১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

বোকো হারাম- গন্তব্য কতদূর?

বোকো হারাম
বোকো হারাম- গন্তব্য কতদূর? - নয়া দিগন্ত

বোকো হারাম নাইজেরিয়ার উগ্রপন্থী দল। পশ্চিম আফ্রিকায় প্রথমে গঠিত হয় জামাত আহলে সুন্নাহ লিদ দাওয়াহ ওয়াল জিহাদ, এটিই কিছুদিন পর ‘বোকো হারাম’ নামে পরিচিতি হয়। এদের মূল বক্তব্য হলো, পশ্চিমা শিক্ষা-সংস্কৃতি নিষিদ্ধ বা হারাম। নাইজেরিয়া, শাদ, নাইজার ও উত্তর ক্যামেরুনে তাদের হাজার হাজার সদস্য রয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে বোকো হারাম আইএস-এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়লেও এখন তাদের সাথে সংযোগ নেই। বোকো হারামের আগ্রাসী তৎপরতায় ২২ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেকে মনে করেন, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় তৎপর, আলকায়দার সাথে বোকো হারামের সম্পর্ক রয়েছে।

যুদ্ধের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছার সিদ্ধান্ত নেয় বোকো হারাম। বেকার অর্ধশিক্ষিত হাজার হাজার মানুষ আন্দোলনে যোগ দেয়। ২০০৯ সালে পুলিশের সাথে মারাত্মক যুদ্ধে নেতা ইউসুফসহ ১০০ জন মৃত্যুবরণ করে। ওই সময় পুলিশের সাথে সিরিজ দ্বন্দ্ব হয়, এরপর আবুবকর শায়খু নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শায়খু সরকারের কাছে কিছু দাবি পেশ করেন। যেমনÑ যারা বোকো হারামের নেতাদের হত্যা করেছে, তাদের বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া, বোকো হারামের মৃত যোদ্ধাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং অনুদান ও ভাতা প্রদান, স্কুল ও মসজিদগুলো পুনর্নির্মাণ করে দেয়া। এসব কঠিন দাবি সরকার পূরণ করতে পারেনি। ফলে বোকো হারাম আন্দোলন জোরদার করে চলেছে। নাইজেরিয়ার বহু এলাকায় বোকো হারাম গাড়ি-বাড়িতে তল্লাশি চালায়, জনগণকে ‘নিরাপত্তা’ প্রদান করে ও ট্যাক্স উঠায়। অনেক স্থানে সরকারি লোকজনও যেতে ভয় পায়। দুর্গম বিধায় সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ওদের আস্তানায় যেতে ভয় পায়। গহিন বনে কোনো অপারেশন মানে অনেক জীবনহানি। থিঙ্ক ট্যাঙ্করা মনে করেন, এখন বোকো হারাম এতই শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর যে, নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনীর পক্ষে বোকো হারামকে নিশ্চিহ্ন করা অসম্ভব। ওরা পুলিশি তৎপরতা ও সরকারি কাজের বিরুদ্ধে এখন আরো কঠোর। বিভিন্ন মারাত্মক আক্রমণের মাধ্যমে বোকো হারাম ভয়ঙ্কর ত্রাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। নাইজেরিয়া ও পাশের দেশগুলোতে শিয়া-সুন্নি বিরোধও অনেক বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। বাইরের দেশ থেকে শিয়া ও সুন্নি সব দল ও উপদল আর্থিক সহায়তা পায়। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া-সুন্নি বিরোধ আফ্রিকাতেও বিস্তার লাভ করে সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে। আফ্রিকার সবচেয়ে ঘনবসতি নাইজেরিয়ায়। জনসংখ্যা ১৫০ মিলিয়ন। ৫০ শতাংশ মুসলমান, ৪০ শতাংশ খ্রিষ্টান। এখানে ৩৫০ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ২৫০ ভাষায় কথা বলে। জাতিগত বিরোধে ১৯৯৯ থেকে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার মারা গেছে।

১৯৯০ সালে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের পতনের পর গণতন্ত্রের হাওয়া আফ্রিকায়ও আছড়ে পড়ে। একই সাথে, মুসলিম জনমনে সালাফি মতবাদপুষ্ট হতে দেখা গেছে। ওরা জনগণ থেকে চাঁদা ও দান সংগ্রহ করে ঘনবসতি এলাকায় স্কুল, হাসপাতাল, পানীয়জলের ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রকল্প হাতে নিতে দেখা গেছে। ফলে জনগণের কাছে সালাফিরা জনপ্রিয়তা লাভ করে। সৌদি আরব অনেক এলাকায় প্রচুর দান ও সমাজসহায়ক প্রকল্পে অর্থ সাহায্য করে। ফলে ‘ওয়াহাবি মতবাদ’ও আফ্রিকায় প্রবেশ করে কোনো বাধা ছাড়াই। বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠে মসজিদ ও মসজিদকেন্দ্রিক সমাজ। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সুফিবাদও জনপ্রিয়। সুফিরা মহিলাদের লেখাপড়া করতে উৎসাহ জোগায় এবং ইসলামের বাণী জনমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সহায়তা করে। কিন্তু সুফি মতবাদ বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত বিধায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর আবির্ভাবও দেখা যায়। এতে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। অনেক সময় চরমপন্থী বোকো হারামের মতো আল শাবাব দলও আত্মপ্রকাশ করে। তারা নিপীড়িত, দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, ফলে সহায়-সম্বলহীন বিপুল জনগোষ্ঠী এসব দলে ভিড় জমায়। নেতারা এদের ‘জেহাদি’ ভাবধারায় উজ্জীবিত করে। অনেক সময় নবাগতরা প্রকৃত ইসলামি চিন্তাচেতনাকে বুঝতে পারে না, কথিত ‘জেহাদি চেতনাই’ আসল ইসলাম মনে করে এবং সহিংস সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উগ্রমৌলবাদ আফ্রিকার রাজনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে সব গোষ্ঠীই ক্ষমতার লড়াই করছে তা নয়। বড় বড় আলেমরা ক্ষমতার জন্য সহিংসতাকে অনুমোদন দিচ্ছেন না।
নাইজেরিয়ায় পানির সমস্যা প্রচণ্ড, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নেহায়েত কম; শিক্ষার অভাব; অর্থনৈতিক সমস্যা খুবই মারাত্মক। বোকো হারামের একদল সরকারের সাথে আলোচনা করতে চায়, অন্য দল চায় না। আরো দল-উপদল রয়েছে। কুখ্যাত ডাকাতদলও তৎপর। ছোট ছোট অনেক জঙ্গিগোষ্ঠী আছে- এরাও দল বদল করে, সুযোগ নিতে চায়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ডাকাতরা ঘটনা ঘটিয়ে সেগুলো বোকো হারামের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। বোকো হারাম তখন চড়াও হয়, খুনখারাবি করে। তারা কোনো বিরোধিতাই সহ্য করে না।

নাইজেরিয়ার ইসলামিক মুভমেন্ট (আইএমএন) নামে আরো এক বড় ইসলামি দল আছে। কাদুনা স্টেটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে তাদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিয়া ধর্মীয় নেতা ইব্রাহিম আল জাকজাকি। তাদের আক্রমণে ৩৪৭ জন নাইজেরিয়ান সেনাসদস্য মারা যায়। সেনাপ্রধান তুকুর বুরাতিও হত্যার শিকার হন। এরপর জাকজাকি ও তার সহধর্মিণীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের তিন সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। সরকার একে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন আখ্যায়িত করে।

বোকো হারাম অদৃশ্য স্থান থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গাড়ি, টাকাকড়ি এসব পাচ্ছে। এনবিসি টেলিভিশন বলেছে, বেশির ভাগ অস্ত্র নাইজেরিয়ার সেনাদের স্টক থেকে চুরি করা। সেন্ট্রাল আফ্রিকার আর্মস ব্ল্যাক মার্কেট থেকেও অস্ত্র কেনে বোকো হারাম। নাইজেরিয়ায় আমেরিকার একসময়ের দূত জন ক্যাম্পবেল বলেন, নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনীতে এমন কিছু অফিসার রয়েছে, যারা অজ্ঞাতে বোকো হারামকে অস্ত্র পাচার করে থাকে। নাইজেরিয়ার সিনিয়র অ্যাডভোকেট ফেমি ফালানা জানান, লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতনের পর প্রচুর অস্ত্র বোকো হারামের হস্তগত হয়েছে। নাইজেরিয়া আমেরিকা থেকে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে থাকে। সেগুলো হাত বদল হয়ে বোকো হারামের হস্তগত হয়।

২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম অভিযান চালিয়ে আসছে ২০১১ সালকে বোকো হারামের আক্রমণের ভয়াবহ বছর বলা হয়। মসজিদ ও গির্জাসহ বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। দামাতুরু সরকারি অফিসেও প্রচণ্ড হামলা চলে। পুলিশ স্টেশন ও দু’টি ব্যাংকেও হামলা করা হয়। খ্রিষ্টানদের শহর মাইদুগুরির গির্জায় হামলা করা হয়। কাদুনার গির্জায় হামলায় অনেকের মৃত্যু ঘটে। রাজধানী আবুজায় জাতিসঙ্ঘ অফিসেও হামলা হলো। বোকো হারামের সশস্ত্র গ্রুপ এসব আক্রমণের দায়িত্ব স্বীকার করেছে। ওদের হামলায় শত শত বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ‘পরাজিত’ হয়েছে।

২০০২ থেকে বোকো হারাম কথিত ইসলামি শাসনের জন্য নাইজেরিয়ায় ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কাজ শুরু করে। বেকারত্ব ও পপি বাণিজ্য অনেক দল উপদলের মধ্যে সহিংসতার জন্ম দেয়। ১৯৯৮ সালে বোকো হারামের সামরিক সদস্যরা বাইরে থেকে প্রশিক্ষণ নেয়। সরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ও ক্ষমতা দখল করে বোকো হারাম ‘খেলাফত’ চালাতে চায়।

বোকো হারামের সদস্যরা ১৪ এপ্রিল ২০১৪ সালে ২৭৬ ‘টিনএজ’ বালিকাকে নাইজেরিয়ার বর্নো স্টেট স্কুল থেকে অপহরণ করে তাদের গাঢ় রঙের গাউন ও হিজাব পরতে বাধ্য করে। চার বছর পর ১০০ জনের মতো বালিকাকে ছেড়ে দেয়া হয়। অপহরণের কয়েক মাস পর ৫৭ জন পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। আগেও অনেককে অপহরণ করা হয়েছে, তারা কোথায় এবং কী অবস্থায় আছে তা কেউ বলতে পারছে না। ফেব্রুয়ারি মাসে আরো ১১০ বালিকাকে অপহরণ করা হয়। এই অপহরণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ হয়েছে। যেমনÑ নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, টোগো, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা ও পর্তুগালে বিক্ষোভ মিছিল হয়। মিশেল ওবামা প্লাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ান, যেখানে লেখা ছিল, ‘আমার মেয়েদের ফিরিয়ে দাও’। বোকো হারাম ২০১৪ সালে এক ভিডিও প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়Ñ ১৩০ জন মেয়ে, সবাই কুরআন পড়ছিল। বোকো হারাম নেতা আবুবকর বলেন, ‘এরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। এদের বিয়েও দেয়া হয়েছে’।

যেসব দল বা গোষ্ঠী তাদের কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করতে চায়, তাদের জনপদের মানুষ ও মেয়েদের বেশি অপহরণ করা হয়েছে। তাদের ‘ইসলাম সম্পর্কে ধারণা’ দেয়া হয়েছে। যারা দীক্ষিত হয়েছে তাদের অনেকের নিরাপত্তা ও চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কখনো আরো বোঝানোর জন্য আটকে রাখা হয়েছে। নাইজেরিয়ার অনেক বড় বড় ইমাম বোকো হারামের বিরোধিতা করেছেন। তাদের মসজিদেই গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে।
সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আবদুল আজিজ বোকো হারামের কার্র্যক্রমের নিন্দা জানিয়ে বলেন, বোকো হারাম পথ ভুল করেছে। এরা ইসলামের নামে ক্ষমতা দখল করতে চায়। তিনি আরো বলেন, অপহরণ ইসলামে নিষিদ্ধ। অপহৃত মেয়েদের বিয়ে করাও ইসলাম অনুমোদন করে না।’

গত ২৪ মে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে জানা যায়, বোকো হারাম থেকে যেসব মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের ধর্ষণ করেছে নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী। মেয়েদের যে ক্যাম্পে রাখা হয়েছে, সেখানে আলো-বাতাস, পানি ও খাবার অপ্রতুল। সেনারা তাদের ইজ্জত লুটে বলে ‘এগুলো বোকো হারামের বউ’। অনেক মেয়ে সংবাদমাধ্যমে বলেছে, ‘বোকো হারাম আমাদের অনেক নিরাপত্তা ও সম্মান দিয়েছে’। সিএনএন জানায়, নাইজেরিয়ায় ধর্ষণ অনেকটা সামাজিক ব্যাধির মতো। কলেজ ও ভার্সিটিতে ভালো গ্রেডের জন্যও শিক্ষকরা ‘ফ্রি সেক্সের’ অপশনে চলে যান। বোকো হারাম এসব প্রতারক যৌন হয়রানিকারীদেরও অপহরণ এবং হত্যা করে।

বোকো হারামের ‘শরিয়া ল’, ‘ইসলামি খেলাফত’ পশ্চিমাদের মোটেই পছন্দ নয়। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী যেসব দল ও রাষ্ট্র এগুলো সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ তাদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেয়। নাইজেরিয়া সরকার বোকো হারামকে শেষ করার জন্য বিদেশী সহায়তা পেয়ে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ চলছে। এখন আন্দোলনটি কয়েকটি দেশে সীমাবদ্ধ। আইএসকে যেমন ইসলামি বিশ্ব গ্রহণ করেনি, বোকো হারামের অবস্থাও তেমন। আইএসের অবস্থা কোণঠাসা হলেও বোকো হারাম প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনীর সাথে লড়ছে। এই যুদ্ধ তাড়াতাড়ি ফল দেবে বলে মনে হয় না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ সরকার ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement