১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


৪ বছরে ২টি ছাগল হলো ২৯টিতে

৪ বছরে ২টি ছাগল হলো ২৯টিতে - ছবি : সংগৃহীত

বিয়ের পর থেকেই নানা কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয় চলিশোর্ধ্ব ছাবুরা খাতুনের। এর পর তার জীবনে ঘটে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঘটনা। ছবুরা বলেন, দুই ছেলে-মেয়ে রেখে স্বামী পালিয়ে গিয়ে আরেকটি বিয়ে করেন। তখন তার চারপাশে আরো অন্ধকার নেমে আসে। কোলের দুই শিশু নিয়ে অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ করে জীবন চালাতে হয় উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চর জাঙ্গালিয়া গ্রামের সহায় সম্বলহীন ছবুরাকে।

তবে বহু কষ্টের পর এবার একটু একটু করে সুখ ফিরতে শুরু করেছে স্বামী পরিত্যক্তা এই নারীর। ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ জাতের ছাগলের খামার গড়ে তুলে ভাগ্য ফিরেছেন তিনি। এখন তার আর অভাব অনটন নেই। হাতে টাকা-পয়সাও থাকে ভালো। তাই বেশ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটছে তার। কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বরং এখন তিনি স্বাবলম্বী, জানালেন ছবুরা।

ছেলে-মেয়েকে লেখা-পড়া শেখানোর পাশাপাশি মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়েও দিয়েছেন। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরে নিজ বাড়িতে এই প্রতিবেদককে ছবুরা জানালেন নিজের সংগ্রামমুখর দিনগুলোর কথা।
তিনি বলেন, ২০ বছর আগে স্বামী মো. তসলিম তাদের দুই বছর বয়সী এক মেয়ে ও তিনবছর বয়সী এক ছেলে শিশুসহ তাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। দীর্ঘদিন কোন হদিস মেলেনি তার। পরে জানতে পারেন পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে সে।
এরপর শুরু হয় ছবুরার কষ্ট আর সংগ্রামের জীবন। বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে কখনো খেয়ে কখনো না খেয়ে সংসার চালান তিনি। এভাবে সংগ্রাম করেই কাটাতে হয়েছে তার জীবনের বেশির ভাগ অংশ।
নিজের ভাগ্য ফেরার বিষয়ে তিনি বলেন, গত চার বছর আগে তিল তিল করে জমানো ৭ হাজার টাকা দিয়ে দু’টি ছাগল কেনেন ছবুরা। সেই ছাগলের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে তা ২৯টিতে দাঁড়িয়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়েছেন তিনি।
ছবুরা বলেন, ‘অভাব অনটন আর কষ্টে কেটেছে জীবনের ১৮টি বছর। গত চার বছর আগে জমানো টাকা দিয়ে দু’টি দেশীয় জাতের ছাগল কিনি। দু’টি ছাগল থেকে বেড়ে হয়েছে ২৯টি। চার বছরে বিক্রি করেছেন ২০টি ছাগল।’
তিনি বলেন, মেয়েকে এসএসসি পাস করেয়েছি। বিয়েও দিয়েছি ভালো ঘরে। ছেলেকেও পড়াশোনা করাচ্ছি। সে এখন কলেজে পড়ে। এখন সংসারে আর কোনো অভাব নেই। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে হয় না। বেশ সুখেই দিন কাটছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, নিজ বসতঘরের একটি কক্ষে ছাগল পালন করেন তিনি। সন্তানের মতোই পরম মমতায় লালন-পালন করেন এসব ছাগল।
ছবুরাদের গ্রামজুড়ে বিভিন্ন বাড়িতে ছোট ছোট খামার তৈরি করে পালন করা হচ্ছে পৃথিবী বিখ্যাত ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ জাতের ছাগল। এই পথ ধরে গ্রামের অনেক নারীই এখন স্বাবলম্বী।
তাদের একজন একই গ্রামের উত্তর পাড়ার বাসিন্দা হাফিজুল ইসলামের স্ত্রী রহিমা বেগম। তিনি বলেন, কোন নয়-ছয় করে নয়, টানা ছয় বছর ধরে ছাগল পালনে ভাগ্য ফিরেছে তার।
আলাপ-চারিতায় জানালেন, মাত্র ১৪ বছর বয়সে পাশের গ্রামেই বিয়ে হয়েছিল তার। স্বামী হাফিজুল ইসলাম তখন ছিলেন বেকার। কারণে-অকারণে তাকে টাকা নিতে বাবার বাড়িতে পাঠাতেন। অনেক সময় টাকা না নিয়ে ফিরলে নানা গঞ্জনা শুনতে হত ।
বাবার বাড়ির লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে সাতবছর আগে স্বামীসহ তাকে নিয়ে আসেন চর জাঙ্গালিয়া গ্রামে। এরপর বাড়ির পাশেই তার জন্য একটি খড়ের ঘর তৈরি করে দেন। এরপরই কিছু টাকা দিয়ে শুরু করেন ছাগল পালন।
তিনি বলেন, প্রথমে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে দু’টি ছাগল কিনি। গত বছর দুই লাখ টাকার ওপরে ছাগল বিক্রি করেছি। সংসারের খরচ মিটিয়ে এক লাখ টাকা সঞ্চয়ও হয়েছে। বর্তমানে তার খামারে ছাগল আছে ১৬টি।

রহিমার স্বামী হাফিজুল ইসলাম বলেন, আমার বউ ছাগল পালন করে সংসারের কষ্ট দূর করেছে। আমরা এখন অনেক সুখী।
একই গ্রামের বাসিন্দা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন বলেন, গ্রামের নি¤œ আয়ের কয়েকটি পরিবারের নারীরা খুবই সংগ্রাম করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তারা গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য উদাহরণ।
প্রথমে একজন, দুইজন-এখন তাদের দেখাদেখি আরো অনেক গৃহবধূই নিজ উদ্যোগে ছাগলের খামার গড়ছেন বলে জানান এই জনপ্রতিনিধি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, প্রতি বছর বাংলাদেশে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ ছাগল থেকে প্রায় সোয়া লাখ টন মাংস পাওয়া যায়। মোট চাহিদার ২৭ শতাংশ পূরণ হয় এই ছাগলের মাংস দিয়ে। চামড়াশিল্পের চাহিদা পূরণে ২ দশমিক ৩২ মিলিয়ন স্কয়ার মিটার চামড়া আসে ছাগল থেকে।


আরো সংবাদ



premium cement