২১ মে ২০২৪, ০৭ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫
`


হারিয়ে গেছে মাছের ভাণ্ডার মালঞ্চ নদীর নাম

ফরিদপুরের সালথা উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত প্রায় অস্তিত্বহীন মালঞ্চ নদী : নয়া দিগন্ত -

নদীমাতৃক বাংলাদেশের ফরিদপুর ও এর আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গড়ে উঠেছে পদ্মা নদীর অববাহিকায়। জেলা শহরের কোলজুড়ে বয়ে চলা কুমার নদ পার্শ্ববর্তী সালথা উপজেলা বাজার অতিক্রমকালে এর একটি শাখা নদী সৃষ্টি হয়েছে, যার নাম মলঞ্চ। মালঞ্চ নামে অবশ্য আরো দু’টি নদী আছে বাংলাদেশে। এর একটি সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবনে, অন্যটি রাজশাহী জেলায়। তবে সেই দু’টি নদীর মতো ফরিদপুরের এই মালঞ্চ নদীটি ততটা সুদীর্ঘ নয়। তবুও এই নদীর রয়েছে কয়েক শ’ বছরের প্রাচীন ইতিহাস।

ফরিদপুরের মালঞ্চ নদী সালথা উপজেলার গট্টিবাজারে কুমার নদ থেকে উৎপত্তি লাভ করে সিংহপ্রতাপ, গৌড়দিয়া, সলিয়া, সেনহাটি, খাগৈড়, গোয়ালপাড়া, গোবিন্দপুর ও দুর্গাপুর- এই আটটি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলে আবার কুমার নদের সাথে গিয়ে মিশেছে। বিভিন্ন জনপদ ও গ্রাম ছাপিয়ে নদীটি এভাবে ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। এজন্য অনেকে এটিকেও কুমার নদের অংশই মনে করেন। মাত্র ৩০-৪০ বছর আগেও মালঞ্চ নদীটি ছিল দেশীয় নানা জাতের মাছের সম্ভারে ভরা। কথিত আছে যে, এই নদীতে এত বেশি পরিমাণে মাছ ছিল যে স্থানীয়রা সেই মাছ খেয়ে শেষ করতে পারতেন না। তাই অবশিষ্ট মাছ তারা শুঁটকি করে রাখতেন সারা বছরের জন্য।
কিন্তু কালের বিবর্তনে অনেক কিছুর সাথে মালঞ্চ নদীও তার আগের রূপলাবণ্য হারিয়ে ফেলেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, নদীটি তার অস্তিত্বের সাথে সুন্দর নামটিও হারাতে চলেছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই নদীর নামটি পর্যন্ত জানে না। এই নদীর পাড়েই বেড়ে ওঠা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই নদীর নাম জানে না। ফরিদপুরের সরকারি-বেসরকারি নথিপত্রেও নেই মালঞ্চ নদীর কোনো বিবরণ।

স্থানীয়রা জানান, শুকনো মৌসুমে নদীর বুক শুকিয়ে যায়, জেগে ওঠে তার উদোম শরীর। সম্প্রতি নদীটি খনন করা হয়েছে। এখন শুকনো মৌসুমেও কোথাও কোথাও হাঁটুপানি থাকে। বর্ষায় পানিতে ভরে ওঠে নদীর বুক। এ মৌসুমে ফরিদপুরের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট এই নদীতেই জাগ দেয়া হয়। পাটের পচা হাজা-মজা পানি বুকে নিয়েই বয়ে চলে নদীটি। গ্রামের সহজসরল প্রকৃতির মতোই তার ছুটে চলা। অথচ এমন সুন্দর, এমন স্নিগ্ধ ও মায়া জড়ানো নদীটি আজ সবার অগোচরেই যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

কথিত আছে যে, মালঞ্চ নদীর নামকরণের সাথে মিশে রয়েছে এক করুণ শোকগাথা। স্থানীয় এক স্কুলের পরিচালক সুধীর দত্ত ওরফে উত্তম জানান, নবাবী আমলে সালথায় প্রতাপ সিংহ নামে এক বড় জমিদার ছিলেন। তার মেয়ের নাম ছিল মালঞ্চ। এই নদীতে নৌকায় করে তিনি শ্বশুরবাড়ি যেতেন। একদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার সময় মালঞ্চ নৌকাডুবিতে মারা যান। তার মৃত্যুতে শোকে ¤্রয়িমাণ হয়ে পড়ে নদী পাড়ের বাসিন্দারা। গ্রামের নারীরা নদীতে নাইতে এসে মালঞ্চ কুমারীর করুণ মৃত্যুর কথা স্মরণ করে, শোক প্রকাশ করে। তাদের কথাবার্তার সাথে মিশে নদীটির নামই হয়ে যায় মালঞ্চ নদী।

ফরিদপুরের সাংবাদিক ও সালথার বাসিন্দা শ্রাবণ হাসান বলেন, এমন একটি সুন্দর নামের নয়নাভিরাম নদী রয়েছে আমাদের সালথায়, অথচ তেমনভাবে কখনো তাকে জানা হয়ে ওঠেনি। নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগই এ নদীর নাম জানে না।
হারুন-অর-রশীদ নামে আরেক সাংবাদিক, যার বাড়িও এই সালথায়, তিনি বলেন, নিবিড় প্রকৃতির মাঝে বয়ে চলা মালঞ্চ নদীর অপরূপ দৃশ্য সৌন্দর্যপিয়াসীদের আকৃষ্ট করে। নদীটি এখনো হারিয়ে যায়নি। তবে নদীর এই নামটি অনেকেই জানে না। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ৬০ এর দশক থেকে ৮০ দশকেও এই নদীতে দেশীয় জাতের প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এটি কোনো রূপকথা নয়, বাস্তব সত্যি কথা। সেই ভরা ঐশ্বর্যের মালঞ্চ আজ শুধু নাব্যতাই হারায়নি, নামটিও যে হারাতে বসেছে।

স্থানীয়দের মতে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বাঁচতে হলে বাংলাদেশের অন্যান্য নদ-নদীর মতো এই মালঞ্চ নদীর নাব্যতাও ফিরিয়ে আনতে হবে। নাব্যতা ফিরে পেলে এই নদীটি তার আগেকার রূপলাবণ্যও ফিরে পাবে বলে মনে করেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা।

ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা বলেন, বর্তমান প্রজন্মের অনেকে এই নদীর নামই জানে না, যা খুবই উদ্বেগজনক। নদীটি রক্ষা যেমন জরুরি, তেমনি মালঞ্চ নামটিও সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ থাকা দরকার।

এ ব্যাপারে সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আক্তার হোসেন শাহিন বলেন, এ নদীর বিষয়টি আমার জানা ছিল না। সাংবাদিকদের মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারলাম। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে দেখব। যদি সরকারি নথিপত্রে এই নদীর নাম ও তথ্য না থাকে তাহলে তা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া হবে আমাদের পক্ষ থেকে।


আরো সংবাদ



premium cement