১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলকদ ১৪৪৫
`


পরিবেশ বিপর্যয়ে বছরে ক্ষতি ৫৩ হাজার কোটি টাকা

-

১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশগত বিষয় নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি উদ্বেগজনক। আগাম হুঁশিয়ারি হিসেবে বিবেচিতও বটে। ওই সংস্থাটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেÑ পরিবেশদূষণে বাংলাদেশে এক বছরে মৃত্যু ৮০ হাজার এবং বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি ৫৩ হাজার কোটি টাকা। দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবেশদূষণে বাংলাদেশ শীর্ষে। দেশের তিন জেলাÑ ঢাকা, কক্সবাজার ও পাবনার ওপর ২০১৫ সালে একটি জরিপ চালায় বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের সেই সময়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিবেশদূষণে ২০১৫ সালে শুধু শহরাঞ্চলে মারা গেছে ৮০ হাজার ২৯৪ জন। বায়ুদূষণ, আর্সেনিকযুক্ত পানি এবং কর্মক্ষেত্রে দূষণজনিত কারণে মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ২৬ লাখ ২৭ হাজার ৯২৬ ঘণ্টা। দূষণের কারণে মৃত্যু ও কর্মঘণ্টা হারিয়ে যাওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি ৬৫২ কোটি ডলার, যা ২০১৫ সালে প্রতি ডলার ৭৮ টাকা ধরে হিসাব করলে টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ৫০ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। এই ক্ষতি ওই সময় (২০১৫) দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সাল নাগাদ দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ হবে শহুরে।
ঢাকার জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুত গতিতে। ঢাকায় প্রতি কিলোমিটারে প্রায় দুই লাখ মানুষ বাস করে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের মোট জনসংখ্যা দ্বিগুণে উন্নীত হবে। ঢাকা এখন বিশ্বের জনবহুল শহর। ২০১৫ সালে দূষণের কারণে ঢাকায় মারা গেছে ১৮ হাজার মানুষ। একই কারণে ঢাকাবাসীর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে পাঁচ লাখ ৭৮ হাজার ঘণ্টা। ওই এক বছরে দূষণের কারণে শুধু ঢাকায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৪৪ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ১১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির দশমিক ৭ শতাংশ। ঢাকায় ১০ লাখ দরিদ্র মানুষ সিসা দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে শিশুর বুদ্ধিমত্তা (আইকিউ) ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত এবং মৃত সন্তান প্রসবের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। বিগত ৪০ বছরে ঢাকা প্রায় ৭৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ছোট নগরগুলো পরিবেশদূষণের শিকার হচ্ছে বেশি। ১৯৯০ সালে পাবনা অর্ধেক জলাভূমি হারিয়েছে। মৃতপ্রায় হয়ে গেছে জেলায় প্রবহমান ইছামতি নদী। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের পাশে গেলে বিষয়টি অনুধাবন করা সহজ হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত কারণে বছরে মারা যায় ৩৭ হাজার ৪৪৯ জন। দৈনিক মৃত্যু ১০৩ জনের। প্রতি এক লাখে মারা যায় ২৪ জন (সূত্র : এনহ্যান্সিং অপরচুনিটিজ ফর কিন অ্যান্ড রিসিলিয়েন্ট গ্রোথ ইন আরবান বাংলাদেশ, ২০১৮। প্রযুক্তি নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি, কিন্তু মূল কথাগুলো বলি না, অর্থনৈতিক সাশ্রয় কিভাবে কতটা হবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর খুব একটা ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ ৪৭ বছরে যতটুকু এগিয়েছে, তাতে ৮০ শতাংশই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবদান বেশি। মাত্র ৬৫ ওয়াটের একটি সোলার প্যানেল দিয়ে টেলিভিশন, কয়েকটি বাতি ও ওয়াশিং মেশিন চালানো সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এ কাজটি অতি সহজ। এ তথ্য হয়তো অনেকেরই অজানা। বন্ধু চুলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ চুলায় ধোঁয়া থাকে না। রান্নাও দ্রুত হয়। খুব কম জ্বালানি লাগে। এর দামও অনেক কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পৃথিবীর ১০০ কোটির বেশি মানুষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান-মাত্রার চেয়ে খারাপ মানের বায়ু গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে এবং প্রতি বছর পৃথিবীর শহরগুলোতে বায়ুদূষণের কারণে আট লাখ মানুষ মারা যায়। ব্যক্তি থেকে সরকারপর্যায়ে বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ছে এবং মানুষের কর্মদিবস নষ্ট হচ্ছে। আমাদের দেশে যানবাহন, কলকারখানা ও ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া এবং নির্মাণকার্যক্রমের সৃষ্ট ধূলিকণার কারণে প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণ হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশের ১৫ শতাংশ রোগ বায়ুদূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্য দিকে উন্নত দেশের মোট রোগের ২.৬ শতাংশ বায়ুদূষণের সাথে সম্পর্কিত। আমাদের দেশে বায়ুদূষণে মা ও শিশু থাকে সবচেয়ে ঝুঁকিতে।
প্রকৃতি ও জীবন একে অপরের বন্ধু। বিশুদ্ধ প্রকৃতি ছাড়া সুস্থ জীবনযাপন একেবারেই অসম্ভব। আল্লাহর সৃষ্টিকে সাজিয়ে রাখব আমরা। যেভাবে আল্লাহ সাজিয়ে দিয়েছেন সৃষ্টির ঊষালগ্নে। আমরা নগরায়ন করতে গিয়ে নগরকে ইট-পাথরের বস্তু বানিয়ে ফেলেছি। এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।
অপরিকল্পিত সব কিছু গড়ে ওঠার কারণে স্বাস্থ্যগত সমস্যা, আর্থিক ক্ষতি, সময়ের অপচয় ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যায় নগরবাসী আক্রান্ত। আমাদের নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী বহু বছর ধরে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন বের হওয়া ৯০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পড়ছে পাঁচটি নদীতে। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি ২০১৩ বংশীর পানির দূরীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল শূন্য মিলিগ্রাম। পরিবেশ আইন বলছে, পানিতে জীবের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রতি লিটার পানিতে ন্যূনতম পাঁচ মিলিগ্রাম ডিও দরকার। অর্থাৎ দূষণের কারণে অক্সিজেনও তৈরি হতে পারছে না।
বাংলাদেশের ৫০ শতাংশের বেশি দূষণ হয় বুড়িগঙ্গা ও বংশী নদী থেকে আসা বর্জ্যরে কারণে। এটি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ঢাকার কোনো নদীর দূষণ কমানো যাবে না। জেলা প্রশাসন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদফতর, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও দফতর কোনো-না-কোনোভাবে নদীর সাথে জড়িত। এদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই, বরং দোষারোপ চর্চা আছে। সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করে খোদ পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক গোলাম রব্বানী বলেছেনÑ যেখানে সবার দায় থাকে, সেখানে কারো দায় নেই। এই হলো আমাদের অবস্থা।
গ্যাসের স্বল্পতা নিয়ে নানা গল্প শোনা যায়। একসময় শুনেছি যা গ্যাস আছে তাতে ৫০ বছরে গ্যাসের কোনো সঙ্কট বাংলাদেশে হবে না। প্রতিটি এলাকায় আমরা গ্যাস সংযোগ দিতে পারব। অবাক লাগে, ২০১৪ সাল থেকে নতুন সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। বন্ধুত্বের নামে সব কিছু উজাড় করে দেবোÑ এটা কী করে হয়। এ রকম কোনো দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। ঢাকার মানুষ এখন এলপি গ্যাস ১২ কেজি এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ১৫০ টাকায় কিনে বাসাবাড়িতে ব্যবহার করছে। এলপি গ্যাস খুবই ঝুঁকিপূর্ণÑ সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে কয়েকজনের মৃত্যু ও আহতের কথাও পত্রিকায় উঠেছে। এলপি গ্যাসের গুণগত মানও ভালো নয়। ১২ কেজির মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ থাকে হাওয়া। মানুষের ভোগান্তি নানাভাবে বাড়ছে। যেসব জ্বালানিতে বায়ুদূষণ কম হয়, সে রকম জ্বালানি যানবাহনে ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। যেমনÑ সিসামুক্ত পেট্রল, অকটেন ও কম সালফারযুক্ত ডিজেল। বেশি পুরনো গাড়িতে বায়ুদূষণ বেশি হয়। সঠিক যন্ত্রাংশ দিয়ে সঠিক সময়ে যানবাহন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। ভেজাল ও নিম্নমানের অকটেন, পেট্রল, ডিজেল ও বেশি মাত্রার সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহার করলে বায়ুদূষণ বেশি হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, গাড়িমালিক বা চালকদের সজাগ থাকতে হবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রোগ বায়ুদূষণের সাথে সম্পর্কিত। অন্য দিকে, উন্নত দেশের মোট রোগের দুই-ছয় শতাংশ বায়ুদূষণের সাথে সম্পর্কিত। অ্যাজমা, হৃদরোগ ও ফুসফুসের রোগ যাদের রয়েছেÑ তাদের অকালমৃত্যু বায়ুদূষণের কারণে হয়ে থাকে। পরিবেশ বিপর্যয়ে উল্লিখিত কারণে স্বাস্থ্যগত অর্থনৈতিক খরচ বাড়ছে। হ
লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক
harunrahidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement