১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ভারতকে হারিয়ে ‘চোকার্স’ তকমা মুছতে চায় দ.আফ্রিকা

ভারতকে হারিয়ে ‘চোকার্স’ তকমা মুছতে চায় দ.আফ্রিকা - সংগৃহীত

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২৪-এর ফাইনাল ম্যাচে মুখোমুখি হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত। দশ বছর পর এই আসরের ফাইনালে উঠলো ভারত, এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম শীর্ষ কোনও পুরুষ দলের আইসিসি ইভেন্টের ফাইনালে উঠলো।

বারবাডোজে বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ৮টা ৩০ মিনিটে এই ম্যাচটি শুরু হতে যাচ্ছে। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার নারী ক্রিকেট দল নারীদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিল।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ট্রফির দিক থেকে ভারত সমৃদ্ধ। ১৯৮৩ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু, ২০০৭ -এ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১১ সালে আবারো ওয়ানডে বিশ্বকাপ এবং ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিল দলটি।

এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রফি ক্যাবিনেট ফাঁকা। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত নক আউট কাপ ছাড়া আর কিছুই জেতা হয়নি দলটির, ফাইনাল খেলা তো এই প্রথম।

একের পর এক সেমিফাইনালে বাদ পড়ার ইতিহাস ছিল দলটির। এবারে অষ্টম সেমিফাইনালে এসে দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনালে উঠতে পারলো।

দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত দুই দলই এই টুর্নামেন্টে এখনো কোনো ম্যাচে হারেনি।

ভারত ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের পরে শিরোপা জয়ের অনেক কাছে গিয়েও বারবার ফিরে এসেছে।

২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল, ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনাল, ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল এবং সর্বশেষ ২০২৩ -এর ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে হারের পর এবারে আরো একটা ফাইনাল খেলতে মাঠে নামবে ভারত।

ভারতের অন্যতম শক্তির জায়গা রোহিত শর্মা ও ভিরাট কোহলি। এ দু’জন গত এক দশকে ভারতের সব সফলতা ও ব্যর্থতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন।

এবারে মনে হয় দুই দলের গায়ে চোকারের তকমা আছে, দুই দলই কাছে গিয়ে অনেক কিছু হারিয়েছে।

ব্রিজটাউনে আবহাওয়া কেমন?
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২৪- এর ফাইনালে বাগড়া বসাতে পারে বৃষ্টি। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় একটা ঝড় ধেয়ে আসছে ব্রিজটাউনের দিকে, ম্যাচের সময় এর প্রভাব থাকতে পারে বলে জানা গেছে।

তবে এখনই দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলছে বারবাডোজের আবহাওয়া অধিদফতর। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী ঝড় স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে রোববার বা সোমবার সকালে। তবে এই ঝড়ের আগের কিছু বৃষ্টি নিয়ে আসতে পারে বাতাসের সাথে।

বারবাডোজের আবহাওয়া অধিদফতরের ওয়েবসাইট বলছে, ‘বৃষ্টি এবং সম্ভাব্য বজ্রঝড়ের ফলে কিছু ব্যাঘাত ঘটতে পারে।’

ফাইনাল ম্যাচের জন্য একটা অতিরিক্ত দিন রয়েছে। শনিবার ম্যাচ শেষ না হলে, রোববার মাঠে গড়াবে খেলা। সেমিফাইনাল ও ফাইনালের জন্য আইসিসি নিয়ম করেছে অন্তত ১০ ওভার খেলতে হবে দু’দলকেই।

সেটি না হলে কোনো ফলাফল আসবে না ম্যাচের। ম্যাচের দিন এবং অতিরিক্ত দিনেও যদি এই দুই দল অন্তত ১০ ওভার করে ব্যাট করতে না পারে, সেক্ষেত্রে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হবে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে।

কেন দক্ষিণ আফ্রিকা আলাদা?
ম্যাচ অনুকূলে থাকার পরেও শেষ পর্যন্ত নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে পরাজিত হবার বহু রেকর্ড রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার। এজন্য ক্রিকেট মহলে দলটি ‘চোকার্স’ হিসেবে পরিচিতি।

১৯৯৯ সালে শেষ বলে এক রান নিতে গিয়ে অ্যালান ডোনাল্ড দৌড় শেষ করতে পারেননি। এর আগে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে বৃষ্টির পর হিসেব-নিকেশে দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন এক বলে ২২ রান। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও দক্ষিণ আফ্রিকা বৃষ্টির পরে আর খেলা ধরে রাখতে পারেনি।

সর্বশেষ ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে দুর্দান্ত কায়দায় সেমিফাইনালে ওঠার পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হেরে যায় দলটি। ডেভিড মিলার একা লড়াই করেন।

তবে এই বিশ্বকাপের দক্ষিণ আফ্রিকা যেন আলাদা। সেমিফাইনালে আফগানিস্তানকে পাত্তাই দেয়নি দলটি।

এর আগে প্রতিটি ম্যাচেই জয় পেয়েছে ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং আমেরিকার বিপক্ষে। গ্রুপ পর্বে একেবারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ম্যাচগুলো বের করে এনেছে দলটি।

দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে নেপালের ২ বলে ২ রান দরকার ছিল। এই ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকা জিতে নিয়েছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে চার রানে।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ১২ রানে চার উইকেট চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে ম্যাচে ফিরিয়েছেন হেইনরিখ ক্লাসেন ও ডেভিড মিলার।

দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথমবারের মতো কোনো পুরুষ দলের আইসিসি ইভেন্টের ফাইনালে তুলে অধিনায়ক এইডেন মারক্রাম বলেন, ‘আমরা এবার এমন কিছু মুহূর্ত জিতে নিয়েছি সেগুলো আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। এখন আমরা মনে করি, যেকোনো পরিস্থিতি থেকে জয় সম্ভব’।

যাদের ম্যাচ আমেরিকার মাটিতে ছিল তাদের অনেকের ব্যাটিং পরিসংখ্যানই এবারে হতশ্রী, মারক্রাম নিজে ব্যাট হাতে মাত্র ১৭ গড়ে ১০০ এর কিছু রান বেশি করেছেন। তবে এটা ভাবনার বিষয় নয় বলছেন তিনি।

মারক্রাম ফাইনাল ম্যাচের আগে প্রেস কনফারেন্সে বলেন, ‘সত্যিই এটা ব্যাটারদের জন্য কঠিন টুর্নামেন্ট ছিল। তবে আমার মনে হয় অধিনায়ক হিসেবে যে ধরনের কন্ডিশনই হোক, যা প্রয়োজন সেটুকু করে যদি ম্যাচগুলো জেতা যায় তাহলেই অধিনায়ক হিসেবে আমি খুশি’।

মারক্রাম বোলারদের বাহবা দিয়েছেন, কন্ডিশন কাজে লাগিয়ে তারা ম্যাচ জয়ে ভূমিকা রেখছেন।

‘ভারত ধারাবাহিক ভালো খেলছে’
ভারতের হয়ে ফাইনালের আগের প্রেস কনফারেন্সে এসেছিলেন কোচ রাহুল দ্রাবিড়। ভারতের হয়ে স্মরণীয় এক ক্যারিয়ার কাটানো সাবেক এই ক্রিকেটার নিজের দলের ধারাবাহিকতার প্রশংসা করেছেন।

দ্রাবিড় বলেন, ‘এই দলটা গত এক দশকে অনেক কিছু অর্জন করেছে। তারা একসাথে টেস্ট খেলছে, ওয়ানডে খেলছে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে। ভারতের দলে একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে, এটা দুর্দান্ত। গত বছর ভারত তিন ফরম্যাটেই এক নম্বর দল ছিল। এবারে তিন ফরম্যাটেই টানা ফাইনাল খেলছি আমরা।’

২০২৩ সালে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারত অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছিল। গায়ানায় সেমিফাইনালে জয়ের পর ফাইনালের আগে ভারত মাত্র এক দিনের সময় পেয়েছে, এই এক দিনে ভারত অনুশীলন করেনি।

দ্রাবিড় মনে করেন, অনুশীলনের প্রয়োজন নেই, ফাইনালের আগে দরকার মানসিক বিশ্রাম।

রাহুল দ্রাবিড় এবং রোহিত শর্মার কোচ অধিনায়ক জুটি একেবারে কাছ থেকে শিরোপা হাতে তুলতে পারেননি।

২০২৩ বিশ্বকাপের ফাইনাল অনেক দিন মনে থাকবে এই ক্রিকেটারদের এবং ভারতের সমর্থকদের। আহমেদাবাদে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ এসেছিলেন সেদিন ভারতের জয়ের প্রত্যাশায়। সেই তুলনায় বারবাডোজের এই ফাইনালে চাপ থাকবে কম।

কী হবে দুই দলের কৌশল?
কেনসিংটন ওভালের টসে যেই জিতুক আর হারুক সেটা খুব একটা প্রভাব ফেলবে না।

প্রথম চার ম্যাচে দু’বার ব্যাটিং আগে নিয়েছে দলগুলো, এর মধ্যে এক ম্যাচে শুরুতে ব্যাট করা দল হেরেছে, আরেক ম্যাচে জিতেছে।

বাকি দুই ম্যাচে ইংল্যান্ড বোলিং করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হেরেছে এবং আমেরিকার বিপক্ষে জয় পেয়েছে।

ভারত এই বিশ্বকাপে সাত ম্যাচে পাঁচবার আগে ব্যাট করেছে। এর মধ্যে চারবারই প্রতিপক্ষ বোলিং নিয়েছে, যার মধ্যে আছে গায়ানার সেমিফাইনাল, যেখানে ইংল্যান্ড বল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৩ রানে অলআউট হয়ে গেছে।

ওদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা তিনবার টসে জিতে দুইবার বোলিং নিয়েছে।

টুর্নামেন্টের আট ম্যাচ খেলে চার ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা আগে ব্যাট করেছে, চার ম্যাচে রান তাড়া করেছে, সবগুলো ম্যাচেই জয় পেয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত দুই দলের জন্যই বোলিং আক্রমণ গুরুত্বপূর্ণ। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর বিশ্লেষণ বলছে দক্ষিণ আফ্রিকা টসে জিতে বোলিং নিতে পারে তখন চাপ প্রয়োগ করার জন্য, যেহেতু দিনের ম্যাচ তাই শিশিরের কোনো প্রভাব থাকবে না।

ভারতের সুরিয়া কুমার ইয়াদাভ বলের গতি কাজে লাগিয়ে খেলতে পছন্দ করেন, তার বেশিরভাগ রান আসে স্কয়ার লেগের পেছন দিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার মূল শক্তি গতিময় বোলিং।

এক্ষেত্রে সুরিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা স্লোয়ার বল ব্যবহার করতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৬ ম্যাচ খেলে সুরিয়া চারবার ফিফটি ও একটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন।

শুধু স্কয়ার লেগ বাউন্ডারির দিকে সব ধরনের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মিলিয়ে কাগিসো রাবাদার ২৪ বলে সুরিয়া ৬৬ রান তুলেছেন, নরকিয়ার ১২ বলে নিয়েছেন ৩২ এবং ইয়ানসেনের বিপক্ষে ৫ বলে ২৫।

এই বছর সুরিয়া কুমার ইয়াদাভ ধীরগতির বলে ২০ গড়ে ব্যাট করেছেন, অন্য ধরনের বলে সুরিয়ার গড় ৪২ -এর ওপরে।

সেমিফাইনালে হারের পর ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জস বাটলার বলেন, তিনি মইন আলিকে ব্যবহার করতে পারতেন পাওয়ারপ্লেতে। এটা না করার আফসোস ছিল তার কথায়।

ভারতের দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও ভিরাট কোহলি ফাস্ট বোলিং-এর বিপক্ষে স্বভাবতই ভালো খেলেন।

দক্ষিণ আফ্রিকা কেশভ মহারাজকে ব্যবহার করতে পারে শুরুতেই। এই বছরের শুরু থেকে মহারাজ পাওয়ারপ্লেতে ১১৪ বল করে ৬ উইকেট পেয়েছেন, মাত্র ১৪৩ রান দিয়ে।

এই ম্যাচের অনেকটাই নির্ভর করবে মাঝের ওভারগুলোতে কেমন খেলেন ব্যাটাররা। যেমন ভারতের তিন স্পিনারের বিপক্ষে ক্লাসেন-মিলাররা কেমন খেলেন এটা হবে বড় প্রশ্ন।

যদিও দুই দলই মোটামোটি একই রকম একাদশ নিয়েই মাঠে নামছে তবে ফাইনালের আগে ভারতের দলে একটা পরিবর্তন আসতেও পারে বলছে ইএসপিএন ক্রিকইনফো, শিভাম দুবের পরিবর্তের সাঞ্জু স্যামসন আসতে পারেন।

আর বার্টমান নাকি তাবরাইজ শামসি এই প্রশ্ন থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যানেজমেন্টের সামনে।

তবে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার হয়ে উঠতে পারেন জসপ্রিত বুমরাহ, যিনি এবারের বিশ্বকাপে ২৫.৪ ওভার বল করে ১০৬ রান দিয়ে ১৩ উইকেট নিয়েছেন, ইকোনমি রেট চারের কিছুটা বেশি।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পরিসংখ্যান
ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে এটি মাত্র সপ্তম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচ।

এই টুর্নামেন্টে কখনোই এমন কোনো দল চ্যাম্পিয়ন হয়নি যে পুরো আসর অপরাজিত থেকেছে। এবারে হতে যাচ্ছে সেটা।

বোলিং-এর দিক থেকে ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে আলাদা করার মতো তেমন কিছু নেই। দুইদলেরই গড় ১৫, ইকোনমি রেট ছয়ের আশপাশে।

কিন্তু ব্যাটিংয়ের গল্প ভিন্ন। ভারতের গড় প্রায় ২৬ এবং স্ট্রাইক ১৩২, পঞ্চাশের বেশি স্কোর- ছয়টি। দক্ষিণ আফ্রিকার গড় ২২ এবং স্ট্রাইক ১০৬, তিনটি পঞ্চাশের বেশি স্কোর।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement