১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গঠনমূলক কল্যাণ রাষ্ট্রের জনক মুহাম্মদ সা:

-

পর্ব : ২
দাস প্রথার উচ্ছেদ : আরবে বহু যুগ ধরে গোলামি প্রথা প্রচলিত ছিল। মনিবরা গোলামদের ওপর অমানসিক অত্যাচার করত। মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদাই ছিল না। তারা পশুর মতো জীবনযাপন করত। তাদেরকে বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। তিনি মনিবদের নির্দেশ দিলেন ক্রীতদাসদের প্রতি সদাচরণ করো। তোমরা যা খাও, পরিধান করো, তা তাদের খেতে এবং পরিধান করতে দাও। তিনি তাদের মুক্তির পথনির্দেশ করে ঘোষণা দিলেন, গোলামকে আজাদিদানের কাজ আল্লাহর কাছে একটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত। ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবে, তার প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে আল্লাহ তার প্রতিটি অঙ্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন’ (বুখারি ও মুসলিম)। তিনি অনেক দাসকে মুক্তি করে দেন এবং অনেক সাহাবি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তাঁর উদারতার জন্য দাস বেলাল রা:-কে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন এবং ক্রীতদাস জায়েদকে সেনাপতিত্বে বরণ করে দাসদের পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন।
নারী জাতির শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষক কল্যাণ রাষ্ট্র : তৎকালীন আরবে নারীদের ভোগ্যসামগ্রী মনে করত। তারা ছিল পুরুষদের দাসী মাত্র। পরিবারের কর্তা ইচ্ছে করলে নারীকে ক্রয়-বিক্রয় এবং হস্তান্তর করতে পারত। পিতা এবং স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের কোনো অংশ ছিল না। মহানবী সা: নারীদের মর্যাদা দিলেন। নারী জাতিকে নির্যাতন ও দুর্দশার হাত থেকে উদ্ধার করে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’ (আহমাদ, নাসায়ি)। তিনি আরো ঘোষণা করেন, ‘পূর্ণাঙ্গ মুমিন তিনি যার চরিত্র উত্তম; আর উত্তম মানুষ তিনি, যিনি তার স্ত্রীর কাছে উত্তম’ (তিরমিজি)। তিনি সর্বপ্রথম নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেন। এ সবের জন্য নারী জাতি রাষ্ট্রের অভিশাপ না হয়ে আশীর্বাদে পরিণত হলো।

রাসূল সা: বলেছেন, ‘কন্যার জন্য অর্ধেক আর ভগ্নির জন্য অর্ধেক’ (বুখারি, প্রাগুক্ত, হাদিস নং-৬৭৪১)। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক’ (সূরা নিসা, আয়াত-৩৪)।
এটিও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র, যে পুরুষরা হবে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্বে। পুরুষ নারী জাতির নেতা। জন্মগতভাবে নারীরা গুরুদায়িত্ব বহন করার ব্যাপারে দৈহিক এবং মানসিকভাবে শক্তির দিকে ক্ষমতাবান নয়। সে কারণে ইসলামী কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে রাসূলের কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের মূল কর্তৃত্বে পুরুষরাই ছিলেন। হ্যাঁ, নারীরা পরামর্শ দিয়েছেন, রাসূলের উম্মুল মুমিনিন যারা ছিলেন- যুদ্ধের ময়দানে পরামর্শ দিয়েছেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় সাহায্য করেছেন। যাতে প্রত্যেক সেক্টরের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি যেন রাষ্ট্র পরিচালনার পরামর্শের মধ্যে শরিক থাকতে পারে।
কন্যাশিশু জীবন্ত কবর দেয়া রহিতকরণ : প্রাচীন আরবে কন্যাশিশুকে অমঙ্গল ও অসম্মানের প্রতীক মনে করা হতো। তাই তৎকালীন সময়ে কন্যাশিশুকে আরবে জীবন্ত মাটির নিচে প্রোথিত করা হতো। রাসূল সা: এ জঘন্য প্রথা নিষেধ করেন। তিনি বলেন, ‘মাতা-পিতার অবাধ্যতা ও জীবন্ত কন্যাসন্তান মাটিতে প্রোথিত করা মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য হারাম ঘোষণা করেছেন’ (বুখারি, প্রাগুক্ত, হাদিস নং-৮৪৪)।
সঙ্ঘাতমুক্ত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা : তৎকালীন আরবের বিভিন্ন গোত্রে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত লেগেই থাকত। সামান্য অজুহাতে ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা বাজত আর দীর্ঘকাল যাবত তা দাবানলের মতো জ্বলতে থাকত। রক্তপাত ও লুণ্ঠন ছিল তাদের নিত্যদিনের চিত্র। তিনি এসব অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে শান্তিময় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নবুওয়াতের আগে ‘হিলফুল ফুজুল’ এবং পরে ‘মদিনা সনদ’-এর মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য শান্তি আনেন। কয়েকটি গোত্র যেমন- বনি হাশেম, বনি মোত্তালেব, বনি আসাদ ইবনে আবদুল ওযযা, বনি যোহরা ইবনে কেলাব মিলে আবদুল্লাহ ইবনে জুদআন তাইমির ঘরে একত্র হয়ে এ মর্মে অঙ্গীকার করেন, ‘মক্কায় সংঘটিত যেকোনো প্রকার জুুলুম-অত্যাচার প্রতিরোধ করবেন।’ এর প্রসঙ্গ করে রাসূল সা: বলেছিলেন, ‘এ চুক্তির বিনিময়ে লাল উটও আমার পছন্দ না’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, আবু মুহাম্মদ আবদুল মালিক ইবনে হিশাম মুসাফিরি রহ: আকরাম ফারুক (অনুবাদক), প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা-১৩৩)।
মদিনায় হিজরতের পর তিনি সেখানে আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, নাগরিকদের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন। মানবেতিহাসের প্রথম প্রশাসনিক ও লিখিত সংবিধান ‘মদিনা সনদ’ যাতে সেখানে বসবাসরত সব ধর্মাবলম্বীর স্বাধীনতা ও অধিকারের যথোপযুক্ত স্বীকৃতি ছিল।
মদ্যপান রহিতকরণ : ইবনে আছিরের বর্ণনায় রাসূল সা: বলেছেন, ‘জাহেলি যুগের লোকেরা যেসব কাজ করত, দুইবারের বেশি কখনোই সেসব কাজ করার ইচ্ছে আমার হয়নি। সেই দু’টি কাজ আল্লাহর পক্ষ থেকে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে’ (আর রাহিকুল মাখতুম, আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরী রহ:, খাদিজা আখতার রেজায়ি (অনুবাদক), পৃষ্ঠা-৮৫)।

মদ্যপ্রিয়তা আরবদের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। নর্তকীদের সাথে মদোমত্ত হয়ে তারা যেকোনো অশ্লীল কাজ করত। মহানবী সা: দেখলেন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনে চরম ক্ষতি সাধনকারী। তাই তিনি কঠোরভাবে মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট হন।
জুয়া নিষিদ্ধ : তৎকালীন আরবে জুয়া খেলার ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং এটিকে সম্মানজনক অভ্যাস মনে করত। জুয়া খেলায় হেরে মানুষ অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতো। ফলে ব্যাহত হতো সামাজিক জীবন। রাসূল সা: জুয়া খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রাষ্ট্রের ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। তিনি বারবার তাগিদ দেন, ‘নেশা সৃষ্টিকারী প্রতিটি বস্তুই হারাম’ (সুনানে আবু দাউদ, আবু দাউদ সুলায়মান ইবনুল আশআস আস-সিজিস্তানি, হাদিস নং-৩৬৮৫)। কুসিদ প্রথা উচ্ছেদ : কুসিদ প্রথা বলতে এক প্রকার সুদের কারবার প্রথা। আরবে জঘন্য কুসিদপ্রথা বিদ্যমান ছিল। তারা এত উচ্চহারে সুদের কারবার করত যে, সুদ পরিশোধ করতে না পারলে সুদগ্রহীতার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তির সাথে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে নেয়া হতো। আরবে প্রচলিত ব্যবস্থা সুস্থ সমাজ বিকাশে প্রচণ্ড বাধাস্বরূপ ছিল। নবীজী সা: সুদ হারাম ঘোষণা করেন এবং আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীকে ‘করজে হাসানা’ দানে উৎসাহিত করেন। সুদের ভয়াবহতা বোঝাতে তিনি বলেন, ‘সুদ (পাপের দিক থেকে) ৭০ প্রকার। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট (পাপের) সুদ হলো মায়ের সাথে ব্যভিচার করা (অর্থাৎ সুদ খাওয়ার গুনাহ মায়ের সাথে ব্যভিচার করার চেয়ে ৭০ গুণ বেশি)’। (সুনানে ইবনে মাজাহ, আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে মাজাহ আল-রাবি আল-কুয়াজুইনি, হাদিস নং-২২৭৪)।
রাষ্ট্রের জনগণের কুসংস্কার মুক্তকরণ : আরবের জাহেলি নানা কুসংস্কার ছিল। ভাগ্য নির্ধারক তীর, দেব-দেবীর সাথে অলীক পরামর্শ, মৃতের অজ্ঞাতযাত্রার ধারণা প্রভৃতি চালু ছিল। শুধু তা-ই নয়, আরো নানা প্রকার ভূত-প্রেত, দৈত্য, পরী প্রভৃৃতিকে বিশ্বাস করত। রাসূল সা: বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে তাদের মন-মগজ থেকে সব কুসংস্কার দূর করেন। ‘যে ব্যক্তি কসম করে বলে, ‘লাত ও উয্-যার কসম’, সে যেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। আর যে ব্যক্তি তার সঙ্গীকে বলে, ‘এসো তোমার সাথে জুয়া খেলি’, সে যেন সাদকাহ করে’ (রিয়াদুস সলেহিন, ইমাম মহিউদ্দীন ইয়াহইয়া আন-নববী রহ:, হাদিস নং-১৮১৬)।
নিষ্ঠুরতার অবসান : প্রাচীন আরব নিষ্ঠুরতায় ভরপুর ছিল। ভোগবাদী আরবরা দাস-দাসী, এমনকি শত্রু গোত্রের লোকদের সাথে অমানবিক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতো। বিত্তবানরা খেলার ছলে দ্রুতগামী ঘোড়ার লেজের সাথে নারীকে বেঁধে দিতো। যার ফলে হতভাগা নারীর প্রাণ-প্রদীপ নিভে যেত। রাসূল সা: সমাজ থেকে এরূপ বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা দূর করে রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন আনেন। ‘জুলুকিয়ামতের দিন অনেক অন্ধকারের রূপ ধারণ করবে’ (বুখারি, প্রাগুক্ত, হাদিস নং-২৪৪৭)।
শেষাংশ কাল


আরো সংবাদ



premium cement