ইসলামে পানির গুরুত্ব
- ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
- ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৫, আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫০
পানি আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত : মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পানি। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে পানির অস্তিত্ব বিদ্যমান। পানি ছাড়া পৃথিবীতে কোনো প্রাণীসত্তা টিকে থাকা অসম্ভব। আর পবিত্র কুরআনে পানিকে সব জীবের উৎস বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী একসাথে মিলিত ছিল; এরপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিয়েছি এবং প্রত্যেকটি সজীব বস্তুকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছি; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবে না!’ (সূরা আম্বিয়া : ৩০)
আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ’ বছর আগেই কুরআন বলে দিয়েছে যে- ‘প্রতিটি প্রাণীর মূলেই রয়েছে পানি। এরও কয়েক শ’ বছর পর যখন অণুবীক্ষণ যন্ত্র উদ্ভাবিত হলো, তখন বিজ্ঞানীরা এই যন্ত্র ব্যবহার করে সাইটোপ্লাজম আবিষ্কার করে এবং দেখতে পায় যে, এর ৮০ শতাংশই পানি দিয়ে গঠিত। পানি সম্পর্কিত এ রকম আরো অনেক তথ্য দ্বাদশ শতাব্দীর আগে মানবজাতির কাছে অজানা ছিল, যার বর্ণনা কুরআন বহু আগেই দিয়েছে।
সাগর-মহাসাগরের পানি পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং সামুদ্রিক জীবগুলোকে টিকিয়ে রাখে। সমুদ্রের ঠাণ্ডা ও গরম স্রোতের সমন্বয় ও সূর্য থেকে আলো ও শক্তি শুষে নিয়ে সামুদ্রিক প্রাণীকুলকে বাঁচিয়ে রাখা এসবই পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যখন আমরা পানি নিয়ে গবেষণা করি, তখন আমরা দেখতে পাই, পানিকে এমন কিছু গঠনগত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে, যা অন্য কোনো তরল-অতরল পদার্থকে দেয়া হয়নি। এতে করে পানির মধ্যে সঞ্চার হয়েছে জীবনীশক্তি।
পৃথিবীতে বিচরণশীল ও স্থিতিশীল সব প্রাণের অস্তিত্বের জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। আর পানি ছাড়া মানুষের জীবনধারণ অসম্ভব। আল্লাহ তায়ালা পানিকে মানুষের জন্য নিয়ামত হিসেবে দান করেছেন। কেননা, পৃথিবীর সব প্রাণের উৎস পানি এবং সবাই পানির উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তায়ালা পানিকে শুধু মানুষের পান করার চাহিদা মেটানোর জন্যই তৈরি করেননি। পানিকে করেছেন সৃষ্টির বিভিন্ন কাজের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। আর পানির ওপর জীবন-জগতের সীমাহীন নির্ভরতার কারণেই ইসলাম পানিকে বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তা রক্ষায় মানবজাতিকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মানুষ তিনটি বিষয়ে পরস্পরের অংশীদার। পানি, ঘাস (বাণিজ্যিক ও মালিকানাধীন ভূমিতে নয় এমন) ও আগুন।’ (ইবনে মাজাহ)
আল্লাহ তায়ালা বিশুদ্ধ পানির গুরুত্বও তুলে ধরে বলেছেন- ‘তোমরা যে পানি পান করো, তা সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আনো, না আমি বর্ষণ করি? আমি চাইলে তা নোনা করে দিতে পারি, এরপরও কেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো না!’ (সূরা ওয়াকিয়াহ : ৬৮-৭০)
কুরআনের ব্যাখ্যাকারকরা বলেছেন, এই আয়াতে ‘কৃতজ্ঞতা প্রকাশ’-এর উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ ও অমূল্য সম্পদ পানির অপচয় রোধ করা এবং তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। আর নোনা করে দেয়ার অর্থ ব্যবহার অযোগ্য হওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-‘তোমরা খাও ও পান করো। কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আরাফ : ৩১)
কুরআনের এসব আয়াত ও অনুরূপ হাদিসের উদ্দেশ্য হলো-বৈশ্বিক সম্পদ পানি ও তাতে বিশ্ববাসীর অধিকার রক্ষা করা। এ জন্য আধুনিক যুগের ফকিহরা বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ও তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে মত দিয়েছেন। পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে আগামী দিনে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করে কুরআনে বলা হয়েছে- ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি তোমাদের পানি ভূগর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কে তোমাদের পানির স্রোতধারা সরবরাহ করবে!’ (সূরা মুলক : ৩০)
কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা উপেক্ষা এবং বৈশ্বিক সম্পদ পানির সুষ্ঠু বণ্টন ও রক্ষায় সঠিক উদ্যোগ না থাকায় পৃথিবীতে এরই মধ্যে বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট তৈরি হয়েছে। পরিবেশবিজ্ঞানীদের দাবি, আগামী দিনে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহই হবে পৃথিবীর অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিশ্বনবীর পানি পানের ছয়টি সুন্নাত : ইসলামের বিধান শুধু নামাজ রোজা হজ জাকাত তথা ইবাদত-বন্দেগির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং দুনিয়ার প্রতিটি কাজের সাথেই ইবাদত-বন্দেগি ও ইসলামের রীতি-নীতি জড়িত। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, চাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য সব কিছুই মানুষের জন্য ইবাদত হবে যখন এসব কাজ ইসলামী পদ্ধতিতে করা হবে। যেমন- মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা অত্যন্ত আবশ্যক। আবার জীবন ধারণে পানি পান করাও আবশ্যক। পানির অপর নাম জীবন। জীবন বাঁচাতে পানি পানের বিকল্প নেই। সব সৃষ্টিরই বেঁচে থাকার তাগিদে পানি পান করতে হয়।
আর মানুষের পানি পানে রয়েছে কিছু ইসলামী নিয়ম ও পদ্ধতি। কাজটি ছোট হলেও প্রতিদিন অনেকবার মানুষকে পানি পান করতে হয়। পানি পানের সময় স্বয়ং বিশ্বনবী সা: সুনির্দিষ্ট কিছু আমল করতেন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাস্তব জীবনের এ আমলগুলো উঠে এসেছে হাদিসের বর্ণনায়। আমলগুলো হলো-
পানি পানের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন তোমরা পানি পান করতে যাবে তখন প্রথমেই বিসমিল্লাহ পড়বে।’ (তিরমিজি)
শুধু পানি পানের সময়ই নয়, বরং যে কোনো কিছু খাওয়ার সময় এবং ভালো যেকোনো কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে।
সবসময় ডান হাতে পানি পান করা : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কখনো খাবার এবং পানীয় বাম হাতে গ্রহণ করবে না। কেননা, শয়তান বাম হাতে খাবার গ্রহণ করে।’ (মুসলিম)
সব ভালো কাজে বিসমিল্লাহ বলার মতো ভালো কাজে ডান হাত ব্যবহার করাও উত্তম। এমনকি পোশাক পরার সময়ও আগে ডান দিক থেকে শুরু করা। আর ডান দিক থেকে শুরু করতে হলে ডান হাতই ব্যবহার করতে হয়।
বসে পানি পান করা : হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ মুসলিমে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘(আগে) বসুন এবং পানি পান করুন।’ স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মতেও এটি সর্বজনবিদিত যে, দাঁড়িয়ে পানি পান করার চেয়ে বসে পানি পান করা বেশি ভালো। আর বসে পানি পান করা রাসূলুল্লাহ সা:-এর অন্যতম সুন্নাত।
তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করা : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা কখনো এক নিঃশ্বাসে পানি পান করো না; বরং তোমরা দুই কিংবা তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করো। অনেককেই দেখা যায়, পানি পান করার সময় ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় এক নিঃশ্বাসে মগ কিংবা গ্লাসে পুরো পানি পান করে থাকে। আবার অনেকে পানিও পান করতে থাকে আর নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। এর কোনোটিই ঠিক নয়; বরং সুন্নাত বিরোধী কাজ। তাই পানি পানের সময় অল্প অল্প করে দুই-তিন বারে পানি পান করা। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানেও এটি উপকারী।
গ্লাসের পানিতে নিঃশ্বাস না ছাড়া তিবরানিতে এসেছে, ‘পানি পান কিংবা খাবার গ্রহণের সময় মুখ থেকে পানি কিংবা খাবারে নিঃশ্বাস না ছাড়া।’ চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, অনেক সময় মুখে অনেক বা মুখের সামনে অনেক ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু থাকে। পানি বা খাবারে ফুঁ দেয়া বা নিঃশ্বাস ফেলানোর ফলে এ জীবাণু ব্যাকটেরিয়া পানি ও খাবারের সাথে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। আর তা ক্ষতিকর হয়।
পানি পানের পর আলহামদুলিল্লাহ পড়া : পানি পানের পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায়স্বরূপ সবসময় আলহামদু লিল্লাহ বলা। সুন্দর ও নিরাপদভাবে খাবার ও পানীয় গ্রহণের পর আল্লাহর প্রশংসামূলক বাক্য আলহামদু লিল্লাহ বলায় তারই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা