১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সাদাকাতুল ফিতরের আদ্যোপান্ত

-

নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকানাধীন সবার উপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিককে তার অধীনস্থ সবার পক্ষ থেকে আলাদা করে ফিতরা আদায় করতে হবে। এমনকি ঈদের দিন সকালেও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও ফিতরা ওয়াজিব। (এখানে ওয়াজিব শব্দটি ফরজ অর্থে আনা হয়েছে)। (ফতোয়ায়ে আলমগিরি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯২, ফাতহুল কাদির, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮১, ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪১৭, আল জাওহারাতুন নিয়ারাহ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭০)
পরবর্তীতে অনেক মুহাক্কিক আলেম ওই রায়ের বিপরীত বলেছেন। তাদের মতে, মুসলিমদের প্রত্যেক আজাদ, গোলাম পুরুষ ও নারীর পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর অথবা যবের এক ‘সা’ পরিমাণ আদায় করা আল্লাহর রাসূল সা: ফরজ করেছেন। অর্থাৎ ফিতরা দেয়া প্রত্যেক মুসলমানের উপর অত্যাবশ্যক। এমনকি ইবনে আব্বাস রা: থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, নবী সা: ফিতরা ফরজ করেছেন অনর্থক কথা-কাজ ও যৌনালাপ থেকে রোজাদারকে পবিত্র করা এবং মিসকিনদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা হিসেবে।’ (বুখারি : ১৫০৩, ১৫০৪, ১৫০৫, ১৫০৬, ১৫০৮, ১৫১০, ১৫০৭, ১৫১১, ১৫১২, মুসলিম, হাদিস : ৯৮৪, ৯৮৫, সুনানে আন-নাসায়ি : ২৫০০, ১৫০১, ২৫০২, ২৫০৩, ২৫০৪, ২৫০৫, ২৫১১,২৫১৬, আবু দাউদ : ১৫৯৪, ১৬১১, ১৬১৬, ১৬১৮, ১৬১৩, ১৬১৪, ইবনে মাজাহ : ১৮২৯, ১৮২৫, মাজমাউল ফতোয়া- ১৪/পৃষ্ঠা-২০২, তিরমিজি : ৬৭৩, ৬৭৫, ৬৭৬, ২৫১২, ২৫১৩, ২৫১৪, ২৫১৭, ২৫১৮, মুসনাদে আহমাদ : ১০৭৯৮, ১১৩০১, ১১৫২২, দারেমি : ১৬৬১, ১৬৬২, ১৬৬৩, ১৬৬৪, আবু দাউদ : ১৪৩৩, ইরওয়াহ তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৭, আবু দাউদ আহমাদ : ৪৪৭২, ৫১৫২, ৫২৮১, ৫৩১৭, ৫৭৪৭, ৫৯০৬, ৬১৭৯, মুয়াত্তা মালেক : ৬২৭, আবু দাউদ : ১৪৩২, মাজমাউল ফতোয়া-১৪, পৃষ্ঠা-২০২, ইরওয়াহ, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৭, শরহু মা’আনিল আছার, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৫০, নুখাবুল আফকার পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২৫, শরহু মাআনিল আছার, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৫০, শরহু মুশকিলুল আছার, নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৯)
লক্ষণীয় : এখানে ‘সা’ বলতে উদ্দেশ্য হচ্ছে- রাসূল সা:-এর ‘সা’। ওই ‘সা’-এর পরিমাণ ছিল একজন সাধারণ গঠনের মানুষের দুই হাতভর্তি চার কোষ।
আরো সহজ হিসাব হলো- প্রায় সাড়ে তিন কেজি। আর খাবার হলো মধ্যম মানের যা নিজেরা খেয়ে থাকেন সাধারণত। (মাজমাউল ফতোয়া, ২৫/ পৃষ্ঠা-৬৮, সূরা মায়িদা, আয়াত-৮৯, আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ লিল বুহুসিল ইলমিয়াহ ওয়াল ইফতা, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৬৪)
ফিতরা কাদের দিতে হবে : হানাফি ও শাফেয়ি মাজহাবের আলেমদের মতে, ফিতরা বণ্টন করার খাত ও সম্পদের জাকাত বণ্টন করার খাত অভিন্ন। যিনি জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত তিনি ফিতরা পাওয়ারও উপযুক্ত। (এখানে দলিল হিসেবে সূরা তওবা, আয়াত-৬০ নিয়ে এসেছেন) (দুররে মুখতার, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৯, আসনাল মাতালিব, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০২)
কিন্তু, মালেকি মাজহাবসহ পরবর্তী আরো অনেকে তাদের এ রায়কে বাতিল করেছেন এই মর্মে যে, ফিতরা কাদের দেয়া যাবে এ ব্যাপারে হাদিসে স্পষ্ট তথ্য বিদ্যমান, এ ছাড়া সূরা তওবার ৬০ নং আয়াত হলো জাকাত আদায়ের খাত। সাদকাতুল ফিতর নয়।
সুতরাং তাদের মতে ফিতরাহ প্রদান করা যাবে প্রত্যেক মুসলিম স্বাধীন দরিদ্র (হাশেমি গোত্রের বাইরে ফকির/মিসকিন), মুজাহিদ ও মুসাফির (দেশে পৌঁছানোর জন্য দরিদ্র হিসেবে)। বাকি ঋণগ্রস্ত এবং নওমুসলিমসহ জাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী ইত্যাদি খাতে ফিতরা প্রদান করা জায়েজ নেই। (মাজমাউল ফতোয়া শাইখুল ইসলাম, ২৫/৭১, মাজমাউল ফাতাওয়া ইবনে বায, ১৪/২০২, যাদুল মাআদ, কাইয়িম, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২, হাশিয়াতুদ দুসুকি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৫০৮, মাজমাউল ফতোয়া-২৫/পৃষ্ঠা-৭৩, নায়লুল আউতার ৩-৪/পৃষ্ঠা-৬৫৭, আওনুল মাবুদ ৫-৬/পৃষ্ঠা-৩, শারহুল মুমতি ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮৪)
ফিতরা দেয়ার মতো সামর্থ্য না থাকলে : একান্তই ফিতরা দেয়ার মতো সামর্থ্য না থাকলে তা মওকুফ হয়ে যাবে।
কেননা, ‘আল্লাহ মানুষের সাধ্যাতীত কোনো দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। এ ছাড়া, রাসূল সা: বলেছেন, ‘আপনি যাদের ভরণপোষণ করেন তাদের দিয়ে শুরু করুন।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘সচ্ছলতা ছাড়া কোনো ফিতরা নেই’। (সূরা বাকারা, আয়াত-২৮৬, বুখারি দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১১৭, বুখারি ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯০, মুসলিম দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭১৭, ৭১৮, ৭২১)
প্রবাসী ব্যক্তি ফিতরাহ কোথায় দেবেন : এ ব্যাপারে যথেষ্ট ইখতিলাফ রয়েছে- প্রথম মত হলো : প্রবাসী বা দূর-দূরান্তে অবস্থানরত ব্যক্তি ফিতরা চাইলে দেশে বা গ্রামে আদায় করতে পারবেন। অবস্থানরত জায়গায় না হলেও সমস্যা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০৮, আলবাহরুর রায়েক দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৫০, ফতোয়া তাতারখানিয়া তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৬২, ফতোয়া বাযাযিয়া ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮৯)
দ্বিতীয় মত হলো : ফিতরা ব্যক্তির উপর যে স্থানে ওয়াজিব হয়েছে সে স্থানেই সে পরিশোধ করবে; তার সম্পদ সেখানে থাকুক কিংবা না থাকুক।
অর্থাৎ ফিতরা ব্যক্তির দেহের সাথে সম্পৃক্ত; সম্পদের সাথে নয়। তাই চাঁদ রাতে ব্যক্তি যে স্থানে অবস্থান করবে সে স্থানেই ফিতরা আদায় করবে। (আল-মুগনি/ইবনে কুদামা, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৩৪, মাজমু ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায-১৪/২০০)
মোটামুটি আমরা বলতে পারি যে, প্রবাসীরা নিজ দেশে ফিতরা আদায় করতে পারবেন। তবে সে ক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থানরত জায়গার দ্রব্যমূল্য হিসাব করে দিতে হবে। (মাজমাউল ফতোয়া/বিন বায, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২০৮, ফতোয়ায়ে শামি তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩০৬, ফতোয়ায়ে রাহিমিয়া সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯৫)
ফিতরা কোন সময়ে দেয়া সর্বোত্তম : ফিতরা রমজানের শেষের দিকে ঈদুল ফিতরের আগেই দেয়া সর্বোত্তম। (বুখারি : ১৫০৯, ১৬১০, মুসলিম-৯৮৫, সুনানে ইবনে মাজাহ-১৮২৭)
তবে অনেকে বলেছেন ঈদের পরেও দেয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে সাধারণ দান হিসেবে পরিগণিত হবে। (বুলুগুল মারাম-৬৩০, আবু দাউদ-১৬০৯, ইবনে মাজাহ-১৮২৭)
ফিতরা কি টাকা দিয়ে না খাদ্যদ্রব্য দিয়ে : ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতে, ‘টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় জায়েজ। শুধু জায়েজ তা নয়; বরং উত্তম। কেননা, গ্রহীতা নিজ ইচ্ছেমতো প্রয়োজন মেটাতে পারবেন এই টাকা দিয়ে।
এ ছাড়া হাদিসে খাদ্যের পরিবর্তে কাপড় বা অন্য কিছু দিয়েও ফিতরা প্রদানের ব্যাপার লক্ষ করা যায়। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৪৭২, ১০৪৭১, ১০৪৭৩, আবু দাউদ-১৫১৬, ফাতহুল বারি তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১২, বাদায়েউস সানায়ে দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৬৯, আল মাবসুত লিসসারাখসি তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৩, সুনানুল কুবরা চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮৯)
অনেকে ওই মতের বিপরীত মতামতও দিয়ে থাকেন- রাসূল সা:-এর সময়ে ফিতরা আদায় করা হতো খাদ্যদ্রব্য দিয়ে। সুতরাং খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে। (সুনানে আন নাসায়ি-২৫১৮, বুখারি : ১৫০৩, ১৫০৪, ১৫০৭, ১৫১১, ১৫১২, মুসলিম-৯৮৪, তিরমিজি : ৬৭৫, ৬৭৬, নাসায়ি : ২৫০০, ২৫০১, ২৫০২, ২৫০৩, ২৫০৪, ২৫০৫, ২৫১৬, আবু দাউদ : ১৬১১, ১৬১৩, ১৬১৪, আহমাদ : ৪৪৭২, ৫১৫২, ৫২৮১, ৫৩১৭, ৫৭৪৭, ৫৯০৬, ৬১৭৯, মুয়াত্তা মালেক-৬২৯, দারেমি : ১৬৬১, ১৬৬২, সুনানে ইবনে মাজাহ-১৮২৫, আবু দাউদ : ১৪৩২, ১৪২৮, ইবনে মাজাহ-১৮২৬, ইরওয়াহ-৮৩২)
ইমাম মালেক রহ. বলেন, ‘খাদ্যদ্রব্য ব্যতীত অন্য কিছু বা মূল্য দিয়ে সাদকাতুল ফিতর আদায় করলে তা কবুল হবে না।’ (আল-মুদাওওয়ানা আল-কুবরা দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৮৫)
ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন, ‘খাদ্যবস্তু ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ফিতরা নেই’। (কিতাবুল-উম্ম, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭২)
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. বলেন, ‘ফিতরার খাদ্যমূল্য প্রদান করবে না’। সুতরাং, আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, যে দেশে যে খাদ্য বেশি প্রচলিত সেটিই দেয়া উত্তম; বরং অপ্রচলিত খাদ্য দানকে ফকিহরা নিরুৎসাহিত করেছেন। (মাজমাউল ফতোয়া, ২৫/পৃষ্ঠা-৬৮, ইলামুল মুওয়াক্কিয়িন, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২, আশ-শারহুল মুমতি ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮৩, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা-১০৪৭২, কিতাবুল আছল-২/১৮০, আলমাবসুত, সারাখসি-৩/১১৪, ফতোয়া ওয়ালওয়ালিজিয়া-১/২৪৭, ফতোয়া তাতারখানিয়া-৩/৪৫৫)
লেখক : শিক্ষক ও প্রবন্ধকার, টেকনাফ, কক্সবাজার


আরো সংবাদ



premium cement