কেএনএফ সম্পৃক্ততা : গ্রেফতার ছাত্রলীগ নেতা সম্পর্কে যা জানা গেছে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:৩৭
বান্দরবানের সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সাথে জড়িত সন্দেহে কয়েকদিন আগে বম জনগোষ্ঠীর যে সাতজন সদস্যকে যৌথ বাহিনী গ্রেফতার করেছে, তাদেরই একজন হচ্ছেন ভান বম।
ভান বম রুমা উপজেলা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অবশ্য তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন।
বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পুলু মারমা বলেন, ‘কুকি-চিনের সাথে ওর যে সম্পর্ক থাকতে পারে, সেটা আমরা কল্পনাও করিনি।’
সংগঠনের একজন নেতার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠায় নিজেরা ‘বিব্রতকর’ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন বলেও জানান তিনি।
মারমা বলেন, ‘আমরা বেশ বিব্রত হয়েছি এবং ঘটনা জানা মাত্রই তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
কিন্তু কে এই ভান বম? কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সাথে তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?
‘হেডম্যানের ছেলে’
পুলিশ বলছে, রুমা উপজেলার ছাত্রলীগের সভাপতি পদে থাকা ভান বমের পুরোনাম- ভান মুন নোয়াম বম। স্থানীয়ভাবে অনেকেই তাকে চিনতেন ‘হেডম্যানের ছেলে’ হিসেবে।
রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘তার বাবা হচ্ছেন মুনলাই পাড়ার একজন হেডম্যান, সহজভাষায় যাকে আমরা মাতব্বর বা গ্রামপ্রধান বলে থাকি।’
সোমবার মুনলাই পাড়ায় চালানো বিশেষ অভিযানে বম ছাড়াও আরো ছয়জনকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর সদস্যরা।
আদালতের নির্দেশে মঙ্গলবার দুপুরে তাদের সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় হওয়া ব্যাংকে ডাকাতি, অপহরণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্র ছিনতাইয়ের ঘটনার সাথে গ্রেফতারকৃতদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান বলেন, ‘তদন্তে যাদেরই সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’
ছাত্রলীগের নেতা হয়ে ওঠা
রুমা উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরে পাহাড়ে ঘেরা ছোট একটি গ্রাম মুনলাই পাড়া।
তিন দশক আগে এই গ্রামেই জন্ম হয় ভান মুন নোয়াম বমের। তার বাবা গ্রামপ্রধান লিয়ান অঙ বম পেশায় একজন ফলচাষী।
গ্রামটির স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, ‘আম, আনারস, লেবু- এসব চাষ করেই ওদের সংসার চলে।’
স্থানীয় একটি স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পাস করেন ভান বম। এরপর ভর্তি হন বান্দরবান সরকারি কলেজে।
বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পুলু মারমা বলেন, ‘সেখানে পড়া অবস্থাতেই সে ছাত্রলীগে যোগ দেয় বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
কিন্তু তখন ভান বম রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় ছিলেন না বলে জানিয়েছেন তার পরিচিতজনরা।
মুনলাই পাড়া গ্রামের আরেকজন বাসিন্দা বলেন, ‘অনার্স শেষ করে কিছুদিনের জন্য ও ঢাকায় চলে যায়। যতটুকু শুনেছি, সেখানে কিছুদিন সে একটি ডিপ্লোমা কোর্স করেছে।’
এরপর করোনা মহামারির সময় তিনি আবারো গ্রামে ফিরে যান।
স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা পুলু মারমা জানান, মূলত তখন থেকেই সে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে।’
ভান বম ২০২২ সালে রুমা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
মারমা বলেন, ‘হেডম্যানের ছেলে হিসেবে তার একটা আলাদা পরিচিতি ছিল। ফলে স্থানীয় কর্মীরাই ভোট দিয়ে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করে।’
‘হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ’
সাংগঠনিকভাবে ভান বম বেশ সক্রিয় ছিলেন বলেও জানাচ্ছেন বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের নেতারা।
বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পুলু মারমা বলেন, ‘সে নিয়মিতভাবেই নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখতো এবং আমাদের সব প্রোগ্রামে অংশ নিতো। তখন তার আচরণে তেমন অস্বাভাবিক কিছু আমাদের চোখে পড়েনি বা কারো কাছ থেকে ওই ধরনের কিছু শুনিওনি।’
তবে এপ্রিলের শুরুতে রুমায় ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর ভান বমের সাথে খুব একটা যোগাযোগ হয়নি বলে জানাচ্ছেন তিনি।
ছাত্রলীগ নেতা মারমা জানান, ‘আগে ও নিজে থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতো। কিন্তু কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার পর ও হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।’
এরপর সংগঠনের পক্ষ থেকে ভান বমের সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেছেন বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের এই নেতা।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু ওদের গ্রামে এতটাই দূরে যে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। ডাকাতির ঘটনার পর রুমার পরিস্থিতি থমথমে হওয়ায় সশরীরে ওদিকে যাওয়া হয়নি। ফলে আর যোগাযোগও হয়নি।’
পরিস্থিতি এখনো থমথমে
বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
রুমা উপজেলার স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, ‘খুব প্রয়োজন না হলে মানুষজন বাইরে বের হচ্ছে না।’
মোড়ে মোড়ে এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশি চৌকি রয়েছে। ব্যাংকগুলোও বন্ধ রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রুমার ওই বাসিন্দা বলেন, ‘জরুরি ব্যাংকিং লেনদেনের জন্য এখন আমাদেরকে জেলা সদরে যেতে হচ্ছে।’
এছাড়া দোকানপাটও আগের মতো খোলা হচ্ছে না বলে জানা যাচ্ছে।
রুমার স্থানীয় আরেকজন বাসিন্দা জানান, ‘আগে যেখানে রাত নয়টা-১০টা পর্যন্ত রুমা বাজারে দোকান খোলা থাকতো, এখন সেখানে সন্ধ্যার আগেই সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
যদিও কিছুদিনের মধ্যেই সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা করছে জেলা প্রশাসন।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বরেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই ব্যাংকগুলোও খুলে দেয়া হবে।’
গ্রেফতার আতঙ্কে গ্রাম ছাড়ছে বমরা
রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতারে গত তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বিশেষ অভিযান অব্যাহত রেখেছে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা।
এর মধ্যে সর্বশেষ গত সোমবার মুনলাই পাড়ায় অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ডাকাতির ঘটনার পর এখন পর্যন্ত মোট ৭৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২২ জন নারীও রয়েছেন।
গ্রেফতার হওয়া এসব ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগই বম জনগোষ্ঠীর সদস্য বলে জানা যাচ্ছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি বলেন, ‘কারণ কেএনএফ মূলত বমদের সংগঠন এবং তারাই ব্যাংকে ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটিয়েছে।’
এ অবস্থায় গ্রেফতার আতঙ্কে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বান্দরবানের বম জনগোষ্ঠীর মানুষরা ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বম জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য বলেন, ‘যাদের বয়স হয়ে গেছে এবং হাঁটাচলা করতে পারে না, কেবল তারাই এখন বাড়িতে রয়েছে।’
কিন্তু বাড়ি-ঘর ছেড়ে তারা যাচ্ছে কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি জানান, ‘গভীর জঙ্গলে, যেখানে সহজে তাদেরকে কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না।’
গত ২ এপ্রিল প্রথমে বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি করার চেষ্টা করে একদল সশস্ত্র ব্যক্তি। ওই সময় তারা ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা লুট করার চেষ্টা চালায়।
কিন্তু টাকা নেয়ার চেষ্টায় তারা ব্যর্থ হয়। এরপর ফিরে যাওয়ার সময় ব্যাংকের পাহারায় নিয়োজিত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে ১৪টি অস্ত্র এবং কয়েকশ’ রাউন্ড গুলি লুট করে নিয়ে যায়।
এছাড়া সোনালী ব্যাংকে রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দীনকেও অপহরণ করা হয়, প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর যাকে উদ্ধার করে র্যাব।
এদিকে, রুমা বাজারে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার ১৬ ঘণ্টা পর পাশ্ববর্তী থানচি উপজেলাতেও সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
ব্যাংক দু’টি থেকে নগদ ১৫ লাখ টাকারও বেশি অর্থ লুট করে নিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা।
এই ঘটনার সাথে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্যরা জড়িত বলে তখন সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ-কে বাংলাদেশের একটি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচনা করে নিরাপত্তা বাহিনী।
ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় বান্দরবানের রুমা ও থানচি থানায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে।
যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযানে কেএনএফের সদস্যসহ এখন পর্যন্ত যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগকেই ওইসব মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে।
তবে বিশেষ অভিযান চালিয়েও পুলিশ ও আনসারের লুট হওয়া অস্ত্র এবং গুলি এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
সূত্র : বিবিসি