২০ মে ২০২৪, ০৬ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫
`


বিশ্ব টেলিভিশন দিবস

-

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে মুদ্রণ মাধ্যমকে ছাপিয়ে নতুন হিসেবে নিজেদের জায়গা দখলের প্রতিযোগিতায় নামে সম্প্রচারমাধ্যম। প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে টিভি বা টেলিভিশনকেই সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে বিবেচনায় আনে বর্তমান বিশ্ব। ১৮৬২ সালে তারের মাধ্যমে স্থিরচিত্র পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। বলা যায়, টেলিভিশনযাত্রার প্রাথমিক সক্ষমতা ওখানেই। বিজ্ঞানী মে ও স্মিথ ইলেকট্রনিক সিগন্যালের মাধ্যমে প্রথম ছবি পাঠানোর পদ্ধতি খুঁজে পান।

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন লগি বেয়ার্ড যখন ‘টেলিভিশন’ আকৃতির রূপটি আবিষ্কার করেন ততদিনে অনেক দূর পৌঁছে গেছে মানুষের আকাক্সক্ষা আর কল্পনা। গ্রিক শব্দ ‘টেলি’ অর্থ দূরত্ব আর ল্যাটিন শব্দ ‘ভিশন’, মানে দেখাকে সমন্বয় করে, দাপুটে গণমাধ্যমটির নাম ‘টেলিভিশন’ হিসেবে প্রকাশ করা হয় সেই ১৯২৬ সালে। গণমাধ্যম বিবিসি ১৯৩৬ সালে প্রথম সাদা-কালো ছবি দ্বারা টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করেছিল। এ ক্ষেত্রে রুশবংশোদ্ভূত সম্প্রচার প্রকৌশলী আইজ্যাক শোয়েন বারগোরকে কৃতিত্ব দিতে হয়।

‘বাণিজ্য’ শব্দটি বেশ মুখরোচক হলেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়াও কম নয়। টেলিভিশনের ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে সত্য। ১৯৪০ সালেই বাণিজ্যিকভিত্তিতে ‘টেলিভিশন’ সম্প্রচার শুরু হয়ে যায়। বিশেষ প্রেক্ষাপটে তার পূর্ণতা দ্রুতবেগে হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ‘টেলিভিশন’কে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সুযোগ এনে দেয়। ’৫০-এর দশকে পরিপূর্ণ গণমাধ্যমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় টিভি।

শব্দ ও ছবিকে একত্রে একই প্যাটার্নে সম্প্রচার করার ধারণাই হচ্ছে ‘টেলিভিশন’। অনেক প্রযুক্তির এখানে সমন্বয় হয়ে থাকে। মূলত তড়িৎ চৌম্বকীয় সাঙ্কেতিক রূপান্তরটিই বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। টেলিভিশনের মূল অংশটি তা গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। টেলিভিশন সাধারণত প্রাথমিক আবিষ্কার স্থিরচিত্রের জন্যই কাজ করে থাকে। চলচ্চিত্র, ভিডিও, সিনেমা, নাটক আসলে স্থিরচিত্রেরই সমন্বিত রূপ। অনেকগুলো স্থিরচিত্র খুব দ্রুত গতিতে গ্রহণ করে থাকে ভিডিও ক্যামেরা।

টেলিভিশন হতে নির্গত ক্ষতিকর গামা রশ্মি থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই স্বাস্থ্যঝুঁঁকি কমতে থাকে। চিকিৎসকেরা এ কারণেই টিভি দেখতে সতর্কবার্তা দিয়ে থাকেন। তবে স্বাস্থ্যসম্মত, ক্ষতিবিহীন নিখুঁত ঝকঝকে টেলিভিশন দেখাতে অবিরাম প্রচেষ্টার ফল আমরা ভোগ করছি। কাঠের বাক্সওয়ালা টেলিভিশন অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। নিত্যনতুন প্রযুক্তির এলইডি, এলসিডি, প্লাজমা নামের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর টেলিভিশন বাজারজাত হচ্ছে। সম্প্রচারনীতিতেও আনা হয়েছে ব্যাপক সৃজনশীলতা। বলা হয়ে থাকে, অ্যানালগ সম্প্রচার, ডিজিটাল সম্প্রচার, অতি সাম্প্রতিক এইচডিটিভি সম্প্রচার।

টেলিভিশন সম্প্রচার শুরুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৪ সালে ঢাকায় যখন সাদা-কালো টেলিভিশনের যাত্রা শুরু করে, তখন এই উপমহাদেশের অনেক দেশই তা চিন্তা করেনি। ঢাকা টেলিভিশনে প্রচারিত, প্রথম গানটি ছিল অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা- ‘এই যে আকাশ নীল হলো আজ/এ শুধু তোমার প্রেমে’। গেয়েছিলেন কোকিলকণ্ঠী ফেরদৌসী রহমান।

প্রথম প্রযোজক ছিলেন মুস্তফা মনোয়ার, জামান আলী খান ও মনিরুল ইসলাম। অনুষ্ঠান বিভাগের প্রথম ব্যবস্থাপক ছিলেন কলিম শরাফী। মাত্র ১০ মাইল এলাকার সম্প্রচারসীমা নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ঢাকা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো। দেশের গণ্ডি পেরিয়েছে অনেক আগে। ১৯৮০ সালেই বিটিভি হয়ে গেছে রঙিন। সরকারি সম্প্রচারনীতিও প্রণীত হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রামে পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচার কেন্দ্র ছাড়াও বিটিভি ওয়ার্ল্ড ২০০৪ সাল থেকে সম্প্রচারিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন’ নামে পূর্ণাঙ্গ চ্যানেল চালু হয়েছে ২০১১ সালে। বেসরকারিভাবে ৩১টি পূর্ণাঙ্গ টিভি চ্যানেল অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে যাচ্ছে। আরো সাতটি সরকারি অনুমোদন নিয়ে সম্প্রচারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে কয়েকটি চ্যানেল। এ পর্যন্ত ৪৪টি চ্যানেল অনুমোদন নিয়েছে। কয়েকটি চ্যানেল বন্ধ হয়েছে।

বিনোদনমূলক চ্যানেল, সংবাদ চ্যানেল, ধর্মীয় চ্যানেল, চলচ্চিত্র চ্যানেল ইত্যাদি নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে অনেক টেলিভিশন চ্যানেল। জাতীয় জীবনে সর্বত্র সর্বক্ষেত্রে টেলিভিশন সৃজনশীল ভূমিকা পালন করছে। নীল আর্মস্ট্রং যখন চাঁদের বুকে অবতরণ করেছিলেন, তখন আমেরিকার হিউস্টন থেকে প্রথমবারের মতো টিভির সরাসরি সম্প্রচার দৃশ্য সারা বিশ্বের মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল।

সারা বিশ্বের খেলাধুলা, রাজপুত্রের বর্ণাঢ্য বিবাহ, পবিত্র হজসহ হাজারো ঘটনা আমরা ঘরে বসেই সরাসরি দেখতে পাচ্ছি। নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিকাশে সঙ্গীত, নৃত্য, উপস্থাপনা, বাচনভঙ্গি, নাটক, আবৃত্তি, কৌতুক, টকশো ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে টিভি। সমাজের নানা সমস্যা সমাধানে, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে, সাধারণ জ্ঞান প্রচারেও অবদান রাখছে এই মাধ্যম। সমাজের নানা অসঙ্গতি, কালোবাজারি, দুর্নীতি, ধূমপান, চোরাচালান, মাদকের মরণনেশা, আইনশৃঙ্খলা, আইন-আদালত, নৈতিক অধঃপতন, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, শিল্পবোধ স্বাস্থ্য ও নির্মল বিনোদন, প্রভৃতি বিষয়ে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতিকে সমৃদ্ধ করছে ‘টেলিভিশন’।

উন্নয়নশীল-দরিদ্র দেশগুলোতে বিলাসসামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না টেলিভিশনকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে টেলিভিশন একটি আকর্ষণীয় মাধ্যম। জনকল্যাণের মাধ্যমে দেশ ও জাতির উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে এটির ভূমিকা সর্বজনবিদিত।
টেলিভিশনে সম্প্রচার গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসঙ্ঘ ১৯৯৬ সালে এ বিষয়ে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দিন হিসেবে বেছে নেয়া হলো ২১ নভেম্বরকে।

১৯২৬ সালের এই দিনে জন বেয়ার্ড টেলিভিশন আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় টেলিভিশনকে অপার মর্যাদায় আসীন করা হয় এই দিনে।


আরো সংবাদ



premium cement