২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যঝগড়ায় বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি

-

গত সপ্তাহে চীনের তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলারের আমদানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আরো এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি। জবাবে বেইজিংও পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি ভারতেরও কিছু পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করে। পাল্টা ভারতও কিছু পণ্যে শুল্ক আরোপের কথা জানিয়েছে। স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে শুল্ক আরোপ করায় ভারতের পাশাপাশি ক্ষেপেছে কানাডাও। গত মার্চে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ জুন ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে জানিয়েছে, তারা ৩০টি মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে। শুল্ক বাড়ানো হবে ৫০ ভাগ। স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে শুল্ক আরোপ করায় ভারতের ২৪০ মিলিয়ন ডলারের তি হয়েছে বলে জানায় ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও কানাডার এ জাতীয় বাণিজ্যঝগড়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন দিকে যাবে সে বিষয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন, এ ঝগড়া থেকে বাংলাদেশ সুবিধা নিতে পারবে। আবার কারো আশঙ্কা, ঝগড়ার উত্তেজনা আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারতের বাণিজ্যযুদ্ধ যদি নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তবে ট্যারিফ সুবিধার জন্য দুই দেশই বিকল্প বাজার খুঁজবে। বাংলাদেশের যদি যথাযথ প্রস্তুতি থাকে তবে এর ইতিবাচক সুযোগ নিতে পারবে। দুই দেশের অনেক বাণিজ্যই আমাদের বাজারগুলোতে নিয়ে আসতে পারব। এর জন্য উৎপাদনশীলতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। আর যদি এই বাণিজ্যযুদ্ধ বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তবে সবচেয়ে তিগ্রস্ত হবে আমাদের মতো বাণিজ্যনির্ভর দেশগুলো। তবে এখনকার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাগুলো শক্তিশালী হওয়ায় এ যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে না বলেই মনে করছেন তারা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবীদ ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, এর দুটো দিক রয়েছে। যদি এটি ছড়িয়ে পড়ে তবে বিশ্ববাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সঙ্কোচিত হবে বিশ্ববাণিজ্য। বাণিজ্য সঙ্কোচিত হলে আমরা যেহেতু বাণিজ্যের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল দেশ তাই আমাদের আয়, উৎপাদন আয়, কর্মসংস্থান বিশ্ববাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। সেেেত্র আমাদের ওপর নেতিবাচক ঝুঁকি রয়েছে।
আবার যদি সীমিত আকারে হয়, সেেেত্র চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ বেড়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও চীনের ট্যারিফ বেড়ে যাচ্ছে। অপর দিকে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যে শুল্ক আরোপ করায় ভারতও বেঁকে বসেছে। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের ৩০টি পণ্যে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। এটা হলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন-ভারত যে সব দেশ থেকে আমদানি করলে ওই ট্যারিফের সম্মুখীন হবে না সেসব দেশের বাজারে চলে যাবে। এেেত্র বাংলাদেশ যদি সেরকম প্রস্তুতি রাখতে পারে তবে আমাদের লাভই হবে। কারণ, তারা বেরিয়ে কোনো না কোনো দেশে তো যাবে। তবে বাংলাদেশ নয় কেন? কিন্তু যদি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে যেমনটা ১৯৩০-এর দশকে হয়েছিল। বিশ্বময় একটা বাণিজ্যযুদ্ধ চলেছে। সবাই সবার সাথে যুদ্ধ করেছে। এখনে যদি কানাডা, জাপান, রাশিয়া ইত্যাদি দেশগুলো জড়িয়ে পড়ে তবে ট্রেডওয়ারি কেউ বিজয়ী হবে না। মাঝখানে তি হবে অনেকের।
এ দিকে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, এ যুদ্ধের একটি নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দর কষাকষির ওপর পড়বে। ডব্লিউটিওর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের ওপরও এর প্রভাব আসতে পারে। তিনি বলেন, এই ধরনের শুল্ক বৃদ্ধি কোনো একটি দেশের জন্য প্রযোজ্য না হয়ে সাধারণভাবে ‘মোস্ট ফেবারড ন্যাশন’ মর্যাদার সব দেশের ওপর বর্তায়। এর ফলে বাংলাদেশ রফতানি করে এমন কোনো পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ালে সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, চীন থেকে তৈরি কাপড় আমদানি কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্ক বৃদ্ধি করে, তবে এটি বাংলাদেশের তৈরি কাপড়ের ওপরও প্রযোজ্য হবে। সেেেত্র বাংলাদেশ তিগ্রস্ত হবে। শুল্কবৃদ্ধির এই গোটা প্রক্রিয়ায় কে লাভবান হবে আর কে তিগ্রস্ত হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেনÑ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যেসব উৎপাদনকারী আছেন, তারা লাভবান হবেন। তিগ্রস্ত হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা ও বিদেশী রফতানিকারকেরা।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বর্তমানে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে চীন থেকে বাংলাদেশ বছরে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে। বিপরীতে বাংলাদেশ চীনে রফতানি করে বছরে মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এ ছাড়া, এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টের (এপিটিএ) আওতায় ২০১০ সাল থেকে চীনের বাজারে চার হাজার ৮৮৬টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে দেশটির প থেকে এ প্রস্তাব দেয়া হয়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ২০১৬ সালের অক্টোবরে ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে এফটিএ বাস্তবায়নের ল্েয একটি যৌথ সমীা যাচাই গ্রুপ গঠনে সমঝোতা স্মারক সই হয়। সে অনুযায়ী দুই দেশ গ্রুপ গঠন করে। এ গ্রুপ দুই দেশের এফটিএর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কাজ করছে।
উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, এখনো প্রায় ৪০ শতাংশ পণ্যে উচ্চ শুল্ক দিয়ে দেশটির বাজারে প্রবেশ করতে হয়। বড় বাজার চীনে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলে রফতানি বাড়বে বর্তমানের কয়েকগুণ। এরপরও ভয় আছে, দেশের আমদানিকৃত পণ্যের বেশির ভাগ পণ্যসামগ্রী চীনে তৈরি হয়ে থাকে। এ অবস্থায় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা হলে চীনা পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি (এফটিএ) করার মাধ্যমে চীন থেকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আনতে চায় বাংলাদেশ। চীনের ল্য বাংলাদেশে পণ্য রফতানি বাড়ানো। এ অবস্থায় এফটিএ হলে বাংলাদেশ-চীন কতটুকু লাভবান হবে সে বিষয়ে দুই দেশের যৌথ সমীা যাচাই গ্রুপের দু’দিনব্যাপী বৈঠক সম্প্রতি বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল