রাজধানীতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে বাড়ি ভাড়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সব কিছু মিলিয়ে প্রতিনিয়ত ঢাকায় মানুষের খরচ বাড়লেও সে হারে বাড়েনি সুযোগ-সুবিধা। উচ্চ ব্যয় করেও নিম্নমানের জীবনযাপন রাজধানীবাসীর কষ্টকে বাড়িয়ে দিচ্ছে আরো কয়েক গুণ। লিখেছেন
মাহমুদল হাসান
জীবিকার তাগিদে ও ভালোমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার আশায় প্রতিদিন ঢাকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। এসব মানুষের নাগরিক সুবিধার বিবেচনায় ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন যোগ হচ্ছে তিন শতাধিক যানবাহন। এতে শব্দদূষণের মাত্রা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বাতাসে ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়েছে পাঁচ গুণ। ফলে হাঁপানিসহ নানা রোগ ভর করেছে ঢাকায় বসবাসরত মানুষের ওপর। এতে বেড়ে গেছে স্বাস্থ্য খাতে খরচ।
একটি আধুনিক নগরীতে যতটুকু সড়ক থাকার কথা, এর ধারে কাছেও নেই ঢাকায়। ফলে তীব্র যানজটে প্রতিদিনই নাকাল হতে যাচ্ছে নাগরিকদের। পাশাপাশি ছিনতাই, খুন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাসাবাড়িতে কখনো গ্যাস থাকে না, কখনো থাকে না বিদ্যুৎ। পানির জন্য রাস্তায় নামতে হয় নাগরিকদের। বুয়েটের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে এসেও নির্মমভাবে নিহত হতে হয় আবরারের মতো মেধাবীকে।
ঢাকা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। প্রতিদিনই ঢাকায় মানুষের চাপ বাড়ছে। যানজটে শত শত ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হলেও যানজট কমেনি। পরিকল্পিতভাবে এই শহর গড়ে ওঠেনি। যত ধরনের নাগরিক সেবা পাওয়ার কথা নাগরিকদের, সেটা পাচ্ছে না ঢাকাবাসী। রাজধানীতে গড়ে ওঠা আবাসনের ৬০ শতাংশই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে।
ঢাকায় আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হয় সাধারণ মানুষকে। বৈশ্বিক মানে নিকৃষ্টতম নাগরিক সেবা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে ঢাকার নাগরিকদের। এ শহরেই জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের চাপে পিষ্ট হচ্ছে নাগরিক জীবন। চাল, পেঁয়াজ, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ার সাথে যোগ হচ্ছে বাড়তি গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাসা ভাড়া, যাতায়াত ও শিশুদের পড়াশোনার খরচ।
ব্যয় বেড়েছে খাদ্যপণ্যের। সাধারণ মানুষের সহনীয় সীমা পার হয়ে যাচ্ছে খাদ্যপণ্যের দাম। চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চালের দাম। কয়েক বছর আগেও মোটা চাল ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো এখন সেটা ৪৬-৪৮ টাকা। চিকন চাল প্রতি কেজি ৬৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মাসখানেক ধরে অস্থির আছে পেঁয়াজের বাজার। আর সবজির বাজারে তো আগুন লেগে আছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, সব জায়গায়ই ব্যবসায়ীরা বলছে নেই। অথচ বাজারে সবই পাওয়া যাচ্ছে। কোনোটার কমতি নেই। এই জিনিসটাই যারা মনিটর করবে তারা চুপচাপ বসে রয়েছে। কোনো কথা বলতে বা কাজ করতে দেখা যায় না তাদের।
ব্যয়ের দিক থেকে কানাডার সবচেয়ে বড় শহর টরন্টোও পিছিয়ে ঢাকা থেকে। শহরটিতে জীবনযাত্রার ব্যয় ঢাকার চেয়ে কম, সারণিতে শহরটির অবস্থান ৮৮। মেক্সিকো সিটি, ক্লিভল্যান্ড, ইস্তাম্বুলের মতো শহরেও থাকা-খাওয়ার খরচ ঢাকার চেয়ে কম দেখা গেছে ওই জরিপে। সবচেয়ে সস্তা ১০টি শহরের তালিকায় ভারতের নয়াদিল্লি, মুম্বাইসহ চারটি নগর এবং পাকিস্তানের করাচি থাকলেও বাংলাদেশের রাজধানীর নাম নেই। প্রবাসী ও বাণিজ্যিক পর্যটকদের খরচের হিসাব ধরে ডলারের মানের ভিত্তিতে ওই জরিপ করেছে ইআইইউ। এর অর্থ একজন বিদেশী পর্যটকের টরেন্টো, মুম্বাই বা করাচিতে থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য সেবা পেতে যা ব্যয় হয়, ঢাকায় ওই সেবার জন্য ব্যয় হবে তার চেয়ে বেশি। তবে অন্তহীন নাগরিক সমস্যায় জর্জরিত ঢাকার মানুষের জন্য জীবনযাত্রার এ ব্যয়ের ফারাক আরো বেশি।
ঢাকা কি আসলেই বসবাসের অযোগ্য?
বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় এবার ঢাকার অবস্থান নিচের দিক থেকে ৩ নম্বর। চলতি বছরে ১৪০টি দেশ নিয়ে এই তালিকা তৈরি করেছে লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের ইনটেলিজেন্স ইউনিট বা ই আই ইউ।
বাস করার অযোগ্য শহরের তালিকায় সর্বনিম্নে থাকা ১০ দেশের মধ্যে সবচেয়ে অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার পরে রয়েছে মাত্র দু’টি শহর। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক এবং অপরটি নাইজেরিয়ার লাগোস।
অন্য দিকে এ তালিকায় সবচেয়ে বেশি বাসযোগ্য শহর উল্লেখ করা হয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাকে। ভিয়েনার পরেই রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, সিডনি, জাপানের ওসাকা, কানাডার ক্যালগারি, ভাঙ্কুবার, টরেন্টো প্রভৃতি শহর।
মিরপুর থেকে কর্মস্থল সিদ্ধেশ্বরীতে যেতে রীতিমতো যুদ্ধ করে অফিস করেন রুবাইয়া ইয়াসমিন। তার মতে, ঢাকা শহরে বসবাসের সবচেয়ে নেতিবাচক দিকটি হচ্ছে যানজট। পরিবহন ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। রাজধানীর বাসের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই, ভাড়া নিয়ে কোনো শৃঙ্খলা নেই, যাত্র তোলা নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে চালকদের মধ্যে, দক্ষ চালকও নেই। এ বিষয়ে বারবার আলোচনা এমনকি বড় ধরনের একটি আন্দোলন হওয়ার পরও এ খাতটিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে ঢাকার ফার্মগেটের পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় থাকেন নাদিরা জাহান। ঘর-সংসারের সামলানোর পাশাপাশি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করেন তিনি। তার মতে, তার এলাকাটি অনেক বেশি ঘনবসতি অনেক বেশি। এ কারণেই রাস্তায় যানবাহন এবং অসম্ভব যানবাহন থাকে। ফলে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, ঘনবসতি হওয়ার কারণে বিল্ডিংগুলো একটার গায়ে আরেকটা লেগে থাকে। ফলে অনেক সময় দেখা যায় যে মানুষের প্রাইভেসিও থাকে না। তিনি অভিযোগ করেন, তার এলাকায় সকাল ও বিকেলে গ্যাস থাকে না বললেই চলে। সেই সাথে নিয়মিত পানি সরবরাহ পাওয়া যায় না।
একেক বার একেক কর্তৃপক্ষ এসে রাস্তা কাটে, কখনো বিদ্যুতের থেকে কাটা হচ্ছে, কখনো গ্যাস, কখনো ওয়াসা অর্থাৎ একেক জন একেক সময় রাস্তা কাটে আর মানুষজন চরম দুর্ভোগ পোহায় বলে জানিয়েছেন নাদিরা।
এ ধরনেরই কিছু নাগরিক অসুবিধার কথা উঠে এসেছে ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ওই তালিকার বিবেচ্য বিষয়ের মধ্যে।
এ বছর শহরগুলোর বাসযোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেসব বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা, এবং অবকাঠামো।
এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রাজধানী ঢাকা দু’টি বিষয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। তার মধ্যে একটি সংস্কৃতি ও পরিবেশ এবং অন্যটি অবকাঠামো।
এই দু’টি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যা যা রয়েছে তা হলো, জলবায়ু ও তাপমাত্রা, দুর্নীতির মাত্রা, সামাজিক বা ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা, খেলাধুলার সুযোগ, খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য, ভোগ্যপণ্য ও সেবা, সড়ক-পরিবহন ব্যবস্থা, গৃহায়ন, জ্বালানি, পানি এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা।
হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের (এইচইআই) গবেষণায় জানা গেছে, ঢাকায় শব্দদূষণের সর্বোচ্চ মাত্রা ১৩০ ডেসিবলের মতো। শব্দদূষণের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা পেতে ২০০৬ সালে একটি বিধিমালা তৈরি করা হলেও সেটা কোনো কাজে আসছে না। বরং প্রতিনিয়তই বাড়ছে শব্দ দূষণের মাত্রা। ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় করা এক জরিপে পরিবেশ অধিদফতর রাজধানীতে শব্দের মাত্রা সর্বোচ্চ ১৩৫ ডেসিবল পর্যন্ত রেকর্ড করেছে। এসব জায়গায় বাস করা মানুষের স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। জরিপে শব্দদূষণের জন্য দায়ী করা হয়েছে যানবাহনকে। এতে প্রথম স্থানে আছে প্রাইভেট কার, এর পরে আছে মোটরসাইকেল ও বাস। শব্দদূষণের কারণে ঢাকার মানুষকে শুধু উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, মনঃসংযোগ কমে যাওয়া, মাথাব্যথা ও মাথা ধরার জটিলতায় অস্বাভাবিক আচরণ করার মতো নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
ঢাকায় বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। বৈষম্য থাকলে বড় ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়। তিনি বলেন, গণপরিবহনের অবস্থা খুবই খারাপ। ব্যক্তিগত গাড়ির আধিপত্য বাড়ছে। নাগরিক সেবার মানও ভালো নয়। ঢাকার অনেক মানুষ এখনো সুপেয় পানি পাচ্ছে না, বিশেষ করে বস্তি এলাকায়। পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য অপসারণের অবস্থা খুবই খারাপ। পরিবেশদূষণও বেশি। শিক্ষার প্রসার হয়েছে; কিন্তু গুণগত মান বাড়েনি। এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানুষের ঢাকামুখী হওয়ার কারণ অর্থনীতি।
ঢাকায় অর্থনৈতিক সুবিধা বেশি। অন্য জায়গায় তা নেই। তাই মানুষ ঢাকায় আসে। ঢাকা নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব।
তিনি জানিয়েছেন, ঢাকা এক ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। যদিও সরকারের একার পক্ষে ঢাকার সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে।