১৭ জুন ২০২৪
`
ড. রহমান হাবিবের অন্তরঙ্গ আয়োজন

নজরুল নন্দনতত্ত্ব পুনর্গঠন ও সূত্রায়ণ

-

অনুসন্ধান-পিপাসু ড. রহমান হাবিবের নজরুল নন্দনতত্ত্ব পুনর্গঠন ও সূত্রায়ণ নামাঙ্কিত বইয়ের অন্দরমহলে প্রবেশ করে যা অনুভূত হয়েছে, তা পাঠকসাধারণের কাছে তুলে ধরতে অনন্য স্বতন্ত্র নজরুলের দ্বারেই কড়া নাড়তে হলো। আর, বিমূর্ত সাক্ষাতে তার এক রসোত্তীর্ণ গীতি কবিতার অংশবিশেষ তিনি পরম ¯েœহে আমার মানস-করে তুলে দিলেন।
‘সেই পুরাতন চাঁদ
আমার চোখে আজ
নূতন লাগে।’
আকাশ-নিবাসী চাঁদের মতোই সৃজনাকাশে চিরজাগ্রত নজরুলও পুরাতন। কিন্তু, যে পুরাতনের অবয়বে অমূল্য মণি-মানিক্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, কলম-তুলির সশ্রদ্ধ আঁচড়ে তাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে সুলেখক ড. রহমান হাবিব বাংলা সাহিত্যের বর্ণিল পুষ্প-মালঞ্চের মালাকরদের একজন হয়ে উঠলেন। এই হয়ে ওঠাটা কম কথা নয়।
নজরুল-ভক্ত আমরা অনেকেই। কিন্তু নজরুল -গবেষণায় নিমজ্জিত হয়ে এ পর্যন্ত ভক্তি নিবেদনের অর্থপূর্ণ আয়োজন যারা করেছেন, ড. রহমান হাবিব সেই বিশেষ দু-চারজনের একজন হতে পেরেছেন। কারণ, শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে একাধিক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব নজরুলের গুরুত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় নজরুলকে বিষয় করে রচনা করেছেন উপভোগ্য পঙক্তিমালা।
‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হ’য়ে গেছে
ভাগ হয়নি কো নজরুল।
এই ভুলটুকু বেঁচে থাক...’
আবার, বাংলা সাহিত্যের ‘প্রগতি’ ও ‘কল্লোল’ যুগের কর্ষিতচিত্ত সাহিত্যশিল্পী বুদ্ধদেব বসু নজরুল সম্পর্কে বলেছেন-‘প্রাজ্ঞদেরও মানতে হয়েছিল যে লোকটার (নজরুলের) মধ্যে কিছু আছে। ...নিশি ভোর হলো জাগিয়া পরান-প্রিয়া গানটি রচনা করতে আমি তাকে দেখেছিলাম-- দৃশ্যটি আমার দেবভোগ্য বলে মনে হয়েছিল।’ [আত্ম জৈবনিক : বুদ্ধদেব বসু/প্রকাশনা-বাতিঘর, বাংলাদেশ]
নজরুলের কৈশোর ও তারুণ্য থেকে শুরু করে তার অসুস্থতার পূর্ব পর্যন্ত (১৯৪২, ৯ জুলাই) তার রচনা-দৃষ্টিভঙ্গি হাবিবের লেখায় আলোচিত হয়েছে। নজরুলের নিজস্ব তথ্য-ভাষ্যের মধ্যে যে নন্দনতাত্ত্বিক উপাদানগুলো ছড়ানো-ছিটানো আছে, সেগুলো সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে হাবিব তার বইয়ের নজরুল নন্দনতত্ত্ব ঃ পুনর্গঠন অধ্যায়ে নজরুল নন্দনতত্ত্বের পুনর্গঠন করেছেন। পুনর্গঠন অধ্যায়ের পাঁচটি উপবিভাগ নজরুলের শিল্প-ভাবনার ক্রম-উৎকর্ষের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে। পুনর্গঠিত তথ্য ও বক্তব্যগুলো থেকে তিনি নজরুল নন্দনতত্ত্বের ২৬৩টি স্বতন্ত্র সূত্র বিভিন্ন সালের কালক্রম অনুযায়ী বসিয়েছেন। এভাবে সূত্রায়ণ পদ্ধতিতে তার বইতে নজরুল নন্দনতত্ত্ব ঃ সূত্রায়ণ অধ্যায়টি নির্মিত হয়েছে। তবে, গাণিতিক হিসাব-নিকাশ আর অধ্যায়-শিরোনাম আলোচ্য বইয়ের সবটুকু না। আর এ কারণেই এই বই শুষ্কংকাষ্ঠং Cerebral Writing না হয়ে সংবেদনশীল পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছে।

হাবিব আলোচ্য বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৯৮ নম্বর পৃষ্ঠায় নজরুল তার সাহিত্য-সাধনার অষ্টম বর্ষে (১৯২৬) যে প্রত্যয়ী ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা উদ্ধৃত করেছেন। নজরুল বলে গেছেন : ‘সময়ই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সমালোচক’ । নজরুল-প্রয়াণের পর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু, তার প্রাসঙ্গিকতা আজও হারায়নি। এর কারণ দর্শাতে আমরা পর্যবেক্ষক ড. রহমান হাবিবের কলমী- উচ্চারণের স্বর্ণ-সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারি। বইয়ের ৯৯ নম্বর পৃষ্ঠার শেষাংশে হাবিব বলেছেন : ‘নজরুল বিদ্রোহী কবির চেয়ে (তা তার অস্তিত্বসত্তার মাত্র ১ আনা) অনেক গভীরভাবে শুদ্ধ শিল্পবাদী নান্দনিক কবি। নজরুলের নন্দন-মানস পৃথিবীর যে কোনো মহৎ রোমান্টিক নান্দনিক কবির চেয়েও প্রাতিস্বিক, গভীর, দূরদর্শী ও স্বপ্নময়।’ হাবিবের এই কলমী- ঘোষণায় (pen-declaration) নজরুলের নান্দনিক সূক্ষ¥তা-বিষয়ে যে-যে উন্নাসিক সমালোচক সংশয়গ্রস্ত, তারা ভাবনা-নিমজ্জিত হয়ে পড়বেন। নজরুল-সৃষ্টিসম্ভারে নান্দনিকতার দুর্ভিক্ষ নেই এবং এ কারণেই তিনি সময়রূপ প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিতে পেরেছেন। এটা মনে করিয়ে দিয়ে হাবিব বাংলা সাহিত্যের প্রতি এক সুমহান দায়িত্ব পালন করেছেন।
যারা নজরুল-সৃষ্টিসম্ভারে সমনোযোগ পঠনবিহার না চালিয়ে শর্টকাট রাস্তা বেছে নিয়ে তাকে একবারের জন্যও ‘কবি’না বলে শুধুই ‘বিদ্রোহী কবি’ বলেন, তারা নিঃসন্দেহে এটাই প্রমাণ করেন যে A little learning is a dangerous thing. বিদ্যার আধিক্য- প্রণোদিত সদম্ভ ঘোষণা কিঞ্চিৎ সহনযোগ্য। কিন্তু, দুপাতা অ, আ, ক, খ পড়ে যদি কেউ অজ¯্রপ্রসূ ও বিরল প্রতিভা নজরুলের Rank and Status নির্ধারণ করতে উঠে পড়ে লাগেন, তাহলে ওই অপরাধ নজরুল অন্তর্বীক্ষণে নিমগ্ন নজরুল-অনুরাগীদের পক্ষে ক্ষমা করা আদৌ সহজ না। ড. রহমান হাবিব তার লেখার মাধ্যমে কতিপয় স্বঘোষিত বিদ্বানের মায়ার আবেশ ঠেলা দিয়ে তাড়ানোর শুভকাজটা সুসম্পন্ন করেছেন। ধন্যবাদ, ড. রহমান হাবিব।
১২০ পৃষ্ঠার বই নজরুল নন্দনতত্ত্ব পুনর্গঠন ও সূূত্রায়ণ প্রকাশ করেছে নবযুগ প্রকাশনী। ফেব্রুয়ারি, ২০০৫-এ এর প্রথম প্রকাশ এবং ফেব্রুয়ারি, ২০২২-এ এর পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী মোবারক হোসেন লিটন। দাম ২৫০ টাকা।


আরো সংবাদ



premium cement