১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দেশের বিভিন্ন স্থানে গরমের তারতম্য হয় যেসব কারণে

- ছবি - বিবিসি

‘গরমে প্যাসেঞ্জার কম, ভাড়া মারতে পারি না। সকালে রিকশা নিয়া বাইর হইলে ১১টা পর্যন্ত ভাড়া মারতে পারি। তারপর আর লোক পাওয়া যায় না। লোকজন বিকালের পর আজানের আগে বাইর হয়,’ বিসিসি বাংলাকে বলছিলেন রাজশাহীর এক রিকশাচালক মো: জামাল উদ্দিন।

তিনি জানান, গরমে রিকশা চালাতে প্রচণ্ড কষ্ট হলেও সংসার চালাতে এর কোনো বিকল্প নেই।

এদিকে সিলেট বিভাগের একাধিক রিকশাচালকের সাথে কথা হলে জানান, যে গরম পড়ছে সেটা তাদের কাছে অস্বাভাবিক লাগছে না এবং আবহাওয়াও অনেকটা আরামদায়ক।

আবহাওয়া অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ২৫টি জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে অতি তীব্র ধরনের তাপপ্রবাহ অব্যাহত আছে। বাকিগুলোর ওপর নেই।

এখন প্রশ্ন হলো, অঞ্চলভেদে দেশের বিভিন্ন এলাকার তাপমাত্রার এই তারতম্য কেন?

কিছু এলাকায় ‘অতি’ উষ্ণতা
বাংলাদেশের উষ্ণতম জেলা হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর ওপর দিয়ে বর্তমানে মাঝারি থেকে অতি তীব্র মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।

তবে রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক চার ডিগ্রিতে উঠলেও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে চুয়াডাঙ্গা জেলায়।

শনিবার চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এপ্রিলের প্রায় পুরোটাজুড়েই চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। সেইসাথে রাজশাহীও এই তালিকায় আছে।

মূলত, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বছরের এই সময়ে চুয়াডাঙ্গাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বরাবরই অসহনীয় তাপমাত্রা বিরাজ করে।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্থানেই মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে সূর্যের কিরণ বা রশ্মি লম্বালম্বিভাবে এসে পড়ে। অল্প কিছু এলাকায় বাঁকাভাবে পড়ে।

‘বিশেষ করে এপ্রিলে সূর্য বাংলাদেশের ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয়। এসময় আকাশ মেঘমুক্ত থাকে,’ বলছিলেন আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক।

আরো সহজ করে বলতে গেলে, এপ্রিল মাসে সূর্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। যার কারণে সূর্যের তাপ বেশি পরে এই অঞ্চলে।

চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া এবং উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ এলাকার বাতাস উত্তপ্ত থাকার আরেকটি কারণ হলো ‘লু হাওয়া’।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের দিল্লি, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান। এসময় ওখানের তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝে ওঠানামা করে।

চুয়াডাঙ্গাসহ ওইসব জেলা দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ভারত থেকে যে গরম বাতাস বা লু হাওয়া প্রবেশ করে তা বাংলাদেশের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় বলে জানান আবুল কালাম মল্লিক।

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে একই প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলার সাথে কথা হয়েছিল আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হকের।

তখন বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এভাবে যে চুয়াডাঙ্গা, যশোর, চূয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, খুলনা এই অঞ্চলে বিস্তৃত সমভূমি রয়েছে। এছাড়া এই অঞ্চলের পশ্চিমে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও বিশাল এলাকা জুড়ে সমভূমি।

ফলে তাপমাত্রা প্রবাহের যে তিনটি পদ্ধতি রয়েছে- পরিবহন, পরিচলন এবং বিকিরণ- এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে সমভূমি হওয়ার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে পরিবহন পদ্ধতিতে তাপ প্রবাহিত হয়। ফলে সরাসরি তাপ লাগার কারণে পুরো অঞ্চলের তাপমাত্রা বেশি থাকে।

বরিশালে বেশি গরম অনুভূত হয় কেন?
আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, শনিবার খুলনা বা রাজশাহী বিভাগের সবগুলো জেলার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে।

সেখানকার কোনো জেলায় ৩৯ ডিগ্রির কমে কোনো সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নেই। কিন্তু বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, ওইসব অঞ্চলের চেয়ে তাপমাত্রা অনেকটাই কম।

কিন্তু বরিশালের তাপমাত্রা যশোর চুয়াডাঙ্গার চেয়ে একটু কম হলেও গরমের অনুভূতি খুবই বেশি বলে উল্লেখ করেছেন আবহাওয়াবিদ ড. মল্লিক।

তিনি আরো বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় তাপমাত্রা এমনিতেও ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রির বেশি উঠে না। কিন্তু তাপমাত্রা কম থাকলেও গরমে সেখানে নাভিশ্বাস উঠে যায়।’

কারণ হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা করেন, বরিশাল অঞ্চলে প্রচুর নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর থাকার কারণে অনবরত বাষ্পায়ন হয়। তাছাড়া, বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় ওখানের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি।

মূলত, বাতাসে যখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে, তখন গরমও বেশি অনুভূত হয়।

এ প্রসঙ্গে ২০২৩ সালে নাজমুল হক ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘এখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমি যদি বাতাসে আরো ২০ শতাংশ জলীয় বাষ্প ঢুকিয়ে দেই, তাহলে ওই ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি না থেকে ৪১ বা ৪২ ডিগ্রিতে রূপ নিতে পারে।’

কিছু এলাকায় তাপমাত্রা সহনীয়
আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশের তিনটি বিভাগ তাপপ্রবাহের বাইরে; রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট।

সেখানের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম। যদিও শুক্রবার রংপুর বিভাগেরও বেশিরভাগ জেলার ওপর মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছিলো।

মূলত, যখন কোনো স্থানের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রির মাঝে থাকে, তখন সেই স্থানে মৃদু তাপপ্রবাহ বইছে বলে ধরে নেয়া হয়।

সেই হিসেবে, ওই তিন বিভাগের অনেক স্থানে কোনো তাপপ্রবাহ বইছে না। বরং সহনীয় মাত্রার গরম পড়ছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলাও তাপপ্রবাহের বাইরে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ওই তিন বিভাগের তাপমাত্রা তুলনামূলক কম হওয়ার কারণও এগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান। এইসব অঞ্চলে একদিকে যেমন আছে বিস্তীর্ণ হাওর, অপরদিকে আছে সুউচ্চ পাহাড়।

ড. মল্লিক বলেন, ‘ময়মনসিংহ এলাকায় হাওড়ের মতো বিশাল জলাধার আছে। তাছাড়া পাহাড়ের পাদদেশে হওয়ায় ওখানে মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাত হয়। তাই তাপমাত্রা কম।’

‘চট্টগ্রাম ও সিলেটে নিয়মিত বৃষ্টি হওয়ায় গরম কম অনুভূত হওয়ার এটা প্রধান কারণ। আর যদি বনাঞ্চলের হিসেব করি, ওইসব অঞ্চলে বনায়ন বেশি এবং আশেপাশে জলাধার আছে।’

‘বঙ্গোপসাগর থেকে যে জলীয় বাষ্প বাংলাদেশে প্রবেশ করে, সেটা পাহাড়ি এলাকায় বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন ওই জলীয়বাষ্প সমৃদ্ধ বাতাসের ঊর্ধ্বগমন ঘটে বা উপরের দিকে যায়। তারপর, ওই বাতাসের ভেতরে যে পানির কণা থাকে, তা ঘনীভূত হয়ে মেঘ তৈরি করে। মেঘ তৈরির পর তা পাহাড়ের সম্মুখভাগে বৃষ্টিপাত ঘটায় ও তাপমাত্রা কমায়,’ ব্যাখ্যা করেন তিনি।

তাছাড়া, পাহাড়ি অঞ্চলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ‘পাহাড়ের একদিকে সূর্যের আলো পড়লে অন্যদিকে ছায়া পড়ে। আর পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বাতাস প্রবাহিত হয়। দুই পাশের, মানে উত্তপ্ত বাতাস ও ঠাণ্ডা বাতাস মিশ্রিত হয়ে সেখানকার তাপমাত্রা একটু কম রাখে।’

গরম কমবে কবে?
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, চলতি মাসে গরম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে ১ মে থেকে বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকার কিছু এলাকার তাপমাত্রা কমবে।

খুলনা, রাজশাহী, রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার তাপমাত্রা কমলেও তাপপ্রবাহ চলমান থাকবে।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বজ্রঝড় ও কালবৈশাখী ঝড় হবে। তখন দুই থেকে ছয় ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা কমবে।

তবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ ‘আরামদায়ক’ গেলেও তা স্থায়ী হবে না বলে জানান ড. মল্লিক। কারণ ১৯৭২ সালের মে মাসেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছিল। এছাড়া প্রায় প্রতিবছরই মে মাসে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে দুই থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যায়।

‘কখনো কখনো মে মাসে তীব্র তাপপ্রবাহ ও অতি তীব্র তাপপ্রবাহেরও রেকর্ড রয়েছে। সুতরাং, জলবায়ু অনুযায়ী, মে মাসেও তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছি।’

তবে বর্ষাপূর্ববর্তী, এমনকি বর্ষাকালেও তাপপ্রবাহ দেখা দিতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

‘বাংলাদেশের তাপমাত্রায় এটি এখন দেখা যাচ্ছে যে তাপপ্রবাহ শুধু মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে না; মনসুন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। গতবারও জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে তাপপ্রবাহ ছিল।’

তিনি আরো জানিয়েছেন যে বাংলাদেশে বর্তমানে টানা ২৭ দিন তাপপ্রবাহ বইছে। ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এপ্রিল একক মাস হিসেবে এরকম দীর্ঘমেয়াদে তাপপ্রবাহ ছিল না।’

আবহাওয়ার এমন অস্বাভাবিক আচরণের কারণ হিসেবে তিনি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কথা বলেন।

যদিও চলমান তাপপ্রবাহকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান।

তার মতে, ‘তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়া স্বাভাবিক, এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এইসময় এটা কম-বেশি প্রতিবছরই হয়। তবে এ বছর বেশি হচ্ছে।’

‘এর জন্য জলবাযু পরিবর্তনের প্রভাব আছে। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের তাপমাত্রার সাথে এখনকার তুলনা করলে দেখা যায়, গড়ে পৃথিবীর এক ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। এক ডিগ্রি বাড়াতেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তাপদাহ, বন্যা, তুষারপাত দেখা যাচ্ছে।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
দেশকে উন্নত ও শক্তিশালী করতে আমরা বদ্ধপরিকর : প্রধান উপদেষ্টা হাসিনার রাজনৈতিক মৃত্যু হয়েছে, ফিরে আসার সুযোগ নেই : সোহেল আমাদের সংবিধান ও পার্বত্য শান্তিচুক্তি চব্বিশের নতুন বাংলাদেশে বিজয় দিবস বাংলাদেশের ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব চীনের রাষ্ট্রদূতের সাথে মঈন খানের বৈঠক বীর মুক্তিযোদ্ধারা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে : অ্যাডভোকেট জুবায়ের ভারতীয় চলচ্চিত্রে বাংলাদেশকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন! স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক, প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয়নি: বদরুদ্দীন উমর রাজশাহীতে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ২ কর্মী গ্রেফতার জামায়াত নেতা ড. তাহের সম্পর্কে সাংবাদিক ইলিয়াসের মন্তব্যের প্রতিবাদ

সকল