১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ওয়াজ মাহফিলে দ্বীনের শিক্ষা

-

দ্বীন প্রচারের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হলো ওয়াজ। সব নবী তাঁদের আনীত দ্বীনের প্রচারের জন্য এ মাধ্যমটি ব্যবহার করেছেন। আপনি যদি নবী রাসূলদের ওয়াজের যে বিবরণ আল কুরআনে উল্লেখ আছে তা পাঠ করেন অনুরূপভাবে যারা নবী নয় তবে দ্বীনের দাওয়াতদানকারী যেমন লোকমান আ:-এর ওয়াজ আল কুরআনে পাঠ করেন তবে অবশ্যই ওয়াজের গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। ওয়াজ একটি আরবি শব্দ। এ শব্দের অর্থ হলো শিক্ষা, নসিহত, উপদেশ, আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি। মূলত দ্বীনের শিক্ষাবিষয়ক যে কোনো আদেশ-নিষেধ নসিহত শিক্ষা উপদেশই হলো ওয়াজ।

খুতবা ও ওয়াজের মাঝে পার্থক্য হলো খুতবা বহু রকমের হয়ে থাকে। কারণ খুতবা মানে বক্তৃতা। রাজনৈতিক বক্তৃতা যেমন হয় তেমনি শিক্ষাবিষয়ক বক্তৃতা, যুদ্ধবিষয়ক বক্তৃতা, গণসচেতনামূলক বক্তৃতা, বিয়ের খুতবাও এর মাঝে শামিল। অন্যদিকে ওয়াজ হলো কেবল ইসলামের প্রচারবিষয়ক বক্তৃতা। এ দেশে ওয়াজ ও খুতবার ধরন ও উপস্থাপন কৌশলেও পার্থক্য রয়েছে। ওয়াজ হলো সুর সম্বলিত বক্তব্য, আর খুতবা বা বক্তৃতা হলো আবেগঘন তেজদীপ্ত বক্তব্য।

ওয়াজ মাহফিলের পাশাপাশি আছে তাফসির মাহফিল। ওয়াজ মাহফিলে সাধারণ কোনো একটি বিষয় নির্ধারণ করে ওয়ায়েজ আলোচনা করে থাকেন। আর তাফসির মাহফিলে মুফাস্সির আল কুরআনের কোনো একটি বা দুটি বা তারো বেশি আয়াতকেন্দ্রিক আলোচনা করে থাকেন।
আল্লাহ তায়ালা নবী সা:কে ওয়াজের মাধ্যমে মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দানের জন্য আদেশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি রবের পথে হিকমত ও সুন্দর ওয়াজের মাধ্যমে আহ্বান করো এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক করো। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভালো করেই জানেন।’ (সূরা আন নাহাল : ১২৫)

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা:কে তিনটি মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত দানের জন্য আদেশ করেছেন। মাধ্যম তিনটি হলো হিকমাত, সুন্দর ওয়াজ ও সুন্দরতম পন্থায় বিতর্ক।

এ আয়াতে উল্লেখিত প্রথম বিষয়টি হলো হিকমত বা প্রজ্ঞা। হিকমত ও প্রজ্ঞা হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা দাওয়াত দানকারীকে কৌশলী হতে শেখায়। দাওয়াত দানকারীর শুধু জ্ঞান থাকলে চলে না বরং তাকে কৌশলীও হতে হয়। কৌশলের অভাবে অনেক দাওয়াত দানকারীর দাওয়াত দ্বারা ইসলামের ফায়দার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়।

এ আয়াতে আলোচিত দ্বিতীয় মাধ্যমটি হলো উত্তম ওয়াজ। আর তৃতীয় মাধ্যমটি হলো সুন্দরতম পন্থায় বিতর্ক।
এখানে লক্ষ করার মতো বিষয় হলো ওয়াজ হতে হবে উত্তম পদ্ধতিতে আর বিতর্ক হতে হবে আরো উত্তম পদ্ধতি এবং কৌশলে। অর্থাৎ ওয়াজের সময় হাসান বা সুন্দর শব্দ প্রয়োগ করলেই হবে, আর বিতর্কের সময় কেবল হাসান বা সুন্দর শব্দ প্রয়োগ করলে হবে না; বরং আহসান বা সুন্দরতম শব্দ প্রয়োগের জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যদি এমন হয় যে, শব্দ প্রয়োগের দু’টি কৌশল আছে, তার মধ্যে একটি উত্তম আর অন্যটি অধিক উত্তম। তবে এমতাবস্থায় তার মধ্য থেকে অধিক উত্তম কৌশলটিই গ্রহণ করতে হবে।

এর অন্যতম রহস্য হলো; ওয়াজ সাধারণত করা হয়ে থাকে ওইসব লোকের উদ্দেশে যারা ওয়াজকারীর চিন্তা-চেতনার সাথে একমত পোষণ করে। সুতরাং তাদের ওয়াজ করার সময় এমন শব্দ প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না যা তাদের হৃদয়কে নরম, কোমল এবং আপ্লুত করবে। অন্য দিকে বিতর্ক করা হয়; সাধারণত এমন সব লোকের সাথে যারা বিতর্ককারীর চিন্তা-চেতনার বিরোধী। যারা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। যাদের সাথে বিরোধ থাকার কারণে সাধারণত বিতর্কের সময় রূঢ় ও কর্কশ শব্দ প্রয়োগের আশঙ্কা থাকে। তাদের সাথে বিতর্কের সময় কঠোর আচরণ করার প্রবণতা থাকে। এ কারণেই আল কুরআনের হেকমতের দাবি হলো; মানুষের সাথে বিতর্কের সময় এমন শব্দ প্রয়োগ ও আচরণ কামনা করা যা অতি উত্তম এবং সুন্দরতম হয়। যাতে ওই বিতর্ক থেকে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তায়ালা উপরোক্ত আয়াতে উত্তম ভাষায় ওয়াজ করতে আদেশ করেছেন কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বর্তমানে কিছু ওয়ায়েজ সুন্দর ও উত্তম শব্দ তো নয় বরং অভদ্র ও অশালীন কু-রুচিপূর্ণ ভাষায় ওয়াজ করা শুরু করেছে। তারা তাদের ওয়াজে প্রতিপক্ষ বা অপছন্দের লোককে গালাগাল করতেও দ্বিধা করছে না। ফলে তাদের গোটা ওয়াজ মাহফিলটা ওয়াজ মাহফিল থেকে গালাগাল ও অশালীন সমালোচনার মাহফিলে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়টির প্রতি প্রত্যেক ওয়ায়েজের লক্ষ রাখা দরকার। কারণ যে ওয়ায়েজ আল্লাহর কিতাব থেকে হেদায়ত লাভ করে না তাঁর ওয়াজ দ্বারা মানুষ কিভাবে হেদায়ত লাভ করবে?
আরো উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তায়ালা গোটা আল কুরআনকেও ওয়াজ বা উপদেশ বলে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে ওয়াজ বা উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত।’ (সূরা ইউনুস : ৫৭)

গোটা আল কুরআনকে ওয়াজ বলার তাৎপর্য তো এটাই যে ওয়ায়েজদের ওয়াজ হতে হবে আল কুরআনের বক্তব্যের মতো শালীন মার্জিত ও চিত্তাকর্ষক।
তেমনিভাবে শিক্ষা বোঝাবার জন্যও আল কুরআনে ওয়াজ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে। কারণ শিক্ষাও এক ধরনের ওয়াজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের আগে অনেক রীতিনীতি অতিবাহিত হয়েছে, অতএব তোমরা জমিনে ভ্রমণ করো, দেখো অস্বীকারকারীদের পরিণতি কিরূপ হয়েছিল। এটা মানুষের জন্য স্পষ্ট বর্ণনা ও হিদায়াত এবং ওয়াজ বা উপদেশ মুত্তাকিদের জন্য। ’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩৭-১৩৮)

আলোচ্য আয়াতে মানুষকে পৃথিবীতে ভ্রমণ করার উপদেশ দেয়া হয়েছে। কারণ পৃথিবীতে ভ্রমণ করলে জানা যাবে আল্লাহ বিভিন্ন জনপদ কি কারণে ধ্বংস করেছিলেন। আর এখান থেকে মুমিনরা শিক্ষা নিতে পারবেন। কারণ এ শিক্ষাও এক ধরনের ওয়াজ।

এখানে আরো উল্লেখ্য যে, যে ওয়াজ মানুষকে দ্বীন শেখাবার জন্য দ্বীনের দাওয়াতের জন্য সে ওয়াজ যেন দ্বীনের শিক্ষা অনুযায়ী হয় তা আলেম-ওলামা ও ওয়ায়েজদেরকে খেয়াল রাখতে হবে। ওয়াজ যেন কারো কষ্টের কারণ না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মানুষের সামনে ওয়াজ করতে নামার আগে রাসূল সা: সাহাবায়ে কেরাম তাবেঈন আইম্মায়ে মুজতাহেদীন ও সালফে সালেহীন কিভাবে ওয়াজ করতেন, কোন সময় ওয়াজ করতেন? কতক্ষণ ওয়াজ করতেন? সেসব বিষয় জানা আবশ্যক। এটাও জানা আবশ্যক যে, ওয়াজ কখনো দ্বীন প্রচারের মাধ্যম ছাড়া নিজের আয় রোজগারের মাধ্যম ছিল না। প্রায় সব নবীই তাদের কওমকে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার পারিশ্রমিক দেবেন রাব্বুল আলামীন। (দেখুন, সূরা ইউনুস-৭২, সূরা উউসুফ-১০৪, সূরা ফোরকান-৫৭, সূরা শোআরা-১০৯-১২৭-১৪৫, সূরা সাবা-৪৭, সূরা স্বাদ-৮৬

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


আরো সংবাদ



premium cement