১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


করোনা ভ্যাকসিনের মূলে এই কাঁকড়ার নীল রক্ত

দেশীয় রাজ কাঁকড়া ঘিরে বাণিজ্যের অবারিত সুযোগ

- ছবি : সংগৃহীত

দেশের সমুদ্র উপকূলে সহজলভ্য রাজ কাঁকড়াকে ঘিরে বৈশ্বিক মহামারি করোনার ভ্যাকসিন বাণিজ্যে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানের অবারিত সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করছেন সামুদ্রিক রাজ কাঁকড়ার নীল রক্ত। এদের রক্তের এনজাইম ঔষধ এবং জৈবচিকিৎসা শিল্পে মানুষের জীবন রক্ষার্থে ইনট্রাভেনাস ড্রাগ এবং ব্যাকটেরিয়ার প্রোসথেটিক গ্রুপের বিশ্বদ্ধতা পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয় এবং বর্তমানে চিকিৎসা যন্ত্রপাতির এন্ডোটোক্সিন দূষণের পরীক্ষায় ও ব্যবহৃত হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই।

আর এই রাজ কাঁকড়ার বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান চারটি প্রজাতির মধ্যে কক্সবাজার উপকূলে একটি প্রজাতি একেবারেই সহজলভ্য।

রাজ কাঁকড়া (অশ্বখুরাকৃতির কাঁকড়া বা সাগর কাঁকড়া) প্রকৃত পক্ষে কাঁকড়া নয় তবে কাঁকড়ার সাথে সাদৃশ্যযুক্ত সামুদ্রিক অ্যারাকনিড। এরা জাইপোসোরা বর্গের অর্ন্তভূক্ত। পৃথিবীব্যাপী ৩টি গণের অধীনে এদের ৪টি জীবিত প্রজাতি রয়েছে।

এগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গালফ উপকূল ও আটলান্টিক মহাসাগরে বসবাসরত লিমোলাস পলিহেমাস, চীন এবং দক্ষিণ ছাবাহ (মালয়েশিয়া) অঞ্চলের টেসিপ্লিয়াস ট্রাইডেনটেটাস এবং বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, চীনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বাসকারী টেসিপ্লিয়াস গিগাস ও সবচেয়ে ছোট প্রজাতি ক্যারসিনসকরপিয়াস রোটানডিকডা।

গবেষকদের মতে, প্রাগৈতিহাসিক এই প্রাণীকে লিভিং ফসিল বা জীবন্ত জীবাশ্ম বলা হয় যা প্রায় সাড়ে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫৫ কোটি বছর পূর্বে ট্রাইলোবাইট থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। এদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত হওয়ায় অঙ্গসংস্থানিক পরিবর্তন ছাড়াই এরা পৃথিবীতে টিকে আছে। ৪০ কোটি বছরেরও পুরানো রাজ কাঁকড়ার জীবাশ্ম এবং বর্তমানকালের জীবিত প্রজাতিগুলোর প্রায় সমরূপ বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

দেশে ক্যারসিনসকরপিয়াস রোটানডিকডা প্রজাতির রাজ কাঁকড়া মোহনা এবং মহাদেশীয় মহীসোপান অঞ্চলে দেখা যায়। এরা প্রায়ই মাছ ধরার জালে ধরা পড়ে। কক্সবাজার উপকূল, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া এবং মহেশখালি দ্বীপ এবং সুন্দরবনের নদী ও চরে সচরাচর এটিকে দেখা যায় বলে সূত্র জানায়।

সূত্রমতে, বিংশ শতাব্দির প্রথম অর্ধাংশে আমেরিকায় রাজ কাকড়া সার এবং পশু খাদ্য তৈরীতে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হতো। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যেমন: থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং চীনে রাজ কাঁকড়ার ডিম সুস্বাদু খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয় তবে পশ্চিমা বিশ্বে এদের রক্তের জন্য সংগ্রহ করা হয়। এদের রক্তের এনজাইম ঔষধ এবং জৈবচিকিৎসা শিল্পে মানুষের জীবন রক্ষার্থে ইনট্রাভেনাস ড্রাগ এবং ব্যাকটেরিয়ার প্রোসথেটিক গ্রুপের বিশ্বদ্ধতা পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয় এবং বর্তমানে চিকিৎসা যন্ত্রপাতির এন্ডোটোক্সিন দূষণের পরীক্ষায় ও ব্যবহৃত হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ওশেনোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোসলেম উদ্দিন নয়াদিগন্তকে জানিয়েছেন, এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিস্কার নিশ্চিত করতে আলোচনায় এসেছে সামুদ্রিক লাল কাঁকড়া বা রাজ কাঁকড়া নামের হাল্কা নীল রক্তের একটি প্রাণী। এদের নীল রক্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। পরীক্ষাগারে বিভিন্ন ওষুধ, প্রতিষেধকের কার্যকারিতা পরখ করে দেখার ক্ষেত্রে নাল কাঁকড়ার নীল রক্ত অত্যন্ত জরুরি একটি প্রাকৃতিক উপাদান।

তিনি বলেন, এদের রক্তে অ্যামিবোসাইট নামের কণিকা থাকে যা চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বা ভ্যাকসিনেও ব্যাকটিরিয়ার উপস্থিতি পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়। এদের রক্তের এনজাইম ঔষধ এবং জৈবচিকিৎসা শিল্পে মানুষের জীবন রক্ষার্থে ইনট্রাভেনাস ড্রাগ।

বর্তমানে করোনার প্রতিষেধক তৈরির ক্ষেত্রেও অত্যন্ত জরুরি এবং একটি অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে সামুদ্রিক নাল কাঁকড়ার নীল রক্ত!

তিনি আরো জানান, বেশীরভাগ মেরুদণ্ডী প্রাণীর দেহে লৌহযুক্ত লোহিত রক্তকণিকায় বিদ্যামন হিমোগ্লোবিনের (যার কারণে রক্তের রং লাল হয়) সাহায্যে অক্সিজেনে পরিবাহিত হলেও এদের দেহে অক্সিজেন পরিবহনের কাজটি সম্পাদিত হয় কপার-যুক্ত এক রকম হিমোসায়ানিনের সাহায্যে। এই কপার-যুক্ত হিমোসায়ানিনের উপস্থিতির কারণে নাল কাঁকড়ার রক্তের রং নীল দেখায়।

মার্কিন গবেষনা ম্যাগাজিন স্মিথসোনিয়ান ইতোমধ্যে করোনার ভ্যাকসিনে রাজ কাঁকড়ার রক্তের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ড. মোসলেম জানান, আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে যেহেতু সম্ভাবনাময় এই প্রজাতিটি বেশ সহজ লভ্য, পরিকল্পিত আহরনের মাধ্যমে তাই করোনা ভ্যাকসিনের বৈশ্বিক বাণিজ্যে শক্তিশালী অংশীদার হতে পারে বাংলাদেশ।

রাজ কাঁকড়ার প্রতি লিটার রক্তের মূল্য ১৩ থেকে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত জানিয়ে তিনি বলেন, একদিনে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে কাঁচামাল হিসেবে এই রক্ত বিক্রির জন্য প্রক্রিয়াজাত করতে পারে, অন্যদিকে করোনা ভ্যাকসিনের পিউরিটি পরীক্ষায় প্রাকৃতিক নির্দেশক হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশে যদিও রাজ কাঁকড়া ঝুকিপূর্ণ প্রজাতি না হলেও অতি আহরণের ব্যাপারে সতর্ক হবারও পরামর্শ এই গবেষকের।


আরো সংবাদ



premium cement