১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

হজ এক প্রেমময় ইবাদত

-

ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে হজ তার অন্যতম। হজ আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে এক গভীর প্রেমময় সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। বান্দা ও রবের মধ্যে নিঃশর্ত আনুগত্যের একটি হৃদয়কাড়া ঝলক ফুটে ওঠে হজের মাধ্যমে। কালো গিলাফে ঢাকা বায়তুল্লাহর দিদারে পাগলপারা হয়ে ওঠে প্রতিটি মুমিনের মন। বারবার ছুটে যেতে চায় হৃদয় প্রশান্তির অনন্য ঠিকানা কাবার পানে। বারবার পেতে চায় বায়তুল্লাহর সান্নিধ্য। মাটির পৃথিবীতে আল্লাহর ঘর- ভাবতেই দেহমনে প্রশান্তির এক শীতল পরশ বয়ে যায়।

হজ আরবি শব্দ। শাব্দিক অর্থ সংকল্প করা। শরিয়তের পরিভাষায়- নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতির আলোকে নির্ধারিত সময়ে বায়তুল্লাহ শরিফ জিয়ারত করাকে হজ বলে।

আল্লাহর ঘরে যেতে সামর্থ্য রাখে এমন প্রাপ্তবয়স্ক স্বাধীন মুসলমানের ওপর জীবনে একবার আল্লাহর ঘরে যাওয়া তথা হজ করা অপরিহার্য বিধান। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ শরিফে) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের ওপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ করা ফরজ।’ (সূরা আলে ইমরান-৯৭)

সামর্থ্যরে ব্যাখ্যা হচ্ছে- আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার পাথেয় ও বাহনে সক্ষম হওয়া। (মুসতাদরাক-১৬১৩)
মানুষের ইবাদতের জন্য তৈরি সর্বপ্রথম ঘর হচ্ছে বায়তুল্লাহ শরিফ। মক্কাতুল মুকাররামায় নির্মিত কালো গিলাফে ঢাকা কাবাঘরটিই মুমিনের মর্যাদা বৃদ্ধি ও বরকত লাভের এক অনন্য মাধ্যম। ইরশাদ হয়েছে- ‘বাস্তবতা এই যে, মানুষের (ইবাদতের) জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরি করা হয়, নিশ্চয়ই তা সেটি, যা মক্কায় অবস্থিত, যা বরকতময় এবং সমগ্র জগতের মানুষের জন্য হিদায়াতের উপায়।’ (সূরা আলে ইমরান-৯৬)

মসজিদে হারাম বা বায়তুল্লাহ শরিফ পৃথিবীতে নির্মিত প্রথম মসজিদ। দ্বিতীয় মসজিদ হচ্ছে আল মাসজিদুল আকসা।
ইবরাহিম রহ: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাস্তায় বসে আমার পিতার কাছে কুরআন পাঠ করতাম, যখন আমি সিজদার আয়াত পাঠ করলাম তিনি সিজদা করলেন, তখন আমি বললাম আব্বা! আপনি রাস্তায় সিজদা করছেন! তিনি বললেন, আমি আবু জর রা:-কে বলতে শুনেছি যে, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোন মসজিদটি প্রথম নির্মিত হয়? তিনি বলেছিলেন, মসজিদুল হারাম। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল আকসা। আমি বললাম, এতদুভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত? তিনি বললেন, ৪০ বছর। আর জমিন তোমার জন্য মসজিদ (সিজদার স্থান)। অতএব যেখানেই সালাতের সময় হবে, সালাত আদায় করবে।’ (সুনানে আন-নাসায়ি-৬৯০)

বায়তুল্লাহ শরিফ মুমিনের প্রশান্তির অনন্য ঠিকানা। বারবার দেখেও তার আশা মেটে না। কেনইবা মিটবে! আল্লাহ যে এই ঘরকে বারবার ফিরে আসার জায়গা বানিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘আর স্মরণ করো সেই সময়ের কথা যখন আমি বায়তুল্লাহকে পরিণত করি বারবার ফিরে আসার জায়গা এবং পরিপূর্ণ নিরাপত্তার স্থানে।’ (সূরাতুল বাকারাহ-১২৫)
হজের কার্যাবলি হজরত ইবরাহিম খলিল আ: ও তাঁর পরিবারের সীমাহীন ত্যাগ ও কোরবানির স্মারক। হজরত ইবরাহিম আ: তাঁর পুত্র ইসমাইল আ:-কে নিয়ে বায়তুল্লাহ শরিফ পুনর্নির্মাণ করেন। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তিনি হজের ঘোষণা দেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘এবং সেই সময়কে স্মরণ করো, যখন আমি ইবরাহিমকে সেই ঘরের (অর্থাৎ কাবাগৃহ) স্থান জানিয়ে দিয়েছিলাম। (এবং তাকে হুকুম দিয়েছিলাম) আমার সাথে কাউকে শরিক করো না এবং আমার ঘরকে সেই সব লোকের জন্য পবিত্র রেখো, যারা (এখানে) তাওয়াফ করে, ইবাদতের জন্য দাঁড়ায় এবং রুকু-সিজদা আদায় করে। এবং মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পদযোগে এবং দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রমকারী উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যেগুলো (দীর্ঘ সফরের কারণে) রোগা হয়ে গেছে।’ (সূরাতুল হজ : ২৬-২৭)

হজ জীবনে একবারই ফরজ হয়। একবার আদায় করলে ফরজ হজ আদায় হয়ে যায়। বাকি হজগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে।

হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দানকালে বললেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন, সুতরাং তোমরা হজ পালন করবে। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! এটি (হজ পালন) কি প্রত্যেক বছরই? রাসূল সা: চুপ থাকলেন। লোকটি এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করল। অতঃপর রাসূল সা: বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তবে তা (হজ প্রতি বছর) ফরজ হয়ে যেত, যা তোমরা প্রতি বছর করতে পারতে না। অতঃপর রাসূল সা: বললেন, যে ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে কিছু বলিনি সে ব্যাপারটি সেভাবে থাকতে দাও। কেননা, তোমাদের আগের লোকেরা বেশি বেশি প্রশ্ন করে এবং তাদের নবীদের সাথে মতবিরোধ করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই আমি যখন তোমাদেরকে কোনো বিষয়ে নির্দেশ করব তা যথাসাধ্য পালন করবে এবং যে বিষয়ে নিষেধ করব তা পরিত্যাগ করবে।’ (মুসলিম-১৩৩৭)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ফরজ হজ একবারই। বাকিগুলো নফল হিসেবে পরিগণিত। (মুসনাদে আহমাদ- ১২০৪)

ফরজ আদায়ে যে গাফিলতি করে বা গড়িমসি করে নবীজী সা: তার জন্য ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী প্রদান করেছেন। হজরত আলী রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহর ঘরে পৌঁছার মতো পাথেয় এবং বাহন যার আছে তদুপরি সে হজ করেনি, এমন ব্যক্তির ওপর আল্লাহর কোনো পরোয়া নেই যে, সে ইহুদি হয়ে মরল নাকি খ্রিষ্টান হয়ে। (নাউজুবিল্লাহ) (শুআবুল ঈমান-৩৯৭৮)

ফরজ হজ আদায়ে বিলম্ব করা অনুচিত। ফরজ হজ আদায়ে বিলম্ব না করে দ্রুত আদায় করে ফেলার ব্যাপারে নবীজী সা: নির্দেশনা দিয়েছেন।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, তোমরা ফরজ হজ দ্রুত আদায় করে নাও। কারণ তোমাদের কারো জানা নেই যে, কার কখন সমস্যা দেখা দেয় (হয়তো বা সে সমস্যায় তার আর হজই আদায় করা হবে না)। (মুসনাদে আহমাদ-২৮৬৭)

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখযানুল উলুম, টঙ্গী, গাজীপুর।


আরো সংবাদ



premium cement