অপরাধ কেন কমে না
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩১ মার্চ ২০২৪, ২১:৩৫
পুলিশে জনবল বাড়ে, আধুনিক প্রযুক্তি যোগ হয়। কিন্তু অপরাধ কমে না। উল্টো বাড়ে। তার সাথে যুক্ত হচ্ছে অপরাধের নতুন ধরন। আর এই সময়ে পুলিশের মাথা ব্যথা হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং।
পুলিশ সদর দফতরের হিসাব বলছে, ২০২৩ সালে দেশে ৩ হাজার ২৮টি হত্যা ও ৫ হাজার ২০২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে।
প্রচলিত অপরাধ যেমন ডাকাতি, চোরাচালান ও অপহরণ বাড়ছে। কমছে না হত্যা , ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ। অনলাইন প্রতারণা, ই-কমার্সের নামে প্রতারণা, অনলাইন জুয়ার মত অপরাধ নতুনভাবে ভাবাচ্ছে পুলিশকে। আবার পুলিশের এক শ্রেণির সদস্য নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সমাজে অস্থিরতা যেমন এর একটি কারণ। তেমনি পুলিশ এখন অপরাধ দমন ছাড়াও আরো অনেক কাজে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। এর বাইরে বিচারহীনতার সংস্কৃতিও বড় একটি কারণ বলে তারা মনে করছেন।
তবে পুলিশি কর্মকর্তারা বলছেন বেশ কিছু অপরাধ তারা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি অপরাধীদের বেপরোয়া করেছে। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে তারা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
গত বছর সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে মোট মামলা হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৩৬টি। আগের বছর মামলা হয়েছিল ২ লাখের বেশি। আর ২০২১ সালে ১ লাখ ৯৭ হাজারের বেশি।
পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে দেশে ৩ হাজার ২৮টি হত্যা ও ৫ হাজার ২০২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে আটটির বেশি হত্যা এবং ১৪টির বেশি ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর ওই বছর নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১১ হাজার ৩৭টি। প্রতিদিন ৩০টির বেশি নারী নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে পুলিশের কাছে।
২০২১ সালে ডাকাতির ঘটনা ঘটে ৯৭১টি। সেখানে ২০২২ সালে ১ হাজার ১২৮টি এবং ২০২৩ সালে এক হাজার ৩৮৪ টি ডাকাতির ঘটনা পুলিশ রেকর্ড করেছে।
২০২২ সালে অপহরণের মামলা হয়েছে ৪৬৩টি আর ২০২৩ সালে ৪৬৬টি।
২০২৩ সালে চোরাচালানের মামলা হয়েছে ২ হাজার ৫০০টি আর ২০২২ সালে মামলা ২১৪ টি কম ছিল। মোট মামলার সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৪৬টি।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালে চুরি, দ্রুত বিচার, ডাকাতি, অ্যাসিড নিক্ষেপ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনেদেশে মোট মামলা হয় ৮৯ হাজার ৮০৯টি। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৯৬ হাজার ৬২২।
২০২৩ সালে এককভাবে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। এ বছর সারা দেশে মাদকসংক্রান্ত মামলা করা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪১৮টি। আগের বছর এ আইনে মামলা হয় ৮২ হাজার ৬৭২টি।
দেশের রাজধানী ঢাকায় অপরাধ সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় ২৫ হাজার ৪৯টি মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ মহিদ উদ্দিন বলেন,‘বছরের পরিসংখ্যান আসলে আপস অ্যান্ড ডাউন হয়। কখনো বাড়ে, কখনো কমে। তবে পরিসংখ্যানের চেয়ে বড় ব্যাপার হলো পারসেপশন। মানুষ কী মনে করে। মানুষ আগের চেয়ে অনিরাপদ বোধ করে না। নিরাপদ বোধ না করলেও তারা যে খুব খারাপ মনে করে এই ধরনের তথ্য কিন্তু আমাদের কাছে নেই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন,‘অপরাধ নিয়ে যখন বাণিজ্য হয় তখন আপনি পুলিশে জনবল বাড়িয়েও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বা কমাতে পারবেন না। এখানে বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীর সাথে পুলিশের এক শ্রেণির অসাধু সদস্যের যোগাযোগের অভিযোগ আছে। আবার পুলিশ নিজেও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।’
তার কথায়,‘পুলিশ আবার আইন শৃঙ্খলা এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে রাজনীতি, ব্যক্তি এসব বিষয়কেও প্রাধান্য দেয়। যেখানে অর্থের যোগাযোগ আছে সেখানে এখন অপরাধ বেশি। আর এই অর্থেও দ্বারাও কোনো কোনো পুলিশ সদস্য নিয়ন্ত্রিত হয়।’
পুলিশের সাবেক ডিঅজি সৈয়দ বজলুল করিম বলেন,‘পুলিশের দক্ষতার চেয়েও বড় সমস্যা হলো এখন মনিটরিং-এর অভাব। এখানে অধস্তনরা কী করেন ওপরের কর্মকর্তরা তার খোঁজ রাখেন না। এসপি সাহেবরা তো এখন বাইরে বের হতে যেন লজ্জা পান। হাইওয়েতে ডাকাতি হয় পুলিশ তার ডিউটিতে থাকে না। এখন পুলিশের সম্পর্ক হয়ে গেছে বিত্তের সাথে।’
তিনি জানান,‘আমাদের লোকজনও তো নানা সহায়তা নিতে থানায় যান। পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা হওয়ায় আমাদের কাছে আসলে আমরাও থানায় পাঠাই। কিন্তু অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। ডিবি (গোয়েন্দা বিভাগ) তো এখন পুরাই দোকান হয়ে গেছে।’
তার কথায়,‘পুলিশ সম্পর্কে মানুষ ভালো কথা বলে না। আমরা নিজেরাই বিব্রত।’
আর আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, মানবাধিকার কর্মী ফারুক ফয়সাল বলেন,‘পুলিশ তো আর পুলিশের কাজে নাই। সে তো এখন অন্য কাজে ব্যস্ত। ফলে অপরাধ কমছে না।’
তার মতে,‘সমাজে রাজনৈতিকসহ নানা ধরনের অস্থিরতা বাড়ছে। ফলে অপরাধও বাড়ছে। আর বিচারহীনতার কারণে অপরাধীরা আরো উৎসাহিত হচ্ছে।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব মনে করেন, ‘পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়। তারা এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। তারা আগেই অপরাধী চক্রকে চিহ্নত করে অপরাধ কখনো কখনো থামিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে।’
তার কথায়,‘এই সময়ে অপরাধ বাড়ার পেছনে কিশোর গ্যাং এবং মাদকের একটা বড় ভূমিকা আছে। সেক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের একটা বড় দায়িত্ব আছে।’
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ মহিদ উদ্দিন বলেন,‘আমরা এই সময়ে কিশোর গ্যাং নিয়ে নানা কাজ করছি। তাদের কারণে অপরাধ বাড়ছে। আমরা তাদের আইনের আওতায় আনা ছাড়াও সামাজিক সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি পালন করছি। আর আমরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও অপরাধীরাও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ করছে।’
তার কথায়,‘নাগরিকদের দায়িত্ব আছে। তারা যেন তাদের জানা অপরাধের খবর আমাদের জানান। কোনো অপরাধ হলে ঠিক সময়ে যেন পুলিশকে জানান। ৯৯৯ নাম্বার আছে সেখানে যেন অভিযোগ করেন।’
সূত্র : ডয়েচে ভেলে
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা