভারতের’ জন্য যখন কপি নিয়ে গিয়েছিলেন তখন পৌষ মাস ছিল। আমার ধারণা তাঁর কার্তিক সংখ্যা ফাল্গুন মাসের আগে বের হয়নি। মোসলেম ভারত নিয়মিত বের হতো কি না সেটি আজ যারা নজরুল সম্বন্ধে লিখছেন তারা কী করে বুঝবেন? তারা দেখতে পাচ্ছেন কার্তিক (১৩২৮) মাসের মোসলেম ভারতে ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হয়েছিল, আর ছাপা হয়েছিল ২২ পৌষের (১৩২৮) বিজলীতে। কাজেই তাদের পক্ষে এটিই ধরে নেয়া হিসাবসঙ্গত যে, মোসলেম ভারতেই বিদ্রোহী প্রথম ছাপা হয়েছিল। আসলে কিন্তু পৌষ মাসের (ডিসেম্বর ১৯২১ মাসের শেষ সপ্তাহের) আগে নজরুল ইসলাম তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনাই করেননি। কাজেই ‘বিদ্রোহী’ প্রথম ছাপানোর সম্মান সাপ্তাহিক বিজলীরই প্রাপ্য। যাই হোক ১৪১ পঙ্ক্তির ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর এর পক্ষে ও বিপক্ষে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাংলার পাঠক সমাজে হইচই পড়ে যায়। মুজফফর আহমদ লিখেছেন ‘বিজলী’ পত্রিকা দুবারে মিলিয়ে ২৯ হাজার কপি ছাপা হয়।

অগ্রহায়ণ ১৩২৮ মোসলেম ভারত সংখ্যায় শৈলেন্দ্র কুমার মল্লিক ‘বিদ্রোহী বীর’ শীর্ষক সুদীর্ঘ এক কবিতায় কাজী নজরুল ইসলামকে অভিনন্দিত করেন। বিদ্রোহী প্রকাশের পর ধূমকেতু, প্রবাসী, সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি, কল্লোল, সওগাত, ইসলাম দর্শন প্রভৃতি পত্রিকায় বিভিন্ন লেখক-সাহিত্যিকের আলোচনা-সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশিত হয়। এসবে নজরুলকে যেমন প্রশংসা করা হয়, তেমনি বিদ্রƒপও কম করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহী প্রকাশিত হওয়ার পর নজরুল সুতীব্র আগুনের স্ফুলিঙ্গ সর্বত্র ছড়িয়ে দিলেন। সাংবাদিক অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন, কবি নজরুল ইসলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি গিয়ে কবিতাটি শোনাবার পর নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
রবীন্দ্রবলয়ের সাহিত্যামোদী ব্যক্তিত্বরা নজরুলের নতুন সৃষ্টির বৈচিত্র্য বিস্ময়ে অভিভূত হন। বিদ্রোহী কবিতার সূতিকাগার হিসেবে ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়ি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ স্মারক হিসেবে চিহ্নিত। পশ্চিম বাংলার বাংলাভাষী ও সাহিত্যামোদী মানুষ প্রায় ৯০ বছর ধরে বাড়িটি মর্যাদার সাথে রক্ষা করে একটি স্মারক ফলক স্থাপন করেছে , যা বর্তমানে তীর্থস্থানস্বরূপ। বাড়িটি বিশেষভাবে সংরক্ষণযোগ্য। যুগ যুগ ধরে তালাবদ্ধ না রেখে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে সেখানে নজরুল স্মৃতি মিউজিয়াম স্থাপন করা যেতে পারে। নজরুল-সম্পর্কিত লেখালেখি, নজরুল রচনাবলি-হস্তলিপি, নজরুলের ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী, নজরুল বিষয়ক গবেষণাপত্র, ছবি এবং স্মৃতি নিদর্শনসমূহ এখানে সংরক্ষণ করা যায়। শতবর্ষ প্রাচীন দ্বিতল বাড়িটি সংস্কারাভাবে জরাজীর্ণ, এর সংস্কার করা খুবই জরুরি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশ সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িসহ অন্যান্য বাড়ি সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে, যেসব বাড়িতে বসে নজরুল ইসলাম তার বিখ্যাত বহু কবিতা রচনা করেন ও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। সূচনা করেন রবিবলয়ের বাইরে বাংলা সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র ধারা।


আরো সংবাদ



premium cement