জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে ১৪শ কোটি টাকার অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের দরপত্র আহবানের মাধ্যমে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রথমে মোট ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে চার শত আশি কোটি টাকা। গত ২মে দরপত্র আহ্বানের বিজ্ঞপ্তি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সোমবার ছিলো দরপত্র বিক্রয়ের শেষ দিন।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কৌশলী ভূমিকা ও ছাত্রলীগের দরপত্রে সংশ্লিষ্টতা এই প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে সচেতন শিক্ষকরা মনে করছেন।এমনকি দরপত্র আহ্বান,সংগ্রহ,জমাদান ও সিড়িউল সংগ্রহের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ভঙ্গ করার অভিযোগও উঠেছে। বড় প্রকল্পে ই-টেন্ডার না করে ম্যানুয়াল প্রদ্ধতি অনুসরণকেও অনেকে দুরর্ভিসন্ধিমূলক বলছে।তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রশাসকরা বলছে,তড়িঘড়ি করে প্রথম ধাপের কাজ শুরু করায় কিছু ঝামেলা হয়েছে।বাকি কাজগুলো ই-টেন্ডারের মাধ্যমে করা হবে।
প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিতে ক্লিন ইমেজের শিক্ষক বা প্রশাসকদের না রেখে বিতর্কিতদের নিয়ে গঠন করাও অভিযোগ উঠেছে। কমিটিতে ভিসির ব্যক্তিগত সচিব সানোয়ার ও ইঞ্জিনিয়ার হাবিবেকে রাখায় ভিসিপন্থি ও ভিসিবিরোধী উভয় শিক্ষকরা সন্দেহের চোখে দেখছেন। ইতিমধ্যে সানায়ার ও হাবিব তাদের ঘনিষ্ট কোম্পানীকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য দরপত্র প্রক্রিয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং করছেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
দরপত্র সংগ্রহ করতে আসা একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর দরপত্র সিডিউল ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ২৬ মে বনানীস্থ ইউনাইটেড কনস্ট্রাকশন কোম্পানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বরাবর লিখিতভাবে এই অভিযোগ করেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, গত ২৩মে প্রি-টেন্ডার মিটিংয়ে অংশগ্রহন কওে সিডিউল কিনে ফেরার সময় ছাত্রলীগের পরিচয় দিয়ে ২৫-৩০জন নেতাকর্মী তাদের কাছ থেকে সিডিউল জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়। ফলে তাদের পক্ষে দরপত্র প্রতিযোগীতায় অংশ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই এই দরপত্র বাতিল করে পুনরায় দরপত্র (ইজিবি)আহবান করার অনুরোধ জানিয়েছে ইউনাইটেড কনস্ট্রাকশন কোম্পানী।
কোম্পনীর সাথে যোগাযোগ করে আরও জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে সিডিউল কিনে ওই কোম্পানীর একজন প্রতিনিধি। তিনি সিডিউল কিনে বের হলে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদকের অনুসারী একদল নেতাকর্মী তাদের কাছে সিডিউল চেয়ে বলেন, বিশ্বাসবিল্ডার্স সহ অনেকে আমাদের কাছে সিডিউল জমা দিয়ে গেছে। আপনারাও দিয়ে দেন। কালকে আমরা একটা সমঝোতা করে আপনাদের মধ্যেই ছয়জনকে ছয়টা কাজের ব্যবস্থা করে দিব।অনেকক্ষণ দরকষাকষির পর পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কোম্পানীর প্রতিনিধি ছাত্রলীগের কাছে ওই সিডিউল দিয়ে দেন।ইউনাইটেড কনস্ট্রাকশনের একজন ডিরেক্টর বলেন,আমাদের সিডিউল ছিনতাই করায় আমরা কোম্পানীর পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আছে লিখিত অভিযোগ করেছি। প্রধানমন্ত্রী দপ্তর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছেও অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।প্রশাসন ই-টেন্ডার না করে ম্যানুয়াল টেন্ডারের করেছে কিন্তু আমাদের কোন নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি। আমরা পুনরায় ইজিবি টেন্ডারের দাবি জানিয়েছি।
এরই সূত্র ধরে আরো খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বাস বিল্ডার্স,মাজেদ এন্ড সন্স, বঙ্গ বিল্ডার্সসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এমন ঝামেলায় পড়েছে। বিশ্বাস বিল্ডার্সের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বেশি কথা না বলে এ টেন্ডাওে আর অংশগ্রহণ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়।
এদিকে জাহাঙ্গীরনগর প্রকল্পকে ঘিরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌছেছে। শাখা ছাত্রলীগে বর্তমান ও সাবেক সাধারণ সম্পাদকের দুটি গ্রুপ আবারও মুখোমুখি অবস্থানে আসছে। ছাত্রলীগের কয়েকজন বঞ্চিত নেতাকর্মী জানায়,‘বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন প্রকল্পের অনুদানে দুই শতাংশ ক্ষমতাশীন ছাত্র সংগঠন পেয়ে থাকে। এই প্রকল্পেও দুই শতাংশ হারে প্রায় ২৯ কোটি টাকা পাবে ছাত্রলীগ। এই টাকা নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত রাখতে বর্তমান দুই নেতা হল কমিটি দেয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের এক কর্মী জানান, ‘যেহেতু অনুদানের পরিমান অনেক বড় তাই আমরা শাখা সভাপতি ও সম্পাদকের কাছে প্রতিটি হল ইউনিটকে কমপক্ষে ৮-১০ লাখ টাকা প্রদানের দাবি করেছি। কিন্তু এখন তারা আমাদেরকে এড়িয়ে চলছে।’
এছাড়াও দরপত্র ক্রয় ও জমা প্রদানকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ করা যায়। গত রোববার থেকে অগ্রণী ব্যাংক ও মুরাদ চত্ত্বরে অবস্থান নিতে দেখা যায় সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহমেদ অনুসারীদের।
প্রকল্পের টেন্ডার নিয়ে সেন্ট্রাল ছাত্রলীগের সাথে শাখা ছাত্রলীগের দরকষাকষি চরমে পৌছেছে। গত রোববার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জাবি ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে দেখে যায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। এসময় তাদের সঙ্গে জাবি শাখা ছাত্রলীগের কোন নেতাকে দেখা যায়নি। জাবি ছাত্রলীগের একটি বিশ্বস্তসূত্র জানিয়েছে,কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক নেতার আত্মীয় এই প্রকল্পের টেন্ডারের জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু শাখা ছাত্রলীগ তাকে অসহযোগীতা করায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাথে দূরুত্ব তৈরি হয়েছে।
এবিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা বলেন,‘সিডিউল সব কোম্পানীই কিনতে পারে। সবাই সিডিউল পাচ্ছেও। ছাত্রলীগ কেন বাধা দিবে। তাদের কোন অভিযোগ আমার জানা নাই। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য ছাত্রলীগ সোচ্চার আছে।এদিকে টাকা নিয়ে ভাগাভাগি সম্পর্কে তিনি বলেন,এখনও টেন্ডারই শেষ হয়নি আমরা কিভাবে টাকা পাবো।জুনিয়রকর্মীরা ভুল বুঝছে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’এর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নাসির উদ্দীন বলেন,আজ পর্যন্ত ২৫ টি সিডিউল কেনা হয়েছে। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা আমি শুনেছি। তবে প্রকল্প পরিচালক বরাবর কোন অভিযোগ আসেনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশবিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় এ বিষয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।এদিকে প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক নুরুল আলম বলেন,প্রকল্প নিয়ে আমি কিছুই জানি না। ট্রেজারার অধ্যাপক শেখ মোঃ মনজুরুল হক বলেন,আমি এই ধরনের কোন অভিযোগ পাইনি।কোন অসঙ্গতি থাকলে সেটা দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের।