১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

স্ত্রীকে সংশোধনের পদ্ধতি

-


রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘উত্তম স্ত্রী হলো ওই স্ত্রী যার দিকে তাকালে তোমাকে আনন্দিত করে, তুমি কোনো কিছুর আদেশ করলে তা পালন করে, আর অনুপস্থিতিতে তার নিজের সতিত্ব ও তোমার সম্পদের হিফাজত করে।’ (তায়ালাসি-২৩২৫, নাসায়ি-৬/৬৮, আহমদ-৩/২৫১)
রাসূলুল্লাহ সা: হজরত ওমর রা:-কে বলেন, ‘হে ওমর! আমি কি তোমাকে ব্যক্তির উত্তম সম্পদ প্রসঙ্গে বলব? তা হলো নেককার রমণী। যখন স্বামী তার দিকে তাকায় তাকে আনন্দ দান করে, যখন সে কোনো কিছুর আদেশ করে, তা পালন করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তার সম্পদ হিফাজত করে।’ (আবু দাউদ)

স্ত্রীকে সংশোধন করার পদ্ধতি : স্ত্রী অবাধ্য হলে তাকে কিভাবে সংশোধন করবে এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর তোমরা যারা স্ত্রীদের অবাধ্যতার আশঙ্কা করো, তাদেরকে (প্রথমে) উপদেশ দাও, (এতে সংশোধন না হলে) তাদের বিছানা পৃথক করে দাও, (এতেও সংশোধন না হলে) তাদেরকে (হালকা) প্রহার করো।’ (সূরা নিসা-৩৪) এ আয়াতের মধ্যে সংশোধনের তিনটি পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে।
ক. উপদেশ দান : আল্লাহর কিতাব এবং মহানবী সা:-এর হাদিস দ্বারা স্ত্রীকে উপদেশ দিলে তার মনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং সে সংশোধিত হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তাকে বোঝাতে থাকুন। কেননা, বোঝালে মুমিনের উপকারে আসবে।’ (সূরা আয- যারিয়া-৫৫)
খ. বিছানা বর্জন : স্ত্রীর যদি স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা থাকে, তা হলে স্বামী তার বিছানা ত্যাগ করা খুবই কষ্টকর হবে। অতঃপর সে সংশোধিত হয়ে স্বামীর সাথে মধুর আচরণ করবে।

গ. হালকা প্রহার : স্ত্রীকে সঠিক পথে পরিচালিত করার সর্বশেষ পন্থা হলো প্রহার। এ প্রহারটি হবে আদবের প্রহার। এতে হাড় ভাঙবে না এবং জখম হবে না। এর উদ্দেশ্য হবে সংশোধন করা। মহানবী সা: বলেছেন, ‘অবাধ্য হলে তাদেরকে হালকা প্রহার করো।’ (ইবনে জারির-৪৫/৪৪) আল আশবা ওয়ান নাযাইর গ্রন্থে বলা হয়েছে- চার কারণে স্ত্রীকে প্রহার করা জায়েজ : ১. স্বামী পরিপাটি ও সুসজ্জিত হয়ে চলা প্রত্যাশা করলে আর স্ত্রী তা প্রত্যাখ্যান করলে; ২. স্বামী স্ত্রীকে তার বিছানায় শয়ন করতে আহ্বান করলে স্ত্রী শরয়ি কারণ ছাড়া স্বামীর আহ্বানে সাড়া না দিলে; ৩. স্বামীর অনুমতি ছাড়া যথার্থ জায়গা ব্যতীত কোথাও গেলে; ৪. নামাজ, রোজা ইত্যাদি ইবাদত বর্জন করলে। এ চার কারণ ব্যতীত অনুরূপ কোনো গর্হিত কাজ করলে স্বামী তাকে হালকা প্রহার করতে পারে। (আল আশবা ওয়াল নাযাইর, দ্বিতীয় খণ্ড, কিবাতুন নিকাহ- পৃষ্ঠা-২০৯) মহানবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তির প্রতি রহম করুন, যে তার বেত ঝুলিয়ে রাখে এবং স্বীয় পরিবারকে আদব শিক্ষা দেয়।’ (ইবনে আদি-৪/৩৩৪)

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক হক : মহানবী সা: বলেছেন, ‘সাবধান। স্ত্রীদের সাথে সদাচরণ করো। কেননা, তারা তোমাদের সাহায্যকারী। তোমরা তাদের কোনো কিছুর মালিক নও। তবে তারা যদি স্পষ্ট কোনো পাপের কাজ করে, তাদের বিছানা আলাদা করে দাও এবং হালকা প্রহার করো। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়ে যায়, তবে ভিন্ন পন্থার (তালাকের) চিন্তা করো না। সাবধান! অবশ্যই তোমাদের রয়েছে স্ত্রীদের প্রতি কিছু হক। আবার স্ত্রীদের রয়েছে তোমাদের প্রতি কিছু হক। স্ত্রীদের ওপর তোমাদের হক হলো- তোমাদের বিছানায় তাদের এমন ব্যক্তিকে স্থান না দেয়া, যাকে তোমরা অপছন্দ করো এবং তোমাদের ঘরে এমন ব্যক্তিকে আসার অনুমতি না দেয়া, যাকে তোমরা অপছন্দ করো। সাবধান! তোমাদের ওপর স্ত্রীদের হক হলো অন্ন ও বস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে স্ত্রীদের প্রতি অনুগ্রহ করা।’ (তিরমিজি-১১৬৩, ইবনে মাজাহ-১৮৫১) মহানবী সা: আরো বলেছেন, ‘তোমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা, তোমরা আল্লাহর আমানত হিসেবে তাদেরকে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বাণীর বিনিময়ে তাদের যৌনাঙ্গের বৈধতা লাভ করেছ। তাদের প্রতি তোমাদের কিছু হক রয়েছে, তা হলো- তারা তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে জায়গা দেবে না, যাকে তোমরা অপছন্দ করো। যদি তারা করে তবে তাদেরকে (হালকা) প্রহার করো।’
আমি রাসূল সা:-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘স্বামীকে জিজ্ঞেস করা যাবে না কেন সে তার স্ত্রীকে প্রহার করেছে।’ (আবু দাউদ-২১৪৭, ইবনে মাজাহ-১৯৮৬)

স্ত্রীর হক : স্ত্রীর আনন্দ ও চাহিদার প্রতি খেয়াল রাখা। স্বামীকে অবশ্যই স্ত্রীর মনের কথা বুঝতে হবে। তার চাহিদা সাধ্যমতো পূরণ করার চেষ্টা করতে হবে। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি (আয়েশা) মহানবী সা:-কে দেখেছি, তিনি আপন চাদর দিয়ে আমাকে আড়াল করে দিতেন আর আমি মসজিদে বসে হাবশি লোকদের যুদ্ধের অনুশীলন দেখতাম। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তৃপ্ত না হতাম ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি চাদর দিয়ে আমাকে আড়াল করে রাখতেন। সুতরাং যদি তোমরা কোনো অল্প বয়সের নারীকে বিয়ে করো, তবে তার অনুভূতির প্রতি খেয়াল রাখো। কেননা, অল্প বয়সের মেয়েদের খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের শখ থাকে।’ (বুখারি, মুসলিম)

স্ত্রীর কাজের প্রশংসা : হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, মহানবী সা:-এর স্ত্রীদের মধ্যে হজরত খাদিজা রা:-এর প্রতি আমার যে পরিমাণ ঈর্ষা হতো অন্য কারো প্রতি তেমনটি হতো না। আমি তাকে দেখিনি, কিন্তু রাসূল সা: খুব বেশি তার কথা বলতেন। আমি অনেক সময় তাঁকে বলতাম, মনে হয় দুনিয়াতে খাদিজা রা: ছাড়া আপনার কোনো স্ত্রী নেই। তিনি বলতেন, ‘নিশ্চয়ই সে খুবই উত্তম মহিলা ছিল। সে এমন ছিল, তেমন ছিল, সে এ কাজ করেছে, ওই কাজ করেছে। তার থেকে আমি সন্তান লাভ করেছি।’ (বুখারি ও মুসলিম)
স্বামীর হক : হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, একদা একজন মহিলা মহানবী সা:-এর পাক দরবারে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মেয়েরা আমাকে তাদের প্রতিনিধি করে আপনার সমীপে পাঠিয়েছেন। পুরুষের ওপর জিহাদ ফরজ করা হয়েছে। যদি তারা জিহাদে আহত হয়, এ জন্য পুরস্কার পাবে, আর যদি শহীদ হয়, তবে আল্লাহর সান্নিধ্যে তারা জীবিত এবং রিজিক ভোগ করবে। কিন্তু আমরা নারীরা তাদের ঘর ও সন্তানের দেখাশুনা করি। এ জন্য কি আমাদের পুরস্কার রয়েছে? রাসূল সা: বললেন, ‘যেসব মেয়ের সাথে তোমার সাক্ষাৎ ঘটে তাদের জানিয়ে দাও, স্বামীর আনুগত্য করা ও স্বামীর হক আদায় করা জিহাদের সমান মর্যাদা। তবে তোমাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক নারী তা করে।’ (বাযযায)

‘তোমাদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী তারা, যারা তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ চরিত্রবান এবং তোমাদের মধ্যে উত্তম মানুষ তারা, যারা নিজ স্ত্রীদের দৃষ্টিতে উত্তম বলে বিবেচিত।’ (তিরমিজি, পৃষ্ঠা-২৮৩)
আদর্শ রমণীকে তালাক দান প্রসঙ্গ : তালাক দেয়া সবচেয়ে ঘৃণিত বৈধ কাজ। মহানবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত বৈধ কাজ হলো তালাক দেয়া।’ (আবু দাউদ-২১৭৮) মহানবী সা: আরো বলেন, ‘কোনো মুমিন স্বামী তার মুমিনা স্ত্রীকে পৃথক করবে না, যদি তার একটি স্বভাব অপছন্দ হলেও, অন্য স্বভাব পছন্দ হয়।’
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement