১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ বছর

-

পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নামের তিনটি জেলার মোট ৫০৯৩ বর্গমাইল আয়তন। এই বাংলাদেশেরই এক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এটি। দেশী-বিদেশী সব ষড়যন্ত্রের মুখে চুনকালি মেখে আজো সাহসীচিত্তে পাহাড় বলছেÑ ‘আমি বিচ্ছিন্ন হইনি, আমি বাংলাদেশকে ছাড়িনি, ৩০ হাজার বাঙালির অশরীরী আত্মা আজো ডুকরে কেঁদে ওঠে; আমি এ দেশের নাগরিক; পাহাড়ে লতাপাতা খেয়ে, হাতিপোকা, ঘোড়াপোকার কামড় খেয়ে, ম্যালেরিয়ার যন্ত্রণাকে প্রতিহত করে এই দুর্গম বনাঞ্চল-অরণ্যে বসতি গড়েছিলাম। এটা কি কোনো অপরাধ!’ স্বজনহারা পার্বত্যবাসী বাঙালিদের আর্তনাদে আজো পাহাড়ের আকাশ-বাতাস-প্রকৃতি কেঁদে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি জীবন দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্যটিকে, হানাদার বাহিনী তখনো ৯ মাস ধরে নির্যাতন চালিয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের ওপর। অনুরূপভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্বর কথিত শান্তিবাহিনী তথাকথিত জুম্মল্যান্ড কায়েমের জন্য নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ৩০ হাজার বাঙালিকে হিটলারের কায়দায় হত্যা করেছিল। পরে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়েছিল ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। কারো কারো ভাষায়, এটি ‘শান্তিচুক্তি’ বলে অভিহিত হলেও ২২ বছর পরও শান্তি ফিরে আসেনি, বরং শান্তিচুক্তির লাইসেন্স দেখিয়ে অশান্তির আলামত এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিই ক্রমেই বলশালী হচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানবাধিকার, জেএসএস ও ইউপিডিএফ নামধারী সশস্ত্র যুবকদের হাতে লুণ্ঠিত হচ্ছে তিন জেলার মানুষের গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও বেঁচে থাকার আকুল প্রত্যাশা। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে সরকারি মহল এই চুক্তিকে লালন ও পালন করে ধাপে ধাপে সব ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করেছে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের হাতে। সরকারের আন্তরিকতা ও চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা যতই প্রমাণিত হচ্ছে ততই অন্যপক্ষ চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে আরো উগ্র মনোভাব দেখিয়ে চলেছে। ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ থেকে ২ ডিসেম্বর ২০১৯, দীর্ঘ সময়ে পাহাড়ের বাঙালি ও উপজাতি জনগণ সন্ত্রাস, বন্দুকযুদ্ধ, চাঁদাবাজি, খুন, ডাকাতি, অপহরণ প্রভৃতি ছাড়া শান্তি মূলত পাননি। বরং চুক্তির লাইসেন্স পেয়ে সন্ত্রাসীরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে লক্ষ্যের (কথিত জুম্মল্যান্ড) দিকে এগিয়ে চলছে।

২২ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে চাওয়া-পাওয়ার বিরাট গরমিল দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের মানুষ ‘যা চেয়েছিলাম তা পাইনি আর যা পেয়েছি, তা চাইনি!’ আজো আমরা দেখি পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ শ্যামল নিসর্গ যেন এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড। বিস্তীর্ণ পাহাড় ও উদার প্রকৃতির অবারিত হাতছানি দেয়া এই পাহাড় সন্ত্রাসীদের সঙ্কীর্ণতা, হিংস্রতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতায় বারবার রক্তাক্ত হচ্ছে। কোনো বন্যপ্রাণী নয়, অন্ধকার থেকে নেমে আসা সশস্ত্র যুবকরাই হায়েনার মতো থাবা বসাচ্ছে বাঙালি জনগোষ্ঠীর কুঁড়েঘরে। শান্তির লালিত বাণী এখানে কেঁদে বেড়ায়। বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম ভূমি কমিশন, লোগাং ঘটনা, কল্পনা চাকমা উপাখ্যান, চাকমা শরণার্থী সমস্যা, খুনি বাহিনীর হাতে ৩০ হাজার বাঙালির আত্মদান, অজস্র সুযোগ-সুবিধা পেয়েও ষড়যন্ত্র, ৮৮ গুচ্ছগ্রামে লক্ষাধিক বাঙালি পরিবারের মানবেতর জীবন, অবলুপ্ত-শান্তিবাহিনীর ৫ দফা (আসলে অনেক বেশি দফা), ভারত সরকারের উদ্যোগে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতা, উপজাতীয় নেতাদের রাজনৈতিক তৎপরতা, বাঙালি বসতি স্থাপন, শান্তিবাহিনীর সহিংসতার রূপ প্রভৃতি পর্যালোচনা করে হিসাবের খাতায় তেমন কিছুই মিলছে না। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম। তবু সেখানে নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে গেলেই অপহরণ, মুক্তিপণ, চাঁদাবাজি, অগ্নিসংযোগের আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়ায়। ঢাকার উৎসব ও মেলা, শিল্পকলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, প্রেস ক্লাব, বড় বড় হোটেল শহীদ মিনার, টিএসসি বা জাদুঘরÑ কোথাও উপজাতিদের অবাধ বিচরণে বাধা নেই। কিন্তু প্রকৃতির আনন্দপ্রত্যাশী সমতলের বাঙালি নাগরিকরা অবাধে ও নিশ্চিন্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণে আসতে পারেন না কেন? অনিবার্য প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে, ‘কেন অবাধে সাজেক ভ্রমণে যেতে পারব না? তুমি পার্বত্যবাসী বাঙালিদের নামে কুৎসা রটাতে পারলে, আমি কেন ন্যূনতম বাঁচার দাবিটা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদকে জানাতে পারি না? কেন আমাকে শুভলং, বরকল, আলুটিলা, বাঘাইছড়ি, দীঘিনালা, স্বর্ণমন্দির, পর্যটনের ঝুলন্ত ব্রিজ ভ্রমণে যেতে বাধা দেয়া হবে? কেন আমার গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়? কী আমার অপরাধ? আমি বাঙালি বলেই কি এহেন বৈষম্যর একই পাহাড়ে বসবাস করেও আমি আয়কর বা ভ্যাট না দিলে সরকারি কার্যাদেশ পাই না, অথচ আয়কর বা ভ্যাট না দিয়েই ‘উপজাতি কোটায়’ বড় বড় কাজগুলো বাগিয়ে নেয়া যায়। আমি প্রথম বিভাগ পেয়েও উচ্চশিক্ষা পাই না, তুমি তৃতীয় বিভাগ নিয়েও মেডিক্যালে পড়তে পার কিভাবে? আমাকে কঠিন প্রতিযোগিতা করে চাকরি পেতে হয়, তোমাকে কেন তা করতে হয় না? এর পরও শান্তি নেই কেন পাহাড়ে? বিগত তিন যুগ ধরে অব্যাহত সন্ত্রাস চলে আসছে। চুক্তির পর এ জাতীয় সন্ত্রাসের স্বরূপ কিছুটা পাল্টেছে। রাষ্ট্রদ্রোহী বাহিনী সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয় ১৯৭৫ সাল থেকে। তারা সেনাবাহিনী, বিডিআর, ভিডিপি, পুলিশ, আনসার ও নিরস্ত্র বাঙালিদের পল্লীতে গেরিলা হামলা শুরু করেছিল। তারা পানছড়ি, তাইন্দং, কবাখালী, মেরুং, খাগড়াছড়ি, মাটিরাঙ্গা, ভূষণছড়া, লংগদু, দীঘিনালা, কাপ্তাই, থানচি, মহালছড়ি বাদ রাখেনি। সর্বত্রই এই প্রভৃতি কোনো এলাকার প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। অথচ বৌদ্ধ ধর্মানুসারীরা বলে থাকে ‘জীবহত্যা মহাপাপ, অহিংসা পরমধর্ম।’ ১৯৮৮-৮৯ সালে তিন পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচন বানচাল করতে শত শত টাইম বোমা ফাটানো হয়েছিল। সেদিন মিষ্টির প্যাকেট, চালের বস্তা, পুস্তকের মোড়ক প্রভৃতির মাধ্যমে বোমা বিস্ফোরণে বহু নিরীহ বাঙালি হত্যা করা হয়েছিল। এমনকি, ১৯৯৬ সালে বাঘাইছড়ি পাকুয়াখালী গহিন অরণ্যে ‘শান্তি আলোচনার’ দাওয়াত দিয়ে শতাধিক নিরপরাধ কাঠুরিয়াকে নিষ্ঠুরভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। তারও কোনো বিচার করা হয়নি। সর্বশেষ, রাঙ্গামাটি জেলাধীন নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা হত্যা, পরদিন মহালছড়িতে জিপে ব্রাশফায়ারে ছয়জন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নেতাকে হত্যা, বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচনের দিন বিকেলে আটজন নির্বাচনকর্মীকে হত্যা, খাগড়াছড়ি স্বনির্ভর বাজারে সাতজন হত্যা, তিন পার্বত্য জেলার সর্বত্র খুন-ডাকাতি চাঁদাবাজি, ‘আদিবাসী’ নামের আড়ালে দক্ষিণ সুদান ও পূর্ব তিমুরের আদলে বিনা রক্তপাতে ‘জুম্মল্যান্ড’ হাসিলের অপকৌশল, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ উপজাতীয় নেতাকর্মী হত্যা, জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিটির মাধ্যমে পাহাড়ে গণভোটের আড়ালে মতলব হাসিলের কারসাজি চলছে।

সর্বশেষ গত ১৮ অক্টোবর রাঙ্গামাটিতে আহূত শান্তি-শৃঙ্খলা সভায় আমন্ত্রণ জানানোর পরও তাতে সন্তু লারমার যোগদান না করাটা খুবই রহস্যজনক ও উদ্বেগজনক বলে পর্যবেক্ষক মহলের মনে আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ওই সভায় বিজিবি, পুলিশ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, এমপিসহ সরকারের সব মেশিনারিকে এক করলেও সন্তুর অনুপস্থিতি সেই মহৎ উদ্দেশ্যকে বানচাল করে দিয়েছে। তদুপরি, শান্তিচুক্তির পর সরকার বহু সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে এবং বর্তমানে সেখানে যুদ্ধ বিগ্রহ না থাকলেও প্রায়ই দুর্গম এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনীর টহল ডিউটির জিপে হামলা করে হতাহত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাসীরা এতদিন নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বন্দুকযুদ্ধ চালিয়ে এখন তারা এতই বেপরোয়া যে, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর ব্রাশফায়ার চালিয়ে নিজেদের শক্তির মহড়া দিতে দ্বিধা করছে না। সম্প্রতি আফগানিস্তানে মার্কিন সরকার তালেবানদের সাথে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু, বিদ্রোহী তালেবানদের অস্ত্রে একজন মাত্র মার্কিন সেনা হত্যার পর সাথে সাথেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন। আমাদের সরকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ ১২ শতাধিক সেনা হত্যা, চুক্তি লঙ্ঘন, রাষ্ট্রদ্রোহী অপতৎপরতা, নানাবিধ ষড়যন্ত্র প্রভৃতির পর ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ এর শান্তিচুক্তিকে স্থগিত বা বাতিল করতে পারবেন? বাংলাদেশের জনগণ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের নাগরিক। বিনা ঘোষণায়, বিনাযুদ্ধে অতর্কিত হামলা করে যারা সৈনিক হত্যা করছে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কম্বিং অপারেশন শুরু করতে হবে এবং দেশদ্রোহী সন্ত্রাসীদের আস্তানা ধ্বংস করে দিতে হবে। সন্ত্রাসীদের আর কোনো অনুকম্পা প্রদর্শন করা সমুচিত হবে না। ২ ডিসেম্বর ২০১৯ যে শান্তিচুক্তির ২২তম বর্ষপূর্তি দিবস, সেই স্মরণীয় দিনটি তখনি সার্থক হবে, যখন বাঙালি জাতি পাহাড়ে নিজেদের নিরাপদ বোধ করবে। নিরাপত্তা বাহিনীর শহীদ সৈনিকদের আত্মাও এর মাধ্যমেই শান্তি পাবে। জাতি পাবে তার মানচিত্র রক্ষার প্রকৃত সম্মান। হাজারো শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।

লেখক : সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাঙ্গামাটি জেলা ইউনিট এবং পার্বত্য বাঙালি ছাত্র-গণপরিষদ, পার্বত্য গণপরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা
zaman7472@gmail.com/
mibrahimpt1988@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement