মুমিন জীবনে আখলাকে হাসানা
- জামান শামস
- ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৫
(শেষাংশ)
মুমিন জীবনে ব্যক্তির মন্দ চরিত্র কিভাবে তাকে নাজেহাল করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে অত্র হাদিসটি তার বাস্তব চিত্র। সে আমলকারী কতই না হতভাগা, যে আমল করেছে কিন্তু মজ্জাগত বদ অভ্যাসগুলো ছাড়তে পারেনি। ফলে এই অভ্যাসগুলো তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে ছেড়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (মুত্তাফাক, মিশকাত হা/৪৬১২, ৯/৮০, ‘জিহবার সংযম, গীবত ও গাল-মন্দ অনুচ্ছেদ)। যেসব ব্যক্তি নিজের স্বার্থের জন্য সত্য ও ন্যায়কে পাশ কাটিয়ে পরিস্থিতির অনুকূলে কথা বলে তাদের সম্পর্কে রাসূল সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তিকে তোমরা সর্বাধিক মন্দ অবস্থায় পাবে, যে দ্বিমুখী। সে এক মুখ নিয়ে এদের কাছে আসে, আরেক মুখ নিয়ে ওদের কাছে যায় (মুত্তাফাক, মিশকাত হা/৪৬১১, ৯/৮০)। রাসূল সা: আরো বলেন ‘উপকার করে খোঁটা দানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ও সর্বদা মদ পানকারী জান্নাতে যাবে না’ (মিশকাত হা/৪৭১৬, ৯/১১৯, ‘সৎ কাজ ও সদ্ব্যবহার’ অনুচ্ছেদ; নাসাঈ হা/৫৬৭২)। রাসূল সা: বলেন, ‘মুমিন হয় সরল ও ভদ্র, পক্ষান্তরে পাপী হয় ধূর্ত ও দুশ্চরিত্রের (আবূ দাঊদ হা/৪৭৯০)।
রাসূল সা: অন্যত্র বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামবাসীদের সম্পর্কে সংবাদ দিব না? তারা হচ্ছে অনর্থক কথা নিয়ে বিবাদকারী, বদমেজাজী, অহঙ্কারী’ (মুত্তাফাক আলইহে)। মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে তারা হচ্ছে বদমেজাজী, কুখ্যাত, অহঙ্কারী (মিশকাত হা/৪৮৮৯, ৯/১৭৬, ক্রোধ ও অহঙ্কার অনুচ্ছেদ)।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, তোমাদের মধ্যে সেসব ব্যক্তি আমার কাছে ঘৃণ্য ও কিয়ামতের দিন আমার কাছে থেকে দূরে অবস্থান করবে যারা বাচাল, নির্লজ্জ ও মুতাফাইহিকুন। ছাহাবীগণ বললেন, বাচাল ও নির্লজ্জ তো বুঝলাম। কিন্তু মুতাফাইহিকুন কারা, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বলেন, অহঙ্কারীরা (তিরমিজি হা/২০১৮, সনদ সহিহ)।
কোনো মানুষের গঠন-আকৃতি, পোশাক-আশাক নি¤œমানের হলেই তার বাহ্যিক অবস্থা দেখে তাকে হেয় মনে করা উচিত নয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! পুরুষরা যেন পুরুষদের ঠাট্টা না করে। হতে পারে (যাদেরকে ঠাট্টা করা হচ্ছে) তাদের মধ্যে এদের চেয়ে উত্তম লোক আছে। আর মহিলারা যেন মহিলাদের ঠাট্টা-বিদ্রƒপ না করে। হতে পারে তাদের মধ্যে এদের চেয়ে ভালো লোক আছে (সূরা হুজুরাত ১১)।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, কোনো মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ মনে করে (মুসলিম)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির সাথে ঝগড়া করব। ১. যে আমার সাথে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করে ৩. যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিক নিয়োগ করে কাজ আদায় করে কিন্তু তার মজুরি পরিশোধ করে না (বুখারি, ৪/৯১; ‘ওয়াদা খেলাফ করা হারাম’ অনুচ্ছেদ)।
কোনো মানুষকে বিনা কারণে কষ্ট দেয়া ও তার দোষ খোঁজা মন্দ স্বভাব। তার পরিণতিও মন্দ। আল্লাহ বলেন, ‘যারা মুমিন নর-নারীকে বিনা অপরাধে কষ্ট দেয়, তারা অতি বড় মিথ্যা দোষ ও জঘন্য পাপের শাস্তি তাদের নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নেয় (সূরা আহযাব ৫৮)।
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়া মন্দ স্বভাব। আর তার শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাঁর সহচর হিসেবে একজন শয়তান নিয়োগ করেন। আর শয়তান যার বন্ধু হয় তার মন্দের ব্যাপারে আর কি-ই-বা বলা প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয়, আমি তার জন্য নিয়োগ করি এক শয়তান। আর সে হয় তার বন্ধু। (সূরা যুখরূফ ৩৬) শুধু তাই নয়, এমন ব্যক্তি কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উঠবে। আল্লাহ বলেন, ‘যে আমার স্মরণে বিমুখ, তার জীবন হবে সঙ্কুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উঠাব। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন।’ (সূরা ত্বহা ১২৪, ১২৫)
মানুষের মন্দ স্বভাব ও তার পরিণতির কয়েকটি এখানে উদ্ধৃত হলো। হাদিসগুলো থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তির মন্দ স্বভাব, চাই তা কাউকে হত্যা করার মতো জঘন্য অপরাধ হোক কিংবা বদ মেজাজের মতো ব্যক্তিগত দোষই হোক পরিণামে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় তাকে অনন্ত শাস্তির দিকে।
সুতরাং আমাদের মধ্যে যত ছোট-বড় বদ অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এগুলোকে গুরুত্বের সাথে নাফসে লাওয়্যামার পর্যবেক্ষণে আনতে হবে। এরপর তাকওয়া নামক শক্তিশালী ক্লিনার দিয়ে ক্রমে এগুলো পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। যদি আমরা তাতে অক্ষম হই তাহলে উপরোক্ত হাদিসের পরিণাম ফল ভোগ করতে সক্ষম হবো।
মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আখলাক বিস্তৃত। আমলনামা শুরু হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এটি পরিব্যাপ্ত। সে দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের আখলাক তার প্রতিটি কাজই। ফলে মানুষের ভালো-মন্দ গুণাগুণের শেষ নেই। তথাপি কিছু ভালো বা মন্দ গুণের কারণে সে সমাজে উত্তম চরিত্র বা মন্দ চরিত্রে অভিহিত হয়। এমন কিছু উল্লেখযোগ্য উত্তম চরিত্রের উপাদান হচ্ছে- তাকওয়া বা আল্লাহভীতি, বিনয়-নম্রতা, সত্যবাদিতা, মিতভাষিতা, দানশীলতা, সবর বা ধৈর্য, ক্ষমা-উদারতা, শোকর ও জিকির-আযকার, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, আল্লাহর ওপর ভরসা করা, লজ্জাশীলতা, আমানতদারিতা, সুধারণা পোষণ, সৃষ্টিজীবের সবার প্রতি সহনশীল হওয়া, আদল-ইনছাফ প্রভৃতি।
আনাস রা: বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে ছিলাম, হঠাৎ তিনি হেসে উঠলেন, এমনকি তাঁর দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে পড়ল। এরপর তিনি বললেন, তোমরা কি জান আমি কেন হাসলাম? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক অবগত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, কিয়ামত দিবসে বান্দা তার প্রতিপালকের সাথে তর্কে লিপ্ত হবে; এ কারণে আমি হেসেছি। সে বলবে হে আমার প্রতিপালক! আপনি কি আমাকে জুলুম থেকে রক্ষা করেননি? আল্লাহ বলবেন, কেন নয়, অবশ্যই। সে বলবে, আমার জন্য আমি ছাড়া অন্য কাউকে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করব না। আল্লাহ বলবেন, আজকের দিনে তোমার হিসাবের জন্য তুমিই যথেষ্ট। আর সম্মানিত ফেরেশতারা সাক্ষী হিসেবে থাকবে। এরপর তার মুখে মোহর মেরে দেয়া হবে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বলা হবে, কথা বল। এরপর তারা তার আমল সম্পর্কে বলে দেবে। এরপর তার জবান খুলে দেয়া হবে। সে বলবে, দূর হও, অভিশাপ তোমাদের জন্য। তোমরা আমার শত্রু হয়ে গেলে? অথচ তোমাদের জন্যই আমি ঝগড়া-বিবাদ করছিলাম। (মুসলিম, মিশকাত/ ৫৫৫৪)
কী ভয়ঙ্কর হাদিস! আদর-যতেœ লালিত, বিলাস-ব্যসনে পরিবেষ্টিত, সুদৃষ্টিতে সংরক্ষিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এই আচরণ! সার্বক্ষণিক সাথী দেহের এই নিষ্ঠুর নির্দয় ও বিরুদ্ধ সাক্ষ্য প্রদান কতই না মর্মান্তিক। আর তা বান্দার অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকবে না। দুশ্চরিত্রের সাঁড়াশি যেভাবে মানবজাতির শ্বাসরোধ করে রেখেছে তাতে সেদিন অবস্থাটা কি দাঁড়াবে?
নিজ ঘরের নীরব কোণে একাকী বসে সে ব্লু ফিল্ম দেখেছে, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইল প্রভৃতি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কত মন্দ কাজে জড়িত হয়েছে, মোবাইলে কত পাপ বিজড়িত কথা বলেছে, কত ভ্রান্ত-বাতিল পরিকল্পনা করেছে! কেউ দেখেনি, কেউ শোনেনি। কারো দেখার বা শোনার অধিকারও ছিল না। আজ কি না তা বিশ্ববাসীর কাছে ওপেন সিক্রেট! এমন অনিবার্য, অলঙ্ঘনীয় কঠিন দিনের উপস্থিতির স্মরণে মুমিন হৃদয় ডুকরে না কেঁদে পারে? যে স্বভাব-বৈশিষ্ট্য, আমল মানুষকে এমনতর বিপদ ও অপমানের বধ্যভূমিতে নিক্ষেপ করবে, আমরা তা থেকে হাতজোড় করে আমাদের রবের কাছে পানাহ চাই। আর যে চরিত্র কিয়ামতের দিন মিজানকে হেলিয়ে দিয়ে বান্দার মুখ উজ্জ্বল করবে, অনাবিল জান্নাতি সুখানুভূতিতে অবগাহন করাবে, আমরা সে চরিত্র অর্জনের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। আল্লাহ তুমি সহায় হও। আমিন!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা