১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

হজের কার্যাবলি

-

হজের ফরজ কাজ তিনটি- ১. ইহরাম বাঁধা; ২. আরাফাতে অবস্থান; ৩. তাওয়াফে জিয়ারাহ করা। মনে রাখতে হবে, এই তিনটির কোনো একটি ছুটে গেলে হজ হবে না।

হজের ওয়াজিব কাজ পাঁচটি- ১. সাফা-মারওয়ায় সাঈ করা; ২. মুজদালিফায় রাত যাপন বা অবস্থান করা; ৩. জামরায় কঙ্কর মারা; ৪, কোরবানি করা ও ৫. বিদায়ী তাওয়াফ করা। এগুলোর কোনো একটি ছুটে গেলে তাকে দম দিতে হবে।
মূল হজের পাঁচ দিন

১. হজের প্রথম দিন ৮ জিলহজ : মক্কা থেকে ইহরাম বেঁধে মিনায় যাওয়া এবং ৮ জিলহজ সেখানে অবস্থান করা।

২. হজের দ্বিতীয় দিন ৯ জিলহজ : ফজরের নামাজ মিনায় পড়ে আরাফাতের ময়দানে রওনা হওয়া। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান। (হজের দ্বিতীয় ফরজ) প্রথম ফরজ তো আমরা নির্দিষ্ট মিকাত থেকে ইহরাম বেঁধে পালন করব। আরাফাতের দিনকেই মূল হজ বলা হয়। আরাফাত থেকে সূর্যাস্তের পর মাগরিব নামাজ না পড়ে মুজদালিফায় রওনা করতে হবে। সেখানে তারতিব ঠিক রেখে মাগরিব ও এশার নামাজ পড়ে সুবিধামতো স্থানে বিছানা পেতে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। ইচ্ছে করলে এখান থেকে ৭০টি কঙ্কর সংগ্রহ করা যাবে। ফজরের নামাজ আদায় করবেন। সূর্যোদয় পর্যন্ত কিবলামুখী হয়ে দোয়া করতে হবে।
হজের তৃতীয় দিন ১০ জিলহজ : এই দিনটি খুবই কঠিন ও পরিশ্রমের। এ দিনের কাজগুলো নি¤œরূপ :

মুজদালিফা থেকে মিনায় ফিরে আসা, শুধু বড় জামরায় সাতটি কঙ্কর মারা, কোরবানি করা, চুল কাটা, মক্কায় গিয়ে তাওয়াফ ও সাঈ করা (হজের তৃতীয় ও শেষ ফরজ), মক্কা থেকে আবার মিনায় চলে আসা।

মুজদালিফা থেকে মিনায় পৌঁছানোর পর তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দিতে হবে। সূর্য হেলার আগে বড় জামরায় সাতটি কঙ্কর মারতে হবে। কোরবানি করবেন। এরপর হজের তৃতীয় ও শেষ ফরজ তাওয়াফে জিয়ারাত বা বিদায়ী তাওয়াফ করা এবং মাথা মুণ্ডন করা। তারপর মিনায় ফিরে যাবেন।

হজের চতুর্থ দিন ১১ জিলহজ : মিনায় অবস্থান। সূর্য হেলার পর তিনটি জামরায় সাতটি করে ২১টি পাথর মারা। প্রথমে ছোট জামরায়, পরে মধ্যম জামরায়, শেষে বড় জামরায়। সূর্য ডোবার আগে পাথর মারা শেষ করে মিনার তাঁবুতে চলে যাওয়া।
হজের পঞ্চম দিন ১২ জিলহজ : মিনায় সর্বশেষ অবস্থান। সূর্য হেলার পর আগের নিয়মে সাতটি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করা এবং সূর্যাস্তের আগেই মিনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে আসা। সূর্যাস্তের আগে যদি মিনা ত্যাগ না করা যায় তবে ১৩ জিলহজ মিনায় অবস্থান করে ১২ জিলহজের মতো আবার ২১টি কঙ্কর মারতে হবে।

বিদায়ী তাওয়াফ : যেদিন দেশে ফিরে যাবেন বা মদিনায় চলে যাবেন মক্কায় আর ফিরে আসবেন না, সেদিন সুবিধামতো সময়ে বিদায়ী তাওয়াফ করা। বিদায়ী তাওয়াফ সাধারণ পোশাকে হবে। এ তাওয়াফে রমল, ইজতিবা ও সাঈ নেই।
হজের কিছু পরিভাষা

ইহরাম : প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পর গোসল করে মিকাতের আগে তথা বিমানে উঠার আগে দুই টুকরা সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করে মিকাত থেকে উমরার নিয়ত করা। এটি হজের প্রথম ফরজ। আর তখন থেকেই তালবিয়া পাঠ করা।

মিকাত : মিকাত অর্থ নিদিষ্ট সময় বা সময়সূচি। হজের পরিভাষায় এমন এক নির্দিষ্ট স্থানকে মিকাত বলে, যেখান থেকে বা যে স্থান অতিক্রম করার আগে হজ বা উমরার জন্য ইহরাম বাঁধতে হয়। এ রকম স্থান পাঁচটি।

তালবিয়া : লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক লাব্বায়িকা লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলক লা শারিকা লাক। অর্থাৎ- উপস্থিত, উপস্থিত হে আল্লাহ! তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই এবং রাজত্বও। তোমার কোনো শরিক নেই।

তাওয়াফ : তাওয়াফ মানে জিয়ারত বা চক্কর দেয়া। অর্থাৎ বায়তুল্লাহর চারদিকে চক্কর দেয়া। ফরজ, ওয়াজিব ও নফল তাওয়াফ রয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে- ‘এবং ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে দায়িত্ব দিলাম যে তোমরা আমার ঘর পবিত্র করো তাওয়াফকারী ও ইতিকাফকারীদের জন্য।’ (সূরা বাকারা-১২৫)

রমল : রমল শুরু হয় সপ্তম হিজরিতে। রাসূলুল্লাহ সা: ষষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়া থেকে ফিরে যান উমরাহ আদায় না করেই। হুদায়বিয়ার চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তী বছর তিনি ফিরে আসেন উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে। সময়টি ছিল জিলকদ মাস।

সাহাবাদের কেউ কেউ জ্বরাক্রান্ত হয়েছিলেন। এ নিয়ে মক্কার মুশরিকরা মুসলমানদের নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলতে লাগল- ‘এমন এক সম্প্রদায় তোমাদের কাছে আসছে ইয়াছরিবের জ্বর যাদের দুর্বল করে দিয়েছে।’ (বুখারি-মুসলিম) শুনে রাসূলুল্লাহ সাহাবাদের রামল করতে বললেন। রামল মানে বুকটান করে দৌড়ানো। আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের মতো, ছোট ছোট কদমে গা হেলিয়ে বুক টান করে দৌড়ানো। তাওয়াফে এই রমল করতে হয়। উদ্দেশ্য মুমিন কখনো দুর্বল হয় না, মুমিন কখনো হতোদ্যম হয় না, এটি দেখানো। রোগ-শোক সব কিছুকে চাপিয়ে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এর সাথে ইজতিবা নামে আরেকটি পরিভাষা আছে। মানে চাঁদরখানা ডান বগলের নিচে দিয়ে বীরের বেশে তাওয়াফ করা।

সাফা-মারওয়া পাহাড় ও সাঈ : কাবার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একেবারেই কাছাকাছি ছোট্ট একটি পাহাড়ের নাম সাফা এবং কাবার অনতিদূরে উত্তর-পূর্ব কোণে মারওয়া পাহাড়। এটিও খুবই ছোট্ট একটি পাহাড়। এ দু’টি পাহাড়ের মধ্যে মা হাজেরা তার দুগ্ধপায়ী সন্তান ইসমাইল আ:-এর জান বাঁচানোর জন্য ছোটাছুটি করেছিলেন। আল্লাহ তার মেহমানদের জন্য এই দু’টি পাহাড়ের মধ্যে দৌড়ানোকে বৈধ করে দিলেন। এই ছোটাছুটির নামই হলো সাঈ।

হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর : পবিত্র কাবার দক্ষিণ কোণে জমিন থেকে ১.১০ মিটার উচ্চতায় স্থাপিত হাজরে আসওয়াদ। এটি জান্নাত থেকে নেমে আসা একটি পাথর। (নাসায়ি) শুরুতে যার রং ছিল দুধের বা বরফের মতো সাদা। পরে আদম সন্তানদের পাপ তাকে কালো করে দেয়। (তিরমিজি) হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হয়। (নাসায়ি) হাজরে আসওয়াদের কোণ থেকে আল্লাহু আকবার বলে তাওয়াফ শুরু করতে হয়। স্পর্শ করা সম্ভব না হলে ইশারা করলেও চলবে। হাজরে আসওয়াদ চুম্বন মুমিন হৃদয়ে সুন্নাহর তাজিম ও সম্মান বিষয়ে চেতনা সৃষ্টি করে। রাসূলুল্লাহ সা: করেছেন সেজন্য আমরা করি। হজরত ওমর রা: পাথরকে চুম্বন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি জানি নিশ্চয়ই তুমি একটি পাথর। ক্ষতি-উপকার করার ক্ষমতা কোনোটিই তোমার নেই। রাসূলুল্লাহ সা:-কে চুম্বন করতে না দেখলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।’ (বুখারি-১৫২০)

রুকনে ইয়ামানি : কাবা শরিফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ। তাওয়াফের সময় এ কোণকে সুযোগ পেলে স্পর্শ করতে হয়। চুম্বন বা ইশারা করা নিষেধ।

মুলতাজিম : হাজরে আসওয়াদ থেকে কাবার দরজা পর্যন্ত জায়গাটুকুকে মুলতাজিম বলে। (মুসলিম) মুলতাজাম শব্দের অর্থ- ‘এঁটে থাকার জায়গা’। সাহাবায়ে কেরাম রা: মক্কায় এসে মুলতাজামে যেতেন ও দুই হাতের তালু, দুই হাত, চেহারা ও বক্ষ দেয়ালের সাথে এঁটে দিয়ে দোয়া করতেন।
মাকামে ইবরাহিম : মাকামে ইবরাহিম বলতে সেই পাথরকে বুঝায় যেটি কাবা শরিফ নির্মাণের সময় ইসমাইল নিয়ে এসেছিলেন তার পিতা ইবরাহিম এর ওপর দাঁড়িয়ে কাবাঘর নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজে ওপরে উঠার প্রয়োজন হলে পাথরটি অলৌকিকভাবে ওপরে উঠে যেত। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তার মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলো এবং মাকামে ইবরাহিম বা ইবরাহিমের ইবাদতের স্থান।’ (সূরা আলে ইমরান-৯৭) তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহিমের পেছনে কাবামুখী হয়ে দুই রাকাত সালাত আদায় করতে হয়।

মাতাফ : কাবা শরিফের চারপাশের উন্মুক্ত জায়গাকে মাতাফ বলে। মাতাফ মানে তাওয়াফ করার স্থান। বর্তমানে তাওয়াফের অতিরিক্ত ভিড় এড়ানো এবং একসাথে আরো বেশি করে মানুষ যাতে তাওয়াফ করতে পারে এ জন্য খোলা চত্বরের বাইরে মজবুত স্টিলের ওপর তিন তলা করে দেয়া হয়েছে।

আল হাতিম : হাতিম অর্থ বিচ্ছিন্ন। কাবার উত্তর পাশে অর্ধ-গোলাকার জায়গাটিকে হাতিম বলে। এটি ইবরাহিম আ:-এর ভিত্তির অন্তর্র্ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ এটি কাবাঘরের অংশ। কিন্তু কুরাইশরা কাবা পুনর্নির্মাণের সময় অর্থাভাবে তা কাবার ভিত্তির মধ্যে করতে পারেনি। এখানে প্রবেশ করে নফল নামাজ পড়া মানে কাবাঘরে প্রবেশ নামাজ পড়া। এটি দোয়া কবুলের জায়গা।

মিজাব : অর্থ- নালা। কাবাঘরের ছাদ থেকে পানি অবতরণের নালাকে মিজাব বলে। এর নিচে দাঁড়িয়ে দোয়া কবুল হয়।
মসজিদে হারাম : কাবা শরিফ ও তার চারপাশের মাতাফ, মাতাফের ওপারে বিল্ডিং, বিল্ডিংয়ের ওপারে মারবেল পাথর বিছানো উন্মুক্ত চত্বর এ সবগুলো মিলে মসজিদুল হারাম। কারো কারো মতে, পুরো হারাম অঞ্চল মসজিদুল হারাম হিসেবে বিবেচিত।

লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারে ৫৩ নাগরিকের উদ্বেগ ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে দুর্নীতি কে প্রশয় দেয়া হবে না : জাতীয় নাগরিক কমিটি ফতুল্লা থেকে অপহৃত ২ শিশু বরিশাল থেকে উদ্ধার মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করা শিক্ষককে চাকরিচ্যুতের দাবি টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ব্যক্তি ট্রাম্প আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য দিবসে রিকের র‌্যালি ও মানববন্ধন অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের সভাপতি হাসান শরীফ, সাধারণ সম্পাদক সোহেল চুয়েটে র‌্যাগিংয়ের দায়ে ১১ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ঢাকায় উচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার না করতে ডিএমপির নির্দেশনা তামিমের ঝড়ে জয় পেল চট্টগ্রাম তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে ধোঁয়াশা, কর্মকর্তা প্রত্যাহার

সকল