২১ মে ২০২৪, ০৭ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫
`


কটিয়াদীতে কালের সাক্ষী ৫০০ বছরের কোটামন দিঘি

- ছবি : নয়া দিগন্ত

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজা নবরঙ্গ রায় এবং তার স্ত্রী কোটামন রায়ের স্মৃতি বিজড়িত ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী কোটামন দিঘি।

এলাকায় জনশ্রুতি আছে, সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার স্ত্রী কোটামন রায়কে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। তাই একদিন রাজার স্ত্রী কোটামন রায় রাজার কাছে তার মনোবাসনা ব্যক্ত করলেন যে তার একান্ত ইচ্ছা বড় দিঘিতে গোসল করার।

বিভিন্ন তথ্য সূত্র ও স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, জনশ্রুতিতে আছে ষোল শ’ শতকে চারিপাড়া সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ের স্ত্রীর নাম ছিল কোটামন রায়। কোটামন রায়ের বড় দিঘিতে গোসল করার ইচ্ছে হলে তা রাজার কাছে ব্যক্ত করেন। স্ত্রীর মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য রাজা নবরঙ্গ রায় ৩০ একর জায়গা নিয়ে বিশাল দিঘি খনন করেন এবং স্ত্রীর নামানুসারেই দিঘিটির নামকরন করেন কোটামন দিঘি। এই কোটামন দিঘি নিয়ে এখনো লোকমুখে নানান কাহিনী শুনা যায়। দিঘির পানি থেকে থালা, বাসন, কলসী, জগ, গ্লাস ইত্যাদি দিঘির পাড়ে উঠে আসতো। এলাকাবাসী বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানে এসব ব্যবহার করতেন। কোনো এক সময়ে একজন মহিলা ছোট একটি গ্লাস শাড়ীর আঁচলে লুকিয়ে রাখার ইচ্ছে করলে বাকিগুলো আর দিঘির পানিতে নেমে যেতে চাইনি। গ্লাস ফেরত দেয়ার পর সবগুলো দিঘির জলে চলে যায়। এরপর থেকে এসব থালা, বাসন, জগ, কলসী, গ্লাস ইত্যাদি আর উঠে আসেনি। খাবারের শেষে যথাস্থানে আবার রেখে দেয়ার রেওয়াজ ছিল।

দিঘিটি নিয়ে দু’টি কথা প্রচলন রয়েছে। এদের একটি কথা হচ্ছে, রাজা স্বপ্নে দেখেন এই অঞ্চলে পানির সঙ্কট হয়ে তীব্র খরা দেখা দিতে পারে। সেই জন্য তিনি পানি সংরক্ষণের জন্য বড় দিঘি খনন করেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিনি খুবই প্রতাপশালী ও অত্যাচারী রাজা ছিলেন।

অন্য কথা হচ্ছে, সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার বিবি কোটামন রায়কে অনেক ভালোবাসতেন। নিজের সহধর্মিণীর প্রতি অগাধ প্রেম ও ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ খনন করেন বিশাল এই দিঘিটি। আজো কোটামন দিঘিটি এলাকার মানুষদের নিকট স্মৃতি হয়ে টিকে আছে। এই স্বচ্ছ পানির দিঘিটি কটিয়াদীর সবচেয়ে মনোরম পর্যটন আকৃষ্ট স্থান।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে সড়কের পাশেই আচমিতা ইউনিয়নের চারিপাড়া গ্রামে ৫০০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত কোটামন দিঘি অবস্থিত। দিঘিতে ঢুকতেই গেট ও পাকা রাস্তা আর সবুজ ঘাসের আবরণ, যা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। নয়নাভিরাম এই দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে আসেন অনেক মানুষ। বর্তমানে এই দিঘিটি সংরক্ষিত এলাকা ও প্রবেশের কড়াকড়ি থাকায় পর্যটকরা পরিদর্শন করতে পারছেন না।

জানা যায়, ১৬০০ শতাব্দীতে কিশোরগঞ্জের যশোদল অঞ্চলের রাজা বাবা গোবর্ধন আইনের নামে রাজা নবরঙ্গ রায় আচতিমা গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আচমিতার নিকটবর্তী চারিপাড়া গ্রামে রাজা নবরঙ্গ রায় স্বীয় বাসভবন ও প্রধান শাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত পুঁথিকার মুন্সি আবদুর রহিমের পুঁথিতে এর উল্লেখ আছে।

‘নবরঙ্গ রাজা ছিল যশোদলে বাস আছিল প্রতাপি অতি দেশেতে প্রকাশ। তাহাতে আমির খাঁ সবংশে বদিয়া’ পুঁথির বর্ণনা মতে এবং ঐতিহাসিক কেদারনাথ মঞ্জুমদারের ময়মনসিংহের গ্রন্থে ঈশা খাঁর সমসাময়িক তালুক আমির খাঁ রাজা নবরঙ্গ রায়ের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। যুদ্ধে সপরিবারের রাজা নবরঙ্গ রায় নিহত হন। রাজার ১৩তম বংশধর দীগেন্দ্র রায় চৌধুরীর কোনো সন্তান না থাকায় সর্বশেষ দত্তক বংশধর ছিলেন স্বদেশ রঞ্জন রায় চৌধুরী।

উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি ছিলেন রাজার রাজপ্রাসাদ ও কোটামন দীঘির মালিক। তিনি ১৯৮২ সালে স্থানীয় শিল্পপতি আশরাফ উদ্দিন আহমেদ ওরফে মেনু মিয়ার কাছে বিক্রি করে ভারত চলে যান। সেই থেকে আশরাফ আহমেদের পরিবার বিশাল এই জায়গাটি ভোগদখল করে আসছেন। বর্তমানে জনসাধারণের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

রাজপ্রাসাদ ও বাড়িটি আট একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাজপ্রাসাদের সামনেই অবস্থিত কোটামন দিঘি। রাজবাড়ির পেছনের পুকুর পাড়েই ছিল রাজপ্রাসাদের প্রাচীন অট্টালিকা যা আজ নেই। পরবর্তী সময়ে যা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। রাজার বংশধরদের নির্মাণাধীন কারুকার্যমণ্ডিত বৈঠকখানাও রাখা হয়নি।

কোটামন দিঘির চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, বাহারি হাজারো ফল গাছ, ফুলের বাগান, আম ও লেবু বাগান রয়েছে। রাজবাড়ি ও কোটামন দিঘির মাঝখানে রয়েছে সৌন্দর্যমণ্ডিত বাগান। সেখানে বিভিন্ন জীবজন্তুর ভাস্কর নির্মাণ করা হয়। অনেক বিদেশী অতিথিও কোটামন দিঘি পরিদর্শন করেছেন।

ঐতিহাসিক কোটামন দিঘিতে পর্যটকদের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।


আরো সংবাদ



premium cement