১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রাজবাড়ীর পদ্মার চরে রাসেল ভাইপার আতঙ্ক, বাদাম তুলতে মিলছে না শ্রমিক

রাসেল ভাইপারের দংশনে আহত ব্যক্তি - ছবি : নয়া দিগন্ত

রাজড়ীর পাংশার পদ্মার চরাঞ্চলে আতঙ্কের নতুন নাম রাসেল ভাইপার। শুক্রবার দুপুরে পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের পদ্মার চর আফরা গ্রামে মাঠ থেকে বাদাম তুলতে গিয়ে মধু বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তি রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ের শিকার হয়োছেন।

আহত মধু বিশ্বাস এখন পাংশা হাসপাতালে চিকতসাধীন আছেন। এ অবস্থা দেখে ওই মাঠে কাজ করতে যাওয়া অন্যান্য কৃষি শ্রমিকরা তাৎক্ষনিক মাঠ থেকে পালিয়ে যায়। এখন বাদাম তোলার ভরা মওসুমে সাপের ভয়ে বাদাম তোলার জন্য কোনো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে জীবনের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে জমির মালিকরাই বাদাম তুলছেন।

উপজেলার হাবাসপুর,বাহাদুরপুর ও কালিকাপুর ইউনিয়নের পদ্মার চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, জেগে উঠা ধু ধু বালুচরে বাদাম তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন কিষাণ-কিষাণিরা। মধু বিশ্বাসের সাপে কাটার খবর ছড়িয়ে পরলে সব মাঠ থেকে সটকে পড়ে শ্রমিকরা।

রাজবাড়ীর পদ্মার চরাঞ্চলের বেলে মাটি বাদাম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে এ বছর প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে ফলন আশানুরূপ হয়নি। সম্প্রতি পদ্মার পানি বেড়ে গিয়ে বাদাম ক্ষেতে ঢোকায় অপরিপক্ব বাদামও তুলতে হচ্ছে। এতে পুরুষের চেয়ে নারীদেরই বেশি দেখা যায়। প্রথমে ক্ষেত থেকে বাদাম তোলা হচ্ছে, এরপর ক্ষেতেই গাছ থেকে বাদাম কাটা হচ্ছে। তারপর নৌকায় করে নদী পার হয়ে বাদাম নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাড়িতে।

বাদাম চাষী লিটন মেল্লা জানান, বাদাম লাগানোর সময় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা মণ দরে বাদাম কিনে লাগাতে হয়েছে। বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। বিঘায় উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল ১০ থেকে ১৫ মণ। কিন্তু এ বছর ফলন হয়েছে ৫ থেকে ৮ মণ। দাম ভালো না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তারা।

এদিকে, সম্প্রতি চরাঞ্চলে রাসেল ভাইপারের উপদ্রব বেশি হওয়ায় ভয়ে অনেকেই ক্ষেতে যাচ্ছেন না। বাদাম তুলতে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে জমির মালিকরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্ষেতে নেমে পড়ছেন।

বাদাম চাষী ছালাম সেক বলেন, সম্প্রতি রাসেল ভাইপারের উপদ্রব বেড়ে গেছে। গত ছয় মাসে সাপের কামড়ে মারা গেছে পাঁচজন। আজ শুক্রবার আরো একজনকে সাপে কেটেছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই শ্রমিকরা পালায়। এ কারণে কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ভয়ে কেউ ক্ষেতে নামতে চাইছে না। বাধ্য হয়ে নিজেদেরই বাদাম তুলতে হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, চরাঞ্চলের মানুষের অন্যতম আয়ের উৎস বাদাম চাষাবাদ। এর ওপরই সারা বছরের সংসার খরচ চলে। সে কারণে ঝুঁকি নিয়েই বাদাম তুলতে হচ্ছে।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্ষেতে বাদাম তুলতে এসেছেন বিধবা সামেলা। তিনি বলেন, প্রচণ্ড দাবদাহে এমনিতে বাদামের ফলন এ বছর ভালো হয়নি। তার ওপর আবার পদ্মার পানি বাড়ায় ক্ষেতে ঢুকে গেছে। এতে অপরিপক্ব বাদাম তুলে ফেলতে হচ্ছে। এখন যাও পাওয়া যাবে, পানিতে ডুবে গেলে কিছুই পাওয়া যাবে না। তাই স্বামীর সঙ্গে বাদাম তুলতে এসেছি।

তিনি আরো বলেন, সাপের ভয়ে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। অনেককে বলেছি। কিন্তু কেউ রাজি হয়নি। এ কারণে পরিবারের সবাই মিলে বাদাম তুলছি। কী করব, বাদামই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। তাও এবার ফলন ভালো না হওয়ায় মন খারাপ। তবে দাম যদি একটু বেশি পাই তাহলে লোকসান হবে না। বাদাম থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই সারা বছর সংসার চলে।

শহিদুল পাটাদার বলেন, আমি মানুষের বাড়িতে গিয়ে কাজ করি। বাদাম তোলার সময় প্রতি বছরই এ কাজ করি। বেতন ভালো পাই। এ বছরও বাদাম তুলতে আইছি, কিন্তু ভয় লাগে সাপের। বাড়িতে কাজ করার চেয়ে বেশি টাকা পাই, তাই আইছি। বয়স হয়েছে, আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে আইছি। যদি সাপের কামড়ে মরে যাই যাব, কিন্তু কাজে না এলে খাব কী, চলব কীভাবে! ঘরে বসে থাকলে তো আর কেউ খাবার দেবে না। দুমুঠো খাবারের জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাদাম ক্ষেতে এসেছি।

উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মামুন মিয়া বলেন, দাবদাহের কারণে বাদাম এবং তিলের ফলন ভালো হয়নি। পাশাপাশি পদ্মার পানি বাড়ায় তীরবর্তী এলাকার বাদাম ক্ষেতে পানি ঢুকেছে। তাড়াহুড়ো করেই বাদাম তুলে ফেলতে হচ্ছে চাষিদের। এ ছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা রাসেল ভাইপারের কারণেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। চরাঞ্চলের বেশ কয়েকজন সাপের কামড়ে মারা যাওয়ায় অনেকে ভয়ে ক্ষেতে যেতে চাচ্ছে না।

তিনি আরো বলেন, আমি বিভিন্ন কাজে পাংশা থাকি প্রায় সময়, কিন্তু আমি নিজে যখন চরাঞ্চলে যাই, তখন নিজেও ভয়ে ভয়ে থাকি। রাসেল ভাইপার এমনিতে দেখা যায় না। হঠাৎ করেই চলে আসে। অন্য সাপ মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়। কিন্তু রাসেল ভাইপার মানুষ দেখলে এগিয়ে আসে। আমরাও খুব চিন্তিত। ইউনিয়নব্যাপী রাসেল ভাইপারের বিষয়টি নিয়ে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ বলেন, উপজেলায় এ বছর ৩ হাজার হেক্টর জমিতে বাদামের আবাদ হয়। যা গেল বছরের তুলনায় ১৩০ হেক্টর বেশি।

তিনি আরো বলেন, যারা আগাম বাদাম লাগিয়েছিলেন তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। তবে পরে যারা বাদাম লাগিয়েছেন পদ্মার পানি বাড়ায় তাদের কিছুটা ক্ষতি হতে পারে। অবশ্য তা হবে খুবই সামান্য। চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, বৃষ্টির মধ্যে যাতে বাদাম না তোলে। রোদের মধ্যে বাদাম তুললে কালারটা ভালো থাকবে। এ ছাড়া রাসেল ভাইপার থেকে বাঁচতে কৃষকদের ক্ষেতে মশার কয়েল জ্বালিয়ে কাজ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ ধোঁয়া সাপের চোখে গেলে সেখান থেকে দ্রুত তারা সরে যায়। কৃষকরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে সফলও হচ্ছে। তা ছাড়া চাষিদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, রাসেল ভাইপারের সাপের বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে কাজ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রথম অবস্থায় চরাঞ্চলে কৃষকদের বিশেষ জুতা (গামবুট) দেয়া হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement