১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


জিম্বাবুয়ের বিকল্প মুদ্রা

-

আফ্রিকার এক সময়ের খাবারের ভাণ্ডার ধরা হতো জিম্বাবুয়েকে। কিন্তু শিল্পকারখানার অব্যবস্থাপনা, খাদ্য সঙ্কট, মুদ্রাস্ফীতি ও চরম দুর্নীতির মাধ্যমে এই অবস্থার পতন ঘটে। প্রায় চার দশক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রবার্ট মুগাবেকেই জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক ধসের জন্য দোষারোপ করা হয়। জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারেতে ট্যাংক নামিয়ে ৯৩ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবেকে গৃহবন্দী করে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জিম্বাবুয়ের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নিয়েছিল সে দেশের সেনাবাহিনী। কিন্তু দেশটিতে এখনো চলছে অর্থনৈতিক সঙ্কট।
বিশেষ করে মুদ্রা নিয়ে বহু দিন ধরে সঙ্কটের মধ্যে আছে জিম্বাবুয়ে। দীর্ঘস্থায়ী মুদ্রা সমস্যা নিরসনে সম্প্রতি জিম্বাবুয়ে চালু করেছে নতুন এক ধরনের বিনিময় ব্যবস্থা। অনেকে একে নতুন মুদ্রাব্যবস্থা হিসেবেও অভিহিত করেছেন। কিন্তু এর প্রভাব সম্পর্কে এখনো কারো স্পষ্ট ধারণা নেই। নতুন এ ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশটির সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ এনকোসানা ময়ো বলেন, ‘কেউ জানে না এটা কী জিনিস।’
২০০৮ সালে দেশটির অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে এবং মুদ্রাস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যায়। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে জিম্বাবুয়ের ডলার কার্যত মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে দেশটি জিম্বাবুয়ে ডলার বাতিল করে মার্কিন ডলারকে তাদের মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করে। এর ফলে সৃষ্টি হয় নতুন সমস্যা। দেশটির সরকার সুদের হার নির্ধারণ ও টাকা ছাপানোর ক্ষমতা হারায়। এ ছাড়া রফতানি ব্যয় পরিশোধ বাবদ প্রচুর মার্কিন ডলার বিদেশে চলে যেতে থাকে। বৈদেশিক আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে পড়ায় দেখা দেয় ডলার সঙ্কট। যার কারণে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করতে দেশটির মানুষকে হিমশিম খেতে হয়।
২০১৬ সালে সরকার নতুন মুদ্রাব্যবস্থা প্রচলন করে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে বন্ড নোট ও কয়েন চালু করা হয়, যার মাধ্যমে নগদ লেনদেন করা যায়। এ বন্ড নোটের মান মার্কিন ডলারের সমানই ধরা হয়। মূলত তারল্য সঙ্কট ঠেকাতেই এ ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়। কিন্তু বন্ড নোট ও মার্কিন ডলারের মান সমানÑ এ কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। যার ফলে কালোবাজারে ডলারের বিপরীতে বন্ড নোট আবারো মান হারাতে শুরু করে।
এবার নতুন করে জিম্বাবুয়ে সরকার চালু করল রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস) ডলার। কেউ কেউ এটাকে দেশটির নতুন মুদ্রা হিসেবে অভিহিত করছেন। আরটিজিএসের আগে অর্থ পরিশোধের বিভিন্ন মাধ্যমের ওপর ভিত্তি করে বিনিময় হারও ছিল আলাদা। একজন গ্রাহক কী উপায়ে অর্থ পরিশোধ করছেন, তার ওপর ভিত্তি করে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন দাম পরিশোধ করতে হতো। বন্ড নোট, ডেবিট কার্ড ও মোবাইল মানির সম্মিলিত রূপ হিসেবেই এখন আরটিজিএস ডলারকে ধরা হচ্ছে। প্রতিটি মাধ্যমের মূল্যমান সমান করতেই নতুন এ ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বন্ড নোট ও মার্কিন ডলারের মান সমানÑ এ ধরনের কোনো মিথ্যা আশ্বাস দেশটির সরকার দেয়নি। সরকার বলছে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে আরটিজিএস ডলারের মান বাজারের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে।
ব্যবসায় সাংবাদিক ও ভাষ্যকারেরা আরটিজিএস ডলারকে নতুন মুদ্রা হিসেবে অভিহিত করলেও দেশটির সরকার এ ধরনের শব্দবন্ধ ব্যবহার করছে না। জিম্বাবুয়ে ডলারের কলঙ্কিত ইতিহাসের কারণে সরকার আগের ডলারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করেছে।
সহজ কথায় মুদ্রা বলতে বোঝায়, যা দিয়ে আমরা পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে পারি। এখন থেকে জিম্বাবুয়ে সরকার মার্কিন ডলারের পরিবর্তে আরটিজিএস ডলারের মাধ্যমেই জিনিসপত্রের দাম নির্ধারণ করতে চায়। এ প্রক্রিয়ায় ক্রেতারা আরটিজিএস স্বীকৃত নানা মাধ্যমে তাদের অর্থ পরিশোধ করতে পারবেন। ডেবিট কার্ড, বন্ড নোট ও মোবাইল মানির মাধ্যমে একজন ক্রেতা পণ্য বা সেবা কিনতে পারবেন।
আরটিজিএস ডলারকে অনেকটা মুদ্রার মতো মনে হলেও এর কোনো নোট বা কয়েন বের করার পরিকল্পনা দেশটির সরকারের নেই। জিম্বাবুয়ের বাইরে এ মুদ্রা ব্যবহার করা যাবে না। দেশটির সরকার জানিয়েছে, তারা চায় আরটিজিএস ডলারের মান বাজারের মাধ্যমেই নির্ধারিত হোক। তবে প্রাথমিকভাবে নতুন মুদ্রাটির বিনিময় মূল্য ডলারের বিপরীতে ২ দশমিক ৫০ আরটিজিএস ডলার ধরা হয়েছে। সাধারণ ক্রেতাদের ওপর নতুন মুদ্রাব্যবস্থার কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে দেশটির সরকার বলছে, তারা আশাবাদী। সরকার মনে করে, এর মাধ্যমে লেনদেন আরো সহজ হবে। কারণ বিভিন্ন মুদ্রা বা পেমেন্ট মেথডের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দাম নির্ধারণের কোনো ঝামেলা এখানে থাকবে না।
আফ্রিকার একসময়ের শক্তিশালী অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যান মুগাবে। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর ১৯৮০ সালে নতুন গঠিত জিম্বাবুয়ে রাষ্ট্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মুগাবে। তাকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলার মতো গুণাবলি এবং চিন্তাধারার কারণে। অনেক দশক ব্রিটিশ শাসনের পরে অনেকেই মনে করেছিলেন মুগাবে একটি সফল প্রধানমন্ত্রী হবেন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় মুগাবে। এই সময়ে রাষ্ট্রের শিল্প ও কৃষিপণ্যের রফতানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। বছরব্যাপী চাষাবাদের অনুকূল পরিবেশ এবং ভালো মানের তামাকের জন্য জিম্বাবুয়ে বিখ্যাত হয়ে যায়।
কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে মুগাবের রাজনৈতিক গতিবেগ মন্থর হয়ে আসে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তার বিরুদ্ধে নৃশংসতা ও ঘুষ নেয়া বিষয়ে চরম সমালোচনার ঝড় ওঠে। কিন্তু তিনি যথারীতি এমন সব অভিযোগ নাকচ করে যান। কৃষি খাতে মুগাবের চরম অব্যবস্থাপনা অর্থনৈতিক ধ্বসের এক অন্যতম কারণ ছিল। সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল শ্বেতাঙ্গ জমিদারদের সরিয়ে সবক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের সুযোগ করে দেয়া। ১৯৯২ সালের ‘ভূমি অধিগ্রহণ আইন’-এর আওতায় শ্বেতাঙ্গদের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করে সরকারি আওতায় তা কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং ১৯৯৩ সালে এই আইনের বিরোধীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার হুমকি দেয়া হয়।
জিম্বাবুয়ের এই পরিস্থিতি প্রকৃতপক্ষে হতাশাজনক। কেননা এই দেশটির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা তাদের হীরা, কয়লা, তামা, লোহা আকরিক ইত্যাদি সম্পদ রয়েছে। অতএব একজন সঠিক মানুষ দায়িত্বে এলে দেশটির অবস্থা দ্রুতই পরিবর্তন হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
সূত্র : বিবিসি ও সিএনএন


আরো সংবাদ



premium cement