যেসব কারণে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে সফল হতে পাড়ছে না
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৯ মে ২০২৪, ১৩:২৫
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) দেয়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ নম্বরে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ আরো একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে মাঠে নামছে। এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপের মঞ্চে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স যথেষ্ট হতাশাজনক।
সমর্থকদের কেউ কেউ মনে করছে, ২০১৪, ২০২১ এর চেয়ে ২০০৭ সালেই বরং বাংলাদেশ দলের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলাটা দেখতে ভালো লাগতো।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল। সেই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেয়া ১৬৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করেছিল ২ ওভার হাতে রেখেই। মোহাম্মদ আশরাফুল করেছিলেন ২৭ বলে ৬১ রান।
সেই শুরু, সেই শেষ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এরপর ২০০৯, ২০১০, ২০১২, ২০১৪, ২০১৬ ও ২০২১ সালে টানা ছয়টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূলপর্বে কোনো ম্যাচ জিততে পারেনি। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ড, হংকং, স্কটল্যান্ডের মতো দলের সাথে হেরেছে, দ্বি-পক্ষীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে ম্যাচ হেরেছে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে।
এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ নানা ধরনের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে কিন্তু দলের পারফরম্যান্সে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। বাংলাদেশ ২০১৬ থেকে ২০২২, এই সময়ের মধ্যে তিনটি আসরে তিন পৃথক অধিনায়কের অধীনে খেলেছে, তাতে প্রেক্ষাপট খুব একটা বদলায়নি।
সাকিব আল হাসানের অধীনে ২০২২ সালে মূল পর্বে দু’টি ম্যাচে জয় পেয়েছে বটে। তবে তা তুলনামূলক দুর্বল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এবং আরেক ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একদম শেষ বলে জিতেছিল।
নিজেদের তুলনায় কিছুটা শক্তিশালী দলের বিপক্ষে মাঠে নামলেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভিন্ন রূপ বেড়িয়ে আসে। যেমন আফগানিস্তান, বড় দলের বিপক্ষে তাদের খুব একটা খেলা হয় না। তাই র্যাঙ্কিংয়ে ১০ নম্বরে আছে দলটি। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বেশ বেগ পেতে হয় আফগানিস্তানের বিপক্ষে।
বাংলাদেশ আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২০১৮ সালে একটি দ্বি-পক্ষীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হেরেছিল।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের ক্রিকেটে আফগানিস্তানের বিপক্ষে এখনো পর্যন্ত মোট ১১বার খেলে বাংলাদেশ ছয়টিতে হেরেছে, পাঁচটিতে জয় পেয়েছে।
বিভিন্ন দেশের লিগগুলোতে আফগানিস্তানের ক্রিকেটারদের উপস্থিতি দেখলে বোঝা যায় বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কতটা পিছিয়ে আছে এখনো।
এবারের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগেই বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে গিয়েছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান।
ওদিকে আফগানিস্তানের রশিদ খান বেশ কিছু ম্যাচে গুজরাট টাইটান্সের অধিনায়কত্বও করেছেন। তিনি ছাড়া মোহাম্মদ নবী, নূর আহমেদ, নাভিন উল হক, রহমানুল্লাহ গুরবাজ আইপিএলে নিয়মিত সুযোগ পান।
এদিক থেকে বাংলাদেশের সাকিব আর মুস্তাফিজ ছাড়া কেউই একবারের বেশি ডাক পাননি।
বাংলাদেশ আসলে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ঠিক ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি। বেশ কিছু জায়গায় বাংলাদেশের সাথে অন্যান্য দলের পার্থক্যটা খুব চোখে পড়ে।
আন্তর্জাতিক ব্যাটারদের সাথে পার্থক্য
বিশ্বের সেরা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ব্যাটারদের সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ব্যাটিংয়ের ফারাকটা অনেক বেশি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পারফরম্যান্সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক স্ট্রাইক রেট। বাংলাদেশের হয়ে যারা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অন্তত এক হাজার রান করেছেন তাদের কারো স্ট্রাইক রেটই ১৩০ও স্পর্শ করেনি, লিটন দাসের সর্বোচ্চ ১২৮।
ওদিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শীর্ষ টি-টোয়েন্টি ব্যাটার যারা অন্তত তিন হাজার রান তুলেছেন তাদের মধ্যে সর্বনিম্ন স্ট্রাইক রেট মোহাম্মদ রিজওয়ানের ১২৮।
এই পর্যায়ের বেশিভাগ ব্যাটারের স্ট্রাইক রেটই ১৩০-এর বেশি। জস বাটলারের ১৪৫, ডেভিড ওয়ার্নারের ১৪২, অ্যারন ফিঞ্চের ১৪২।
বাংলাদেশের সেরা ব্যাটার হিসেবে বিবেচিত তামিম ইকবালের স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৭, মুশফিকুর রহিম ব্যাট করেছেন ১১৫ স্ট্রাইক রেটে, ফিনিশার হিসেবে পরিচিত মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের স্ট্রাইক রেট ১১৯, বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের স্ট্রাইক রেট ১২২।
কারোরই স্ট্রাইক রেট আন্তর্জাতিক মানের নয়, যে কারণে বাংলাদেশ ওই পর্যায়ে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেনি কখনো।
সব ক্রিকেটার সব ফরম্যাটে
ক্রিকেট বিশ্ব টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রতি ঝুঁকতে শুরু করে ২০০৬-এর দিকে। তখন থেকেই ক্রিকেটের বিশ্বায়ন এবং ক্রিকেটে আরো বেশি বিজ্ঞাপনের অর্থ নিয়ে আসার লক্ষ্যে ছোট ফরম্যাটের দিকে বাড়তি নজর ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসন ওয়ানডে এমনকি টেস্ট ক্রিকেটের দল থেকেও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের দলকে খুব বেশি আলাদা করে তুলতে পারেনি কখনো।
এখন কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। তবে একটা লম্বা সময় ওয়ানডে, টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রায় একই দল খেলত।
এতে যেমন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ভুল ক্রিকেটার খেলেছে, ঠিক তেমনি টেস্ট ক্রিকেটের দলে ঢুকে গেছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ধাচে গড়া ক্রিকেটার, যেমন সৌম্য সরকার, মুস্তাফিজুর রহমান ও সাব্বির রহমান।
পরবর্তীতে মুস্তাফিজুর রহমান একরকম জোর করে টেস্ট ক্রিকেট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়েছেন, বোর্ডকে বুঝিয়েছেন তিনি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটই বেশি খেলতে চান। শোনা যাচ্ছে, তাসকিন আহমেদও একই পথে হাঁটছেন।
তামিম ইকবাল ২০২১ সালে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে বিশ্রাম এবং ২০২২ সালে এই ফরম্যাটকে বিদায় বলেছিলেন। তার ব্যাটিংয়ের দক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও তামিম ইকবালের ১১৭ স্ট্রাইক রেট নিয়ে বিস্তর সমালোচনা ছিল।
কিন্তু তামিম চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ওপেনার হয়েছিলেন নাইম শেখ, তার স্ট্রাইক রেট ১০৩, বর্তমান অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়া নাজমুল হোসেন শান্তর স্ট্রাইক রেট ১০৯। অর্থাৎ বাংলাদেশ শুধুমাত্র পশ্চাৎপদ সিদ্ধান্তই নিয়েছে।
বাংলাদেশের যেসব ক্রিকেটার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বড় সম্পদ হয়ে উঠতে পারতেন তাদের কেউ কেউ হারিয়ে গেছেন কেউ হয়েছেন অবহেলিত।
যেমন আফতাব আহমেদ, ২০০৬-২০১০ সাল পর্যন্ত ১১টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেই ১২৮ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করে নজর কেড়েছিলেন, কিন্তু তিনি হুট করেই দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যান।
ওই সময়ে জুনায়েদ সিদ্দিকি সাত ম্যাচ ব্যাট করেছিলেন ১৪৭ স্ট্রাইক রেটে, রান তুলেছিলেন ২০০ এর কাছাকাছি। তাকে আর বিবেচনাই করা হয়নি।
এমন জিয়াউর রহমান, শুভাগত হোম, অনেক নাম এসেছিল, কেউ টি-টোয়েন্টি ধাঁচের ক্রিকেটে টিকতে পারেননি। বরং বিসিবির খাতায় টিকমার্ক পেয়েছিল যারা কম স্ট্রাইক রেট হলেও ২০ থেকে ৩০ রান করে মোটামুটি একটা পারফরম্যান্স দেখাতে পেরেছেন তারাই।
যেমন অধারাবাহিকতার কথা বলা হয় অনেক সময়। কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে অন্তত এক হাজার রান তোলা টি-টোয়েন্টি ব্যাটারদের কারোরই গড় ২৫ও স্পর্শ করেনি কখনো।
মূলত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশকে বোলারদের চেয়ে ব্যাটারদের ব্যর্থতাই বেশি ভুগিয়েছে। যেমন ২০১৬ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ৩ বলে ২ রান নিতে পারেননি বাংলাদেশের দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার।
একই বিশ্বকাপে মুস্তাফিজের ৫ উইকেটে নিউজিল্যান্ডকে ১৫০ এর নিচে বেঁধে ফেলার পরে বাংলাদেশের ব্যাটাররা ৯০ রানে অলআউট হয়ে যায়।
বাংলাদেশ ২০১০ সালেও অস্ট্রেলিয়াকে ১৪১ রানের মধ্যে থামিয়ে দেয় পুরো ২০ ওভারে, কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটাররা ১১৪ রানের বেশি করতে পারেনি।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার উঠে আসছে না কেন?
প্রথম বিভাগ লিগ খেলা ক্রিকেটার ও বর্তমানে ক্রিকেট উপস্থাপক সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি মনে করেন, বাংলাদেশে যথাযথ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার উঠে না আসার কারণ ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের অভাব এবং একই সাথে কোচিং মেথড টি-টোয়েন্টি সুলভ না।
তিনি বলেন, ‘ভারতে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের বাইরে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আছে, যেগুলো রাজ্যভিত্তিক সেরা ক্রিকেটার তুলে আনে, যেমন তামিল নাড়ু প্রিমিয়ার লিগ। এছাড়া সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফিও এখন টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে খেলা হয়, এতে অনেক এলাকা থেকে ক্রিকেটাররা নিজেদের প্রমাণের মঞ্চ পান।’
তিনি বলেন, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াতেও একই প্রক্রিয়ায় রাজ্যভিত্তিক ক্রিকেটার তুলে আনা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে প্রিমিয়ার টি-টোয়েন্টি লিগ ছাড়া আর কোনো ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি আসর হয় না। এতে ক্রিকেটাররা উঠে আসার যে রাস্তা সেটা সংকীর্ণ একই সাথে শীর্ষ পর্যায়ের করে ক্রিকেটের ম্যাচও পান না ক্রিকেটাররা।
সামি বলেন, ‘এটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ভালো না করার পেছনে একটা বড় কারণ। আরেকটা বড় ব্যাপার হচ্ছে ক্রিকেট শেখার যে প্রক্রিয়া সেটায় অনেক বড় বদল এসেছে, যেমন অনেক ক্রিকেটারই হকি, গলফ বা টেনিস খেলতে পারেন, তারা সেসব ক্রীড়া থেকে প্রাপ্ত টেকনিক নিজেদের ব্যাটিং এ কাজে লাগান।’
এ প্রসঙ্গে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং সেনসেশন জেইক ফ্রেজার ম্যাকগারকের কথা উল্লেখ করেন, যিনি সম্প্রতি বলেছেন, তার পাওয়ার হিটিংয়ের পেছনে মূল কারণ তিনি কাজটা করতে আনন্দ পান, গলফ খেলেন এবং তিনি দু’টি খেলাকে মেলাতে পারেন।
বিদেশের অনেক কোচ বেজবলের সাথে ক্রিকেটের সম্পর্ক খুঁজে ক্রিকেটারদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন।
সামি বলেন, ‘কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে আসার আগ পর্যন্ত ক্রিকেটাররা খুবই পুরাতন একটা কোচিং প্রক্রিয়ায় উঠে আসছেন, এতে না ক্রিকেটারদের কোনো উন্নতি হচ্ছে, না বাংলাদেশের ক্রিকেটের।’
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা