১৭ জুন ২০২৪
`

শিক্ষকসঙ্কটে জর্জরিত জবির নতুন বিভাগগুলো

-


দেশের অন্যতম স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। নানা কার্যক্রমে এগিয়ে গেলেও শিক্ষকস্বল্পতায় ভুগছে বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন বিভাগগুলো। এর ফলে নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম। অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার কারণে গবেষণা ও সহপাঠ্য কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারছেন না শিক্ষকরা। আবার সেশন জট, সঠিক সময়ে পরীক্ষা দিতে না পারা, সহপাঠ্য কার্যক্রমে অংশ নিতে না পারাসহ নানামুখী সমস্যায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরও।

বিশ্বব্যাপী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। সে হিসেবে অনেক বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতে আন্তর্জাতিক মানও বজায় নেই। প্রায় ১০ বছর আগে এসব বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলেও এ সঙ্কট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। জানা যায়, ২০১৬ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু করে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ। কাগজে কলমে বিভাগটিতে ৯ জন শিক্ষক থাকলেও বর্তমানে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত আছেন মাত্র পাঁচজন। বাকি চারজনই রয়েছেন শিক্ষা ছুটিতে। বিভাগে অধ্যাপক রয়েছেন মাত্র একজন, বিপরীতে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ২০০ জন। শিক্ষকসঙ্কটের পাশাপাশি রয়েছে ল্যাব ও ক্লাস রুম সঙ্কট। এসব কারণে এ বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করতে পাঁচ বছরের স্থানে সময় লাগছে প্রায় সাত থেকে আট বছর। এ জটের ফলে বিভাগটিতে বর্তমানে ছয়টি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ক্লাসপরীক্ষা চলমান রয়েছে।

এদিকে একই রকম সঙ্কট রয়েছে নাট্যকলা বিভাগ। প্রতিষ্ঠার ১০ বছরেও বিভাগে নেই কোনো পূর্ণ অধ্যাপক। মাত্র আটজন স্থায়ী শিক্ষক রয়েছে বিভাগটিতে যার মধ্যে একজন আছেন শিক্ষাছুটিতে। ফলে মাত্র সাতজন শিক্ষকের মাধ্যমে পাঠদানে চলছে বিভাগটিতে। জানা যায়, বিভাগটির ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের (তৃতীয় ব্যাচ) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে সময় লেগেছে সাড়ে সাত বছর। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের (পঞ্চম ব্যাচ) গত বছরের ২১ ডিসেম্বর স্নাতক পরীক্ষা শেষ হয়ে ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে ১৯ মার্চ ২০২৪, সময় লেগেছে নিয়মের চেয়ে বেশি দিন।
২০১৩ সালে ‘ড্রামা অ্যান্ড মিউজিক বিভাগ’ নামে ২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে বিভাগটি। পরবর্তীতে ৫ জানুয়ারি ২০১৬ থেকে সঙ্গীত বিভাগ স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জানা যায়, এ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষা এখনো চলছে। এ ছাড়াও ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তরের প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা চলমান রয়েছে। অন্যান্য বিভাগ থেকে অন্তত ছয় মাস পিছিয়ে এ বিভাগটি। এ বিভাগের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৪০ জন। বিভাগটিতে মোট ৯ জন শিক্ষকের একজন রয়েছেন শিক্ষাছুটিতে। এছাড়াও অতিথি শিক্ষক দ্বারা নেয়া হয় ক্লাস। এর পাশাপাশি রয়েছে ক্লাসরুম সঙ্কট।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগে রয়েছে মাত্র পাঁচজন শিক্ষক। একজন শিক্ষক রয়েছেন শিক্ষাছুটিতে। এছাড়া শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন একজন শিক্ষক। ওই অভিযোগে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে অসহযোগিতার অভিযোগে বিভাগের চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দিয়ে সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক আবুল হোসেনকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিভাগটিতে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছেন তিনজন শিক্ষক। এছাড়াও এ বিভাগে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি নেয়া হয় ৩০ জন শিক্ষার্থী। সে হিসেবে বিভাগে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৫০ জন। ফলে বিভাগটিতে অতিথি শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষকস্বল্পতা পূরণ ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম গতিশীল করার চেষ্টা চলছে।

২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ। দু’জন অধ্যাপকসহ কাগজ কলমে এ বিভাগে শিক্ষক রয়েছেন দশজন। তবে চারজন শিক্ষক ছুটিতে থাকায় অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে সরাসরি যুক্ত রয়েছেন মাত্র ছয়জন শিক্ষক। প্রতি বছর ২৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়া হয় এ বিভাগে। এছাড়াও ২০১৭ সালে চালু হওয়া ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগে মাত্র সাতজন শিক্ষক রয়েছেন। প্রায় তিনশ শিক্ষার্থী রয়েছে বিভাগটিতে। সাতজন শিক্ষকের মধ্যে দুইজন রয়েছেন শিক্ষা ছুটিতে। ফলে বেশি ক্লাস নিতে হচ্ছে কর্মরত শিক্ষকদের। পাশাপাশি অতিথি শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষকসঙ্কট পূরণের চেষ্টা চলছে বিভাগটিতে।
২০১৫ সালে চালু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি ইনস্টিটিউটেও রয়েছে শিক্ষকস্বল্পতা। জানা যায়, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে শিক্ষক রয়েছেন আটজন যার মধ্যে অধ্যাপক একজন। একজন শিক্ষক শিক্ষাছুটিতে থাকায় এ ইনস্টিটিউটে বর্তমানে সরাসরি অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন সাতজন শিক্ষক। বিপরীতে বিভাগের শিক্ষার্থী সংখ্যা দুই শতাধিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেও শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ২০০ জন। বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র সাতজন। একজন শিক্ষক ছুটিতে থাকায় বিভাগে বর্তমানে কর্মরত শিক্ষক সংখ্যা ছয় জন। যার ফলে আরো দুইজন অতিথি শিক্ষক দিয়ে ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে এ বিভাগটিতে।

প্রয়োজনের তুলনায় কম শিক্ষক থাকা এসব বিভাগের একাধিক শিক্ষক জানান, শিক্ষক কম থাকায় অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হয় তাদের। দিনে তিন থেকে চারটি ক্লাসও নিতে হয় অনেক শিক্ষককে। ফলে গবেষণা বা সহপাঠ্য কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেন না তারা।
শিক্ষকস্বল্পতার বিষয়ে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. লাইসা আহমদ লিসা বলেন, আমরা যারা আছি তারা প্রাণপণ চেষ্টা করছি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার। আমরা আগামী বছরের কোর্সগুলো আরো কম সময়ের মধ্যে কিভাবে শেষ করা যায় সেভাবে পরিকল্পনা করছি। নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান ক্যাথরিন পিউরিফিকেশন বলেন, নাট্যকলা বিভাগের মূল সমস্যা হলো শিক্ষকসঙ্কট। প্রত্যেক শিক্ষকের সাত থেকে আটটি কোর্স নিয়ে থাকেন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রাম থাকে। সেখানে শিক্ষকদের রিহার্সালে থাকতে হয়। তবে বর্তমানে সেশনজট কমে আসছে। আমরা আগামী বছরের কোর্সগুলো আরো কম সময়ের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা করছি। সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, আমাদের কিছু কিছু বিভাগে শিক্ষকসঙ্কট রয়েছে, এটা আমরা স্বীকার করি। আমরা এটা নিয়ে বসে নাই। আমরা ইউজিসিতে চিঠির পর চিঠি দিচ্ছি। এটা নিয়ে আমরা যথেষ্ট কনসার্ন, বিশেষ করে নাট্যকলা, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন, সঙ্গীত। গত সপ্তাহেও ইউজিসিতে চিঠি দিয়েছি। নতুন অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী পদ চাওয়া হচ্ছে। একটা, দুইটা করে পদ দিচ্ছে। আমরা গত সপ্তাহেও চিঠি দিয়েছি। এখন অনেক ডিপার্টমেন্টেই সার্কুলার যাচ্ছে। এটা রেগুলার প্রসেস।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্বে থাকা ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. হাসিনা খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভাগের নতুন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম ও শর্ত আছে। এগুলো পরিপূর্ণ না হলে এখনই আমরা নতুন শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। অনুমোদনও নেই। শিক্ষক সঙ্কটের কারণে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না জানতে চাইলে বলেন, এসব সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। কিভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে চেষ্টা চলছে। আমরা নিজেরাও আলোচনা করছি সমস্যা সমাধানের।

 


আরো সংবাদ



premium cement