০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বত্রিশ বছর পরে আজকের হামাস

-

হামাস আগ্রাসী ইসরাইলের বিরুদ্ধে মজলুম ফিলিস্তিনিদের দুর্বার এক প্রতিরোধ আন্দোলনের নাম। ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা বা পিএলও যে স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা পূরণ করতে না পারায় বত্রিশ বছর আগে ১৯৮৭ সালে হামাস নামে নতুন এক দলের উৎপত্তি হয়।
পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে পিএলও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সম হয়েছিল। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পিএলও ছিল দুর্দান্ত এক মিলিট্যান্ট সংগঠন। কিন্তু জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবে আরাফাত তথা পিএলও অস্ত্র পরিত্যাগ করে ইসরাইলের সাথে শান্তি আলোচনায় বসে। ১৯৯৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল কিনটনের মধ্যস্থতায় অসলো শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেন ইয়াসির আরাফাত। আর এর বিনিময়ে তিনি পান নোবেল পুরস্কার।
এই চুক্তি সম্পর্কে ফিলিস্তিনের এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন, ‘অসলো চুক্তি শুধু ফিলিস্তিনি দুর্বলতার প্রকাশই নয়, বরং বড় ধরনের অযোগ্যতা এবং ভুল হিসাবের কারণে হয়েছে, যার ফলাফল ভয়ঙ্কর হতে পারে। আরাফাত যে একটা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পাননি, তা বুঝতেও তার এক বছরের মতো সময় লেগেছে।’
এরপর ইসরাইল আলোচনার নামে সময়পেণ করে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল অব্যাহত রাখে আর অবৈধ বসতি স্থাপনের কাজ চলে জোর গতিতে। আলোচনার ফলাফল ফিলিস্তিনি জমিতে নতুন নতুন ইহুদি বসতি। আজকের পশ্চিম তীরে জালের মতো ছড়িয়ে আছে ইহুদিবসতি।
ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলো মানে পশ্চিম তীর ও জেরুসালেম অঞ্চল মৌমাছির মৌচাকের মতোই ইহুদি বসতিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। পিএলও অস্ত্র পরিত্যাগ করে শান্তি আলোচনায় মনোযোগী হওয়াতে পশ্চিমা নেতাদের বাহবা কুড়ালেও উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন করতে না পারায় তখন থেকেই ফাতাহর য় শুরু হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই শূন্যস্থান পূরণে উত্থান ঘটে ফাতাহর চেয়ে আরও সাহসী ও দুর্দান্ত যোদ্ধাদের সংগঠন হামাসের।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইসরাইল ও জাপান হামাসকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সৌদি আরব, মিসর, আরব আমিরাতসহ আরও কিছু আরব দেশ হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবেই বিবেচনা করে।
অন্য দিকে ইরান, সিরিয়া, কাতার, তুরস্ক, রাশিয়াসহ বিশ্বের আরও বিভিন্ন দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন নয় বরং একটি স্বাধীনতাকামী ও প্রতিরোধকামী সংগঠন হিসেবেই দেখে। হামাসের রাজনৈতিক শাখার পাশাপাশি আল কাসসাম ব্রিগেড নামে একটি সামরিক শাখা আছে। এই শাখাটিই মূলত ইসরাইলের সাথে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধরত।
হামাস শব্দের অর্থ ‘উদ্দীপনা’। হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ফিলিস্তিনি ধর্মীয় নেতা শেখ আহমাদ ইয়াসিন। শেখ আহমেদ ইয়াসিন ছিলেন একজন পঙ্গু মানুষ এবং প্রায় অন্ধ ছিলেন। তিনি চলাফেরা করতেন হুইল চেয়ারে করে। যখন তার বয়স ১২ বছর তখন তিনি একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিবন্ধী হন। তিনি মিসরে লেখাপড়ার পর ফিলিস্তিনে ফিরে এসে প্রতিষ্ঠা করেন হামাস। ২০০৪ সালের ২২ মার্চ ভোরে বাসা থেকে ১০০ মিটার দূরের মসজিদে হুইল চেয়ারে করে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। ওই সময় ৬৪ অ্যাপাচি হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে পেণাস্ত্র নিপে করে শেখ আহমাদ ইয়াসিনকে হত্যা করে ইসরাইল। এ সময় তার সাথে থাকা বডিগার্ডসহ আরও ৯ জন পথচারী নিহত হন।
শেখ আহমাদ ইয়াসিনের মৃত্যুর কিছু দিনের মধ্যে ইসরাইল একই প্রক্রিয়ায় হত্যা করে হামাসের সদ্য নতুন প্রধান আবদুল আজিজ আল রানতিসিকে। দিনটি ছিল ১৭ এপ্রিল ২০০৪। রানতিসি একজন চু বিশেষজ্ঞ ছিলেন। শুরুতে এমনকি ইয়াসির আরাফাত জীবিত থাকাকালে হামাসের তেমন কোনো পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা ছিল না। কিন্তু ফাতাহর ব্যর্থতাই ছিল হামাসের সফলতা। তবে ইয়াসির আরাফাত জীবিতকালীন পর্যন্ত হামাসের সাথে ফাতাহর কোনো দ্বন্দ্বও ছিল না। কিন্তু দ্বন্দ্ব শুরু হয় তখনই যখন ২০০৬ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হামাস বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় এবং নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এ নির্বাচনে পশ্চিমারা পর্যবেক ছিল। পশ্চিমারা বলেছিল, তারা নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নেবেন। কিন্তু হামাস জয়ী হবে তারা তা কল্পনাও করতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পশ্চিমাবিশ্ব একযোগে ঘোষণা করে, হামাস যত দিন সরকার হিসেবে থাকবে তত দিন তারা ফিলিস্তিনিদের কোনো সাহায্য সহযোগিতা করবে না। অন্য দিকে ইসরাইলকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে যাবে। ফাতাহ তথা মাহমুদ আব্বাসও সুযোগ খুঁজছিলেন হামাসকে কিভাবে মতা থেকে উৎখাত করা যায়। অনেক টানাপড়েনের পর ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাহমুদ আব্বাস হামাস সরকারকে বরখাস্ত করেন এবং তার নিজ দল ফাতাহ দ্বারাই সরকার গঠন করেন। স্বভাবতই নির্বাচনে বিজয়ী হামাস তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। ফলে দু’পরে সংঘর্ষের ফলে ফিলিস্তিন হয়ে পড়ে দুই ভাগ। সেই থেকে পশ্চিম তীর শাসিত হচ্ছে মাহমুদ আব্বাসের দল ফাতাহ দিয়ে, আর গাজা শাসিত হচ্ছে হামাস দিয়ে।
ইসরাইল তার আসল আধিপত্যবাদী অস্তিত্বের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক মনে করে হামাসকে। তাই হামাস গাজার শাসনভার কাঁধে তুলে নেয়ার পর থেকেই ইসরাইল অবরোধের মাধ্যমে এ ুদ্র জনপদের ১৫ লাখ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফলে অসহায় গাজাবাসী বিনা দোষে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। গাজায় যাতে কোনো পণ্যসামগ্রী এমনকি খাদ্য পর্যন্ত ঢুকতে না পারে ইসরাইল কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করে আর এ কাজে সহযোগিতা করে আসছে মিসর।
বহির্বিশ্বের সাথে গাজার একমাত্র সংযোগ পথটি হলো রাফা ক্রসিং যা মিসরের নিয়ন্ত্রণাধীন। গাজাবাসীকে এ পথ দিয়ে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগে সাহায্য করে মিসর। কিন্তু তা হোসনি মোবারকের আমল থেকেই বন্ধ ছিল। মোহাম্মদ মুরসির আমলে সেই পথ খুলে দেয়া হলেও এখন আবার বন্ধ। ফিলিস্তিনের আর বাকি দিক ইসরাইল দ্বারা পরিবেষ্টিত ও এক দিকে সাগর।
হামাসের উদ্দেশ্য হলোÑ গাজা, ইসরাইল ও ওয়েস্ট ব্যাংক নিয়ে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আর ইসরাইল চায় সম্পূর্ণ ফিলিস্তিনসহ পাশের দেশগুলো দখল করে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করা। ইসরাইলের প্রচুর জমি দরকার, কারণ ইসরাইল বিশ্বের সমগ্র ইহুদিদের নিজ নাগরিক মনে করে। তারা মনে করে, একদিন বিশ্বের সমগ্র ইহুদি সম্প্রদায় একত্রিত হবে আর প্রতিষ্ঠা করবে বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র।
ইসরাইলের কারাগারে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছে। এমন অনেকেই আছেন যাদের শিশুকালে ইসরাইল ধরে নিয়ে গেছে আর কারাগারেই বাকি জীবনটা পার করে দিয়েছেন। আর হামাস বা ফাতাহর তো হাজার হাজার নেতাকর্মী সমর্থক ইসরাইলি কারাগারে বন্দী আছেন আর গুপ্তহত্যার মাধ্যমে এ পর্যন্ত কতজন যে মারা গেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর পূর্ণ করে ৩৩ বছরে পা রেখেছে হামাস। ১৪ ডিসেম্বরকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবস হিসেবে পালন করে হামাস। এবারের বর্ষপূর্তিকে ‘দ্য এজ অব দ্য সোর্ড’ (তলোয়ারের প্রান্ত) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সংগঠনটি। সম্প্রতি ইসরাইলি বাহিনীর স্পেশাল ইউনিটের বড় একটি পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয় হামাস। ধরা পড়ে বেশ কিছু গুপ্তচর। এ ঘটনাকে মনে রেখে এবারের প্রতিষ্ঠাবাষির্কীকে ‘এজ অব দ্য সোর্ড’ নামকরণ করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement