১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

অটিজম নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা

-

অটিজম কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। অটিজম মূলত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতাজনিত একটি মানসিক রোগ। এটি মানুষের হরমোনজনিত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ।

ইসলামের দৃষ্টিকোণ : ইসলামের ইতিহাসে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পাওয়া যায় যারা তাদের পুণ্যময় কীর্তির কারণে পৃথিবীতে চিরদিনের জন্য ভাস্বর হয়ে আছেন। কুরআনে কারিমে প্রতিবন্ধীদের সাথে হৃদ্যতামূলক আচরণ করতে এবং তাদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। তাদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আর সবাই সমান, আর তাকওয়াই হচ্ছে মানুষ মর্যাদার মানদণ্ড : ইসলামে মানব মর্যাদার মাপকাঠি রঙ, বর্ণ, ভাষা, সৌন্দর্য, সুস্থতা ইত্যদি নয়; বরং মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া তথা আল্লাহ-ভীরুতা। যে যত বেশি মুত্তাকি আল্লাহ তাকে তত বেশি ভালোবাসেন। এই মাপকাঠির মাধ্যমে ইসলাম প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধীর মধ্যে ভেদাভেদ দূরীভূত করেছে এবং উভয়কে সমমর্যাদা দান করেছে। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকি।’ (সূরা হুজুরাত)

এই মর্মে নবী সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের শরীর ও আকৃতির দিকে দেখেন না; বরং তোমাদের অন্তরের দিকে দেখেন।’ (মুসলিম) নর-নারী যেন এক অপরকে উপহাস না করে : প্রতিবন্ধীর সমস্যা প্রতিবন্ধীই বেশি জানে কিন্তু যখন কোনো সুস্থ ব্যক্তি তাকে উপহাস করে তখন সে দারুণভাবে মর্মাহত হয়। তাই ইসলাম সুস্থ হলেও একে অপরকে উপহাস করতে নিষেধ করেছে। আল্লাহ বলেন- ‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা, যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর কোনো নারীকেও যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে।’ (সূরা হুজুরাত-১১)

সামাজিক স্বীকৃতি : প্রাচীন যুগে অনেকে প্রতিবন্ধীদের উপেক্ষা করত, তাদের সামাজিক মান-মর্যাদা দেয়া হতো না। এমনকি এখনো কিছু সমাজে তা দেখা যায়। যার ফলে বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করে তাদের অধিকার দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা: ১৪ শ’ বছর আগে বারবার তাঁর অনুপস্থিতির সময় মদিনার মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব এক প্রতিবন্ধী সাহাবিকে অর্পণ করে সমাজে সর্বোচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠিত করার নজির তৈরি করেন। তিনি সেই প্রতিবন্ধী সাহাবিকে আজান দেয়ার কাজেও নিযুক্ত করেছিলেন। সেই সম্মানীয় প্রতিবন্ধী সাহাবি হচ্ছেন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম।

শরিয়তের বিধান বাস্তবায়নে ছাড় প্রদান : ফিকাহ একটি প্রসিদ্ধ মূলনীতি হচ্ছে, ‘লা তাকলিফা ইল্লা বিমাকদুরিন আলাইহ’ অর্থাৎ- শরয়ি আদেশ জরুরি নয় কিন্তু ক্ষমতাবানের প্রতি। এই ফিকহি মূলনীতিটির ব্যাখ্যা হচ্ছে- প্রত্যেক ফরজ বিধান যা মহান আল্লাহ মানুষের প্রতি ধার্য করেছেন, যদি মানুষ তা পালনে সক্ষম হয়, তাহলে তার প্রতি তা পালন করা আবশ্যিক হবে, সে প্রতিবন্ধী হোক বা অপ্রতিবন্ধী। আর যদি সম্পূর্ণরূপে সে তা বাস্তবায়ন করতে অক্ষম হয়, তাহলে তা থেকে সে মুক্তি পাবে। আর যদি কিছুটা করতে সক্ষম হয় এবং কিছুটা করতে অক্ষম হয়, তাহলে যেই পরিমাণ করতে সক্ষম হবে, সেই পরিমাণ তাকে পালন করতে হবে এবং যেই পরিমাণ অক্ষম হবে, সেই পরিমাণ থেকে সে ছাড় পেয়ে যাবে। এর প্রমাণে আল্লাহর বাণী, (আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না) (সূরা বাকারাহ-২৮৬) এবং নবী সা: বলেন, ‘যখন আমি তোমাদেরকে কোনো আদেশ করি, তখন তা বাস্তবায়ন করো যতখানি সাধ্য রাখো।’ (বুখারি, মুসলিম) ইসলামের এই মনোরম বিধানে প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে সহজতা ও সহনশীলতা। তাই এমন প্রতিবন্ধী, যে ইসলামের বিধান পালনে একেবারে অক্ষম যেমন পাগল ও জ্ঞানশূন্য ব্যক্তি, তার উপর ইসলাম কোনো বিধান জরুরি করে না। আর আংশিক প্রতিবন্ধী যে কিছুটা করতে সক্ষম তার প্রতি অতটুকুই পালনের আদেশ দেয়। যেমন- যদি কারো অর্ধ হাত কাটা থাকে তাহলে যতটুকু অংশ বাকি আছে অজুর সময় ততটুকু ধৌত করতে আদেশ দেয়। অনুরূপ প্রতিবন্ধকতার কারণে নামাজে দাঁড়াতে না পারলে বসে আদায় করার আদেশ দেয়। এভাবে অন্যান্য অবস্থা।

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধীদের অধিকার : সমাজ ও পরিবারে অন্য সদস্যদের মতো প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও তাদের ন্যায্য পাওনা সম্পর্কে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। সাধারণত প্রতিবন্ধী বলতে স্বাভাবিক কর্ম সম্পাদনে অক্ষম ব্যক্তিকে বোঝায়। প্রতিবন্ধী মূলত শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, শ্রবণেন্দ্রিয়র ক্ষতির কারণে হয়ে থাকে। তাদেরও মৌলিক চাহিদা পূরণ, স্বাভাবিক ও সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। ইসলাম প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ইসলাম প্রতিবন্ধীদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে মানুষকে কর্তব্য-সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়েছে। প্রতিবন্ধীরা শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থ-সামাজিক অক্ষমতা বা অসুবিধার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। প্রতিবন্ধীর প্রতি দয়া-মায়া, সেবা-যত্ন, সুযোগ-সুবিধা ও সাহায্য-সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করা ইসলাম অনুসারীদের একান্ত কর্তব্য। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো তাদেরও ন্যায্য প্রাপ্য। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজখবর নাও এবং বন্দিকে মুক্ত করে দাও।’ (বুখারি) নবী করিম সা: প্রতিবন্ধীদের সর্বদাই অত্যন্ত ভালোবাসতেন ও বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাখতুম রা:-কে নবীজী তার অপার স্নেহধন্য করেছেন। ইসলামের আলোকে প্রতিবন্ধীদের পরমুখাপেক্ষিতার পথ থেকে স্বাবলম্বিতার পথে আনার সব রকম প্রচেষ্টা জোরদার করার তাগিদও আছে। নবী করিম সা: বলেছেন, বান্দা যতক্ষণ তার ভাইকে সাহায্য করে, আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন। (মুসলিম) ইসলাম প্রতিবন্ধীদের মানবিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত কার্যকরভাবে মানুষকে তাদের প্রতি কর্তব্য-সচেতন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা এসেছে- ‘আর তাদের (বিত্তশালী) ধনসম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক বা অধিকার রয়েছে।’ (৫১ : ১৯) অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা পেলে একজন প্রতিবন্ধীও সুন্দর ও সুস্থভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। অনুকূল পরিবেশ, আর্থিক সহযোগিতা, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে তারাও সমাজ, দেশ ও জাতি গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে পারে। প্রতিবন্ধীদের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক অক্ষমতার জন্য দূরে ঠেলে না দিয়ে তাদের প্রতি অন্যদের মতো সুন্দর আচরণ করা ইসলাম অনুসারীদের মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে মহানবী সা: বলেছেন, ‘পুরো সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন।

আল্লাহর কাছে প্রিয় সৃষ্টি হলো, যে তাঁর সৃষ্টির প্রতি সদয় আচরণ করে।’ প্রিয় নবী সা: আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করে, আল্লাহপাক তাকে জান্নাতে ফল খাওয়াবেন। যে তৃষ্ণার্তকে পানি পান করায়, আল্লাহ জান্নাতে তাকে শরবত পান করাবেন। যে কোনো দরিদ্রকে বস্ত্র দান করে, আল্লাহপাক তাকে জান্নাতে পোশাক দান করবেন।’ (তিরমিজি) প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর কাছে কোনো সামাজিক শ্রেণিভেদ ছিল না। তিনি সমাজের সব শ্রেণীর মানুষকে সমান চোখে দেখতেন; বরং নবী করিম সা: সমাজের অবহেলিত লোকদের ব্যাপারে একটু বেশিই খোঁজখবর নিতেন। তিনি প্রতিবন্ধীদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং তাদের অধিকারের প্রতি সজাগ থাকতে সাহাবিদের নির্দেশ দিতেন। এ জন্য প্রতিবন্ধীদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন নবী করিম সা:-এর অনুসরণীয় সুন্নত বটে। ইসলাম মানবকল্যাণের ধর্ম হিসেবে সবাইকে প্রতিবন্ধীদের যথার্থ অধিকারের প্রতি সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছে। নবী করিম সা: বলেছেন, ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইকে সাহায্য করে, আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন।’ (মুসলিম শরিফ)

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারে ৫৩ নাগরিকের উদ্বেগ ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে দুর্নীতি কে প্রশয় দেয়া হবে না : জাতীয় নাগরিক কমিটি ফতুল্লা থেকে অপহৃত ২ শিশু বরিশাল থেকে উদ্ধার মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করা শিক্ষককে চাকরিচ্যুতের দাবি টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ব্যক্তি ট্রাম্প আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য দিবসে রিকের র‌্যালি ও মানববন্ধন অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের সভাপতি হাসান শরীফ, সাধারণ সম্পাদক সোহেল চুয়েটে র‌্যাগিংয়ের দায়ে ১১ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ঢাকায় উচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার না করতে ডিএমপির নির্দেশনা তামিমের ঝড়ে জয় পেল চট্টগ্রাম তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে ধোঁয়াশা, কর্মকর্তা প্রত্যাহার

সকল