১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দানশীলতায় অনন্য নবীজী সা:

-

দানশীলতা মানবজীবনের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। দানশীলতা হৃদয়ের বিশালতার অনন্য দলিল। মানবজাতির সফলতার একমাত্র ঠিকানা ইসলামের চমৎকার নির্দেশনাবলির অন্যতম এই দানশীলতা। আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা:কে দয়া ও দানশীলতার অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। কুরআন মাজিদে এ গুণের দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
‘এটা (কুরআন) এক মহানুভব বার্তাবাহকের বাণী। এটা কোনো কবির বাণী নয়, (কিন্তু) তোমরা খুব অল্পই ঈমান আনো।’ (সূরা আলহাক্কা : ৪০-৪১)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নবীজী সা:-এর অন্যান্য মহান গুণের মধ্যে তার মহানুভবতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। কেননা এই মহানুভবতাই অনেক গুণকে ধারণ করে রাখে। দানশীলতা, উদারতা এবং বদান্যতা সেগুলোর অন্যতম।
নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগে থেকেই নবীজী সা: দানশীলতাসহ অনন্য সব মানবিক গুণের ধারক ছিলেন। সীরাতের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে যে, উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজা রা: নবীজী সা:-কে সান্ত¡না দিয়ে বলেছিলেন-‘আল্লাহর কসম! কখনো না। আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং সত্যপথের বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করেন। (বুখারি-৩, মুসলিম-১৬০)
রাসূলুল্লাহ সা:-এর দানশীলতা ছিল ব্যাপক ও সুবিস্তৃত। রহমতের সুশীতল বাতাসকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর দানশীলতার ব্যাপ্তি।
হজরত ইবনে ‘আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রমজানে তিনি আরো অধিক দানশীল হতেন, যখন জিবরাইল আ: তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর রমজানের প্রতি রাতেই জিবরাইল আ: তার সাথে দেখা করতেন এবং তারা একে অপরকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল সা: রহমতের বায়ু অপেক্ষাও অধিক দানশীল ছিলেন। (বুখারি-৬)
রাসূলুল্লাহ সা: নিজে যেমন দানশীলতার সর্বোচ্চ চূড়ায় উপনীত ছিলেন তেমনি সাহাবায়ে কেরামকে দানশীলতার মতো অনন্য গুণে গুণান্বিত হওয়ার নির্দেশনা দিতেন। কারণ দানের মাধ্যমে অন্তর প্রশস্ত হয় এবং ধন-সম্পদে সমৃদ্ধি ঘটে। তাই সাহাবায়ে কেরাম ও অনাগত উম্মতকে দানশীলতার সৌরভে সুরভিত হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন।
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত : নবী সা: বলেছেন, ‘প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন আর অন্যজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন।’ (বুখারি-১৪৪২)
নবীজী সা: তাঁর সারা জীবন যা বিশ্বাস করেছেন এবং বলেছেন, তিনি নিজে শতভাগ তার ওপর আমল করেছেন এবং তাঁর যাপিত জীবনে তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। দানশীলতাও সে সুরভিত দিকগুলোর অন্যতম। নবীজী সা: তাঁর অনুপম আচরণমালার পরতে পরতে দানশীলতার সৌরভ ছড়িয়ে দিয়েছেন।

সাহল বিন সা’দ আস-সাইদি রা: থেকে বর্ণিত- এক মহিলা একখানা চাদরসহ রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার জন্য আমি নিজ হাতে এটা বুনেছি। চাদরের প্রয়োজন অনুভব করে রাসূলুল্লাহ সা: তা গ্রহণ করলেন, এরপর তা লুঙ্গির মতো করে পরিধান করে আমাদের কাছে এলেন। তখন অমুকের ছেলে অমুক এসে বলল, হে রাসূল! চাদরটা কী চমৎকার। এটা আমাকে পরতে দিন। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন আচ্ছা। তিনি বাড়িতে গিয়ে চাদরটি ভাঁজ করে তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। লোকজন তাকে বলল, আল্লাহর শপথ! কাজটা তুমি ভালো করোনি। নবী সা: প্রয়োজন অনুভব করেই তা পরেছিলেন। আর তুমি তাঁর কাছে তা চেয়ে নিলে! অথচ তুমি জানো যে তিনি কোনো প্রার্থীকেই বিমুখ করেন না। সে বলল, আল্লাহর শপথ! আমি এটা পরার জন্য তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নেইনি; বরং আমার কাফন বানানোর জন্য চেয়ে নিয়েছি। হজরত সাহল রা: বলেন, লোকটা যেদিন মারা গেল সেদিন সেটিই তার কাফন হলো। (সুনানে ইবনে মাজাহ-৩৫৫৫)
নবীজী সা: এত সুবিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন যে, কখনো কেউ তাঁর কাছে কিছু চাইলে ‘না’ করতেন না। হজরত জাবের রা: বলেন : রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এমন কোনো জিনিস চাওয়া হয়নি, যার উত্তরে তিনি ‘না’ বলেছেন। (মুসলিম-২৩১১)
রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুপম অভ্যাস এমন ছিল যে, তিনি কারো চাওয়ার আগেই তাঁকে দান করে দিতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ওহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনা হোক আর ঋণ পরিশোধের উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে একটি দিনারও আমার কাছে জমা থাকুক এবং এ অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত হোক, তা আমাকে আনন্দিত করবে না। তবে আমি তা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এভাবে.. এভাবে.. এভাবে বিলিয়ে দেবো। তিনি তাঁর হাত দিয়ে ডান, বাম ও পেছনের দিকে ইশারা করেন। (বুখারি-৬০০০)
হুনাইনের যুদ্ধের সময়ের একটি ঘটনা। এই যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সা: ও তাঁর সাহাবিরা প্রচুর গণিমত অর্জন করেন। হুনাইন থেকে ফেরার পথে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে ছিলেন হজরত জুবাইর ইবনে মুতইম রা:। জুবাইর রা: বলেন- বেদুইন লোকেরা নবীজী সা:-এর কাছে গণিমতের সম্পদ চাইতে আসে। লোকেরা তাঁকে একটি গাছের কাছে নিয়ে গেল এবং গাছে তাঁর চাদর আটকে দিলো। তিনি বললেন : হে লোকেরা! আমার চাদর আমাকে ফিরিয়ে দাও। আল্লাহ্র শপথ! যদি তিহামার (মরু আরবের) গাছের সমসংখ্যক জন্তুও আমার কাছে থাকে, তবে তা আমি তোমাদের মাঝে বণ্টন করে দেবো। তোমরা আমাকে কৃপণ, ভীরু ও মিথ্যাবাদী পাবে না। (সুনানে নাসায়ি-৩৬৮৮)
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখযানুল উলুম, টঙ্গী, গাজীপুর।


আরো সংবাদ



premium cement