১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


চাই আঞ্চলিক শান্তির টেকসই নিশ্চয়তা

-

বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভূ-সীমানার ভিত্তিতে রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির পর থেকেই প্রতিটি দেশের নিজ নিজ সীমান্তবর্তী প্রতিবেশীর সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য হয়ে থাকে। এই মতপার্থক্যই একসময় দেশগুলোর মাঝে পারস্পরিক কোন্দল এবং আঞ্চলিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে, যার মাধ্যমে পরবর্তীতে ভূ-রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক পটপরিবর্তন বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। দু’টি প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার সম্পর্কের যখন টানাপড়েন চলতে থাকে, তখন সেটি কেবল কূটনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়েই সীমিত থাকে না। বরং সেই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে পুরো অঞ্চলজুড়ে, যার প্রভাব পড়ে বিশ্ব রাজনীতিতে।
বিশ্বব্যবস্থায়, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে চীন ও ভারত প্রভাবশালী দু’টি নাম। উভয় দেশই এশিয়াজুড়ে নিজস্ব বলয় তৈরিতে মনোযোগী। যদিও এ যাত্রায় চীন কিছুটা এগিয়ে, তবে প্রভাব বিস্তারে ভারতও ছাড় দিতে রাজি নয়। দুই দেশের এই মনোভাবই পরস্পরকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। কয়েক বছর ধরেই ভারত ও চীনের মধ্যে নতুন করে একটি অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চোখে পড়ার মতো। ভারতকে কোণঠাসা করতে প্রতিবেশী দেশগুলোকে করায়ত্ত করার চেষ্টা চীন দীর্ঘ দিন ধরেই করছে। এ চেষ্টা এক দিকে যেমন রাজনৈতিকভাবে চলেছে, সমানতালে অর্থনৈতিকভাবেও চলেছে। এর ফলে ভারতের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও নেপাল নিজের সংসদে নতুন মানচিত্র পাস করিয়েছে। নেপালের মতো ক্ষুদ্র্র একটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভারতের সাথে এমন আচরণ স্বয়ং ভারতের জন্যও অনাকাক্সিক্ষত ছিল। এ পরিস্থিতির মধ্যেই চীনের সাথে ভারতের বিরোধ দেখা দেয়। এতে চীন-ভারত উত্তেজনার পারদ ওঠে। গালওয়ান উপত্যকা ঘিরে সীমান্তরেখায় দুই দেশই সেনা সমাবেশ ঘটায়। ১৬ জুন রাতে দু’পক্ষের সংঘর্ষে সেনাকর্মকর্তাসহ ২০ জন ভারতীয় সেনা হতাহতের ঘটনা ঘটে। শুরুতে চীনের পক্ষ থেকে বিবৃতি না এলেও ধারণা করা হয়, চীন শিবিরেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে। দুই দেশই তাদের সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। ভারত তাৎক্ষণিক কয়েক শ’ কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয় চুক্তি সম্পন্ন করে। দুই দেশের মুখোমুখি অবস্থান এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যেন যেকোনো মুহূর্তেই যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে। সারা বিশ্বের চোখ তখন চীন-ভারত সীমান্তে। দেশ দু’টিতেও একধরনের থমথমে অবস্থা বিদ্যমান ছিল। তবে আশার কথা হলো, এ উত্তেজনাকর অবস্থান থেকে দুই দেশই পিছু হটেছে। সম্ভাব্য যে ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছিল, সেটি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তবে উত্তেজনার প্রশমন ঘটলেও এ ঘটনার জিইয়ে রাখা বারুদ যে পরবর্তী সময়ে আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠবে নাÑ তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। এ উত্তেজনার বারুদই হয়তো একসময় ওই অঞ্চলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাবে।
চীন ও ভারত উভয়ই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। জনসংখ্যায় বিশ্ব তালিকায় এ দেশ দু’টির অবস্থানও শীর্ষে। এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সামরিক শক্তিমত্তা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম বড় নিয়ামক চীন-ভারত। তাই স্বাভাবিকভাবেই দেশ দু’টি যুদ্ধে জড়ালে বিশাল জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবনযাত্রায় ব্যত্যয় ঘটবে। আবার আঞ্চলিক মেরুকরণের প্রভাবে চীন ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমনÑ বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তানেও এর উত্তাপ লাগার আশঙ্কা রয়েছে। এ কয়েকটি দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা ৩৫০ কোটির কাছাকাছি, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ। এ অঞ্চলে যেকোনো ধরনের সঙ্ঘাত পুরো দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি বিঘিœত করবে। বিভিন্ন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষকদের মতে, এ অঞ্চলের কোনো একটি অংশে আগুন জ্বলে উঠলে তার ‘চেইন রি-অ্যাকশন’ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। ভারত, পাকিস্তান, চীনের মতো তিনটি পরমাণু শক্তিধর দেশ একে অপরের প্রতিবেশী। আবার ঐতিহাসিকভাবেই ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা ও কাশ্মির ইস্যু নিয়ে সীমান্তে সঙ্ঘাত চলমান। তাই কোনোভাবে যদি এ দেশগুলোর দু’টি পক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং সে যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ঘটে, তবে তা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার সাড়ে তিন শ’ কোটি মানুষের জীবনে হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এতে পুরো অঞ্চলে দেখা দেবে প্রচণ্ড মানবিক বিপর্যয়। উদীয়মান অর্থনীতির এ দেশগুলোর উন্নয়নের চাকা স্থবির হয়ে যাবে। ঘাত-প্রতিঘাতের স্বাভাবিক অথচ এই ধারাবাহিক সংস্কৃতির প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়া উত্তপ্ত থাকবে দীর্ঘ সময়। এর ফলে এ অঞ্চলের পুরো সমাজকাঠামোর যে ভাঙন ঘটবে, তা থেকে উত্তরণের জন্য দশকের পর দশক অপেক্ষা করতে হবে। আর অপূরণীয় এ ক্ষতির জন্য দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তিতে পড়তে হবে এই জনপদের মানুষদের।
চীন-ভারত সমস্যার সাময়িক সমাধান ঘটলেও এর একটি স্থায়ী বন্দোবস্তের বিষয়ে উভয় দেশকেই আলোচনায় বসতে হবে। সেই সাথে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে ভারত-পাকিস্তানসহ অন্যান্য বিবদমান পক্ষের মধ্যকার বিরোধের শান্তিপূর্ণ ও কার্যকর সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। দেশগুলোর মধ্যে যে বিষয়াবলি নিয়ে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান, আলোচনার মাধ্যমে তার স্থায়ী মীমাংসা করতে হবে। এর আগে এ অঞ্চলের দেশগুলো নিয়ে গঠিত জোট ‘সার্কের’ কাগজে-কলমে অস্তিত্ব থাকলেও কার্যকর কোনো ভূমিকা বর্তমানে দৃশ্যমান নয়। তাই প্রয়োজনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন আঞ্চলিক জোট গঠন করতে হবে। দেখা গেছে, সীমানাবিরোধ ও আন্তঃদেশীয় নদীর পানিবণ্টনসংক্রান্ত সমস্যাই একটা সময়ে গিয়ে প্রকট আকার ধারণ করে। তাই সীমানাকেন্দ্রিক জটিলতার অবসান ঘটানোর জন্য প্রয়োজন দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। ‘সম্মিলিত নদী কমিশন’ গঠনের মাধ্যমে আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর পানির ন্যায্য বণ্টন করতে হবে। তবে এসব সমস্যার সমাধান এক দিনেই সম্ভব নয়, এটি দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ চলমান একটি প্রক্রিয়া। তাই যত দ্রুত এসব সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, ততই তা সাড়ে তিন শ’ কোটি মানুষের জন্য মঙ্গলের কারণ হবে এবং একটি নিরাপদ দক্ষিণ এশিয়া তৈরিতে সক্ষম হবে।
বলা হয়ে থাকে, বিশ্বযুদ্ধের এক ভয়ঙ্কর দৈত্য ঘুমিয়ে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। যদি কোনো কারণে এই দৈত্যের ঘুম ভাঙানো হয়, তবে শুরু হতে পারে তার নারকীয় তাণ্ডবলীলা। তখন দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্ঘাতের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে পুরো পৃথিবীজুড়ে, টালমাটাল হবে বিশ্বব্যবস্থা।
তাই সামগ্রিক শান্তি বিধানে এ অঞ্চলের সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধানে নিরাপদ পৃথিবীর নিশ্চয়তা তৈরি করতে হবে। এতে করে যেমন উপকৃত হবে দক্ষিণ এশিয়া, তেমনিভাবে উপকৃত হবে সারা বিশ্ব।হ
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ishrakf1971@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement