১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


স্বাস্থ্যঝুঁকি সত্ত্বেও ‘গোল্ডেন রাইস’ চাষের অনুমোদন পেতে মরিয়া একটি মহল

ঠেকাতে রাস্তায় নামার হুঁশিয়ারি পরিবেশবাদীদের
-


পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ‘গোল্ডেন রাইস’ চাষের অনুমোদনে মরিয়া একটি পক্ষ। সারা বিশ^ যেখানে জিএমও (জেনেটিক মডিফাইড অর্গানিজম) নিয়ে বিরোধিতা করছে তখন বাংলাদেশে বিতর্কিত এ ধানের জাত কৃষকদের চাষাবাদের জন্য সরকারি ছাড়করণে চাপ প্রয়োগ করছে একটি মহল। আলোচিত এই ধান জাতের স্বত্ব বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দিতে একটি মহল তৎপর রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশবাদীরা।
গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে গোল্ডেন রাইসের বিরোধিতা করে আসা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। উবিনীগ, বেলা, নয়াকৃষি আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ ও জিএমও বিরোধী মোর্চা এ সভার আয়োজন করে।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষিপ্রধান দেশে জেনেটিক্যালি মডিফাইড বা জিএম ফসল প্রবর্তনের চেষ্টা চলছে। বহুজাতিক কোম্পানির উদ্যোগে নানা ধরনের গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে। যার সুফল আমাদের সাধারণ কৃষক পাচ্ছেন না। বরং স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকির বিষয় নিয়ে বিশ্বজুড়ে সংশয় রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে অনেক দেশে জিএম ফসলের চাষ এবং ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশে দুটি প্রধান ফসল ধান (বিআর-২৯) এবং সবজি (বেগুন) জেনেটিক্যালি মডিফাই করা হয়েছে এবং গোল্ডেন রাইস ও বিটি বেগুন নামে তা প্রবর্তন করা হচ্ছে। বিটি বেগুন ২০১৪ সাল থেকে মাঠ পর্যায়ে চাষের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে, কিন্তু কৃষক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

লিখিত বক্তব্যে উবিনীগ প্রধান নির্বাহী ফরিদা আখতার বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে গত ১৭ এপ্রিল ফিলিপাইনের কোর্ট অব এপিল (আপিল কোর্ট) সুনির্দিষ্টভাবে গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক চাষের বিরুদ্ধে একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। কারণ এ দুটির বিষয়ে জিএম ফসলের প্রবক্তারা বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তা দিতে পারেনি।
মূলত ইরি ও মার্কিন দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ব্রি বিশেষ জাতের ‘গোল্ডেন রাইস’ উদ্ভাবন করে। সাধারণত চালের রঙ সাদা হলেও বিশেষ এই জাতের চালের রঙ হলদে সোনালি হয়। তাই এই ধানের নাম দেয়া হয়েছে ‘গোল্ডেন রাইস’। এটি জেনেটিক্যালি মডিফাইড শস্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিআর-২৯ জাতের ধানের সাথে ভুট্টার জিন মিলিয়ে এই গোল্ডেন রাইসের জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ব্রি বলছে এটি ‘ভিটামিন-এ’ সমৃদ্ধ ধানজাত। ‘গোল্ডেন রাইস’ নামের এ ধান চাষাবাদ নিয়ে শুরু থেকেই পরিবেশবাদীরা বিরোধিতা করে আসছেন। ২০১৭ সালে তথা প্রায় ৮ বছর আগে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করে ব্রি। এর মধ্যে সাবেক দু’জন কৃষিমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মহলের সাথে বৈঠক করেন ব্রি ও ইরি’র কর্তা ব্যক্তিরা। কিন্তু পরিবেশ ছাড়পত্র না পাওয়ায় ‘গোল্ডেন রাইস’ নামের এ জাতটি রিলিজ দিতে পারছে না কৃষি মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত ৪ মার্চ বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুস শহীদের সাথে সচিবালয়ে সাক্ষাৎ করেছেন দু’টি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা পরিবেশ ছাড়পত্র আদায়ে কৃষিমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন বলে জানা যায়। এ নিয়ে গতকালের সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন পরিবেশবাদীরা। ফরিদা আখতার বলেন, জিএম ফসল হিসেবে গোল্ডেন রাইসের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত ঝুঁকি, কার্যকারিতা এবং এই ধানের আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি না- এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। আমরা পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে, তারা সময় নিয়ে এর নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করছেন এবং এখনো অনুমোদন দেয়নি।

সিনজেনটা নামক বহুজাতিক কোম্পানি গোল্ডেন রাইসের স্বত্ব রয়েছে জানিয়ে পরিবেশবাদীরা বলেন, পরিবেশ ছাড়পত্র দিতে সংশ্লিষ্টদের উপর বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চলছে। আয়োজক সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, গোল্ডেন রাইস সারা বিশে^ বিতর্কিত। ফিলিপাইনে অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলা হলেও এখন তা বাতিল করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সেখানকার কৃষকরা আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। কাজেই ফিলিপাইনের উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশে অনুমোদনের কোনো অর্থ হয় না। বাংলাদেশে অধিকাংশ কৃষক বিআর-২৯ ধান চাষ করেন। সেখানে কোনো পেটেন্ট নেই। কৃষক নিজেই বীজ রাখে কিংবা বাজার থেকে কিনে নেয়। স্বাধীনভাবে তারা এই ধান চাষ করতে পারে। তাহলে এই ধানের স্বত্ব বিদেশী কোম্পানির হাতে চলে গেলে বাংলাদেশের লাখ কোটি কৃষকের ভাগ্যে কী ঘটবে? এই প্রশ্নের জবাব কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই দিতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ দেশের কৃষি এবং কৃষকের স্বার্থ দেখা, কোম্পানির স্বার্থ নয়।
বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জিএম নিয়ে বিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত। যদি বিজ্ঞানীরা বিভক্ত থাকে, আপনি বিপদযুক্ত জিনিসে হ্যাঁ বলে ফেলেন, এরপর যদি সেই বিপদ ঘটে যায়, সেই বিপদ সামলানো অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। এ জন্য পূর্ব সতর্কতামূলক নীতিতে চলেন। বিজ্ঞান বিভক্ত থাকলে আপনি না-এর দিকে যান অর্থাৎ গোল্ডেন রাইস অনুমোদনের বিপক্ষে যান।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় বিআর ২৮ ও ২৯ ধানের জাত। তবে, এ দুটি জাতে ব্লাস্টসহ বিভিন্ন রোগবালাইয়ে আক্রমণ বেড়েছে উল্লেখ করে কৃষি বিভাগ থেকে এ দুটি ধান চাষ আস্তে আস্তে কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটির সাথে গোল্ডেন রাইসের অনুমোদন তৎপরতার যোগসূত্র আছে কি না-এমন প্রসঙ্গে কৃষিবিদ ড. এম এ সোবহান বলেন, ব্রি’র আরো অনেক ভালো জাত রয়েছে। সেগুলো সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই জিএম বা গোল্ডেন রাইস সম্প্রসারণ করা উচিত হবে না।

মতবিনিময় সভায় পরিবেশবাদীরা বলেন, বর্তমানে দেশে অসংক্রামক রোগ অত্যন্ত বেড়ে গেছে। সব মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ শুধু এই অসংক্রামক রোগই হচ্ছে। যার মধ্যে ক্যান্সার অন্যতম। দেশে অটিজম বাড়ছে। জিএমও আরো নতুন করে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে; যা কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তারা বলছেন, বিগত ৪০ বছর আগে দেশের কৃষি জৈব সারের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন কীটনাশকে নির্ভরশীল। বর্তমানে খাদ্যের চেয়ে ওষুধ বা হাসপাতালে বেশি খরচ চলে যাচ্ছে। বিকলাঙ্গতা বাড়ছে। এসব জিএমও-এর কারণে কি না? তা সংশ্লিষ্টদের ভাবা উচিত। আয়োজক সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, গোল্ডেন রাইস যাতে অনুমোদন দেয়া না হয় সে জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে চিঠি দেয়া হবে। একই সাথে রাস্তায়ও কর্মসূচি পালন করা হবে।
সভায় নয়া কৃষি আন্দোলনের বদরুল আলম, নাগরিক উদ্যোগের জাকির হোসেন, জিএমও বিরোধী মোর্চার ইবনুল সাঈদ রানা বক্তব্য রাখেন।


আরো সংবাদ



premium cement