১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


চাঁদ দেখা : সমস্যা ও সমাধান-৪

-

উক্ত ঘোষণার ক্ষেত্রে শর্ত হলো, এ ঘোষণা যেন সাধারণ সংবাদ বা সংবাদ পাঠের নিয়মে না হয় বরং তা ‘কেন্দ্রীয় চাঁদ দেখা কমিটির পক্ষে মনোনীত কোনো আলেম নিজে রেডিও, টিভি তথা প্রচারমাধ্যমের সামনে এমন ঘোষণা দেবেন যে, “আমাদের কাছে ‘চাঁদ দেখার সাক্ষ্য’ অথবা ‘সাক্ষ্য মোতাবেক সাক্ষ্য’ অথবা ‘ফায়সালা মোতাবেক সাক্ষ্য’-এর তিনটি পদ্ধতির মধ্যে অমুকটি উপস্থাপিত হয়েছিল। আমরা বিধি মোতাবেক নিশ্চিত হয়ে চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার ফায়সালা দিয়েছি এবং সরকারের/কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে আমরা সারা দেশের জন্য এ ঘোষণা প্রদান করছি।”
উক্ত মৌলিক কয়েকটি বিষয় চাঁদ দেখা ও সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত প্রশ্নে সকলের সামনে থাকা চাই।
বাস্তবায়ন : উক্ত সাক্ষ্য-নীতির নিরীখে তা বাস্তবায়ন ও শৃঙ্খলাবিধানে যদি কোনো জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়, তা হবে কেবল শেষের প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে অর্থাৎ ‘ফায়সালা মোতাবেক সাক্ষ্য’ পদ্ধতির ক্ষেত্রে । কারণ, এ ক্ষেত্রে এক জেলার উপকমিটির ফায়সালা কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য দু’জন সাক্ষীর সেখানে উপস্থিত হওয়া জরুরি মর্মে বিধান রয়েছে! যা কি না যদিও এ বিমান পথে যাতায়াতের যুগে অসম্ভব নয় বটে; কিন্তু তারপরও তেমনটি অবশ্যই জটিল ও কঠিন।
উক্ত জটিলতার সহজ বিকল্প ও সমাধান কী হতে পারে? এমন প্রশ্নে আজ থেকে প্রায় ৫৫ (পঞ্চান্ন) বছর পূর্বে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের চারজন শীর্ষস্থানীয় প্রসিদ্ধ পণ্ডিত গবেষক আলেমÑ যাঁরা একনামে উপমহাদেশের দ্বিনি পরিবেশে পরিচিতÑ তাঁদের সম্মিলিত বৈঠকে চিন্তা-গবেষণা করা হয়েছে। এঁরা হলেন : ১) হজরত মাওলান মুফতি মুহাম্মদ শফী র. ২) হজরত মাওলানা জফর আহমদ উসমানী র. ৩) হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নোরি র: ৪) হজরত মাওলানা মুফতি মুহম্মিদ রশিদ আহমদ র: । অর্থাৎ আলোচিত ‘সাক্ষ্য মোতাবেক গৃহীত ফায়সালার ক্ষেত্রেও তা অন্যত্র বাস্তবায়ন বা অন্য সকলের বেলায় প্রযোজ্য বলতে বা করতে গেলে সাক্ষ্য ও সাক্ষীসহ সেখানে বা কেন্দ্রে পৌঁছাতে হবেÑ তার বাধ্য-বাধকতা কতটুকু? বা তাতে কী সহজ কোনো পন্থা বের হতে পারে? তার সার-সংক্ষেপ হলো :
সমাধান : “চার মাজহাব ও জুমহুর আলেমগণের কিতাবাদি অধ্যয়ন করে এ আলেমগণ এমন ফলাফলে উপনীত হয়েছেন যে, মৌলিকভাবে নীতিগত বিবেচনায় অধঃস্তন বা জেলা পর্যায়ের উপকমিটির ‘চাঁদ দেখার ফায়সালা’ কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য তখনই গ্রহণযোগ্য-বাস্তবায়নযোগ্য হতে পারে যখন তা অপর বিচারকের (কমিটির) কাছে শরিয়তসম্মত সাক্ষ্য ও দু’জন সাক্ষীসহই পৌঁছাবে। কেবল টেলিফোন ইত্যাদির মাধ্যমে তার সংবাদ দিয়ে দেয়াই যথেষ্ট হবে না। উম্মতের জুমহুর ফকিহগণেরÑ হানাফি, শাফেঈ, মালেকি ও হাম্বলিদেরÑ মূল মাজহাব তথা গবেষণা তেমনটাই। হেদায়া, কিতাবুল উম্ম (ইমাম শাফেঈ র:) ও মুগনি-ইবনে কুদামা (হাম্বলি) ইত্যাদিতে তেমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে। সে কারণে উত্তম হবে তো তা-ই যে, সরকার শরিয়তের মূল বিধান (গবেষণা) মোতাবেক তেমন কোনো ব্যবস্থাপনা করতে পারেন। (প্রাগুক্ত : পৃ:- ৪০২)
তবে হ্যাঁ, আলেমগণের ওই বৈঠকে এমন প্রশ্নেও চিন্তা-পর্যালোচনা করা হয়েছে যে, সরকার যদি উক্ত প্রক্রিয়া অবলম্বন বা বাস্তবায়ন জটিল বলে মনে করেন, সেক্ষেত্রে কি তার কোনো বিকল্প পন্থা হতে পারে? গভীর চিন্তা-গবেষণার পর তার একটা সমাধান এ মর্মে বের করা হয়েছে :
শেষে সমাধান : “সরকার প্রতিটি বড় বড় শহরে উপকমিটি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেবেন। (বর্তমানে জেলাপর্যায়ে আছে, তা উপজেলাপর্যায় পর্যন্ত করা যেতে পারে; এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও করা যেতে পারে। আর তা ইউনিয়ন পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষা ইত্যাদির যে জনবল আছে তা দ্বারা সহজে বাস্তবায়ন সম্ভব)
তার প্রতিটি কমিটিতে এমন কয়েকজন (২/৩) নির্ভরযোগ্য আলেমকে সদস্য হিসেবে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা চাই যাঁরা শরিয়তের সাক্ষ্য-নীতি বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হবেন। আর প্রতিটি উপকমিটির কাজ শুধু সাক্ষ্য ব্যবস্থাপনাই নয়; বরং এসব কমিটিকে ‘ফায়সালা’ দানের এখতিয়ারও প্রদান করা চাই অর্থাৎ পুরো দেশের বেলায়ই। (মুফতি রশীদ আহমদ র.: প্রসিদ্ধ আহসানুল ফাতাওয়া গ্রন্থকার)
এ উপকমিটি যদি বিধি মোতাবেক সাক্ষ্য গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে কোনো ফায়সালা দিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে তো এই ফায়সালা অবশ্যই শরিয়তের নির্দেশিত সাক্ষ্য-আইন মোতাবেকই হয়ে গেল। এখন শুধু ঘোষণার কাজ বাকি থাকল। আর ঘোষণাকর্মের জন্য তো সাক্ষ্য থাকা জরুরি নয়। বরং উপকমিটির কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিকে সতর্কতার সঙ্গেÑ যাতে অপর কারো কোনো হস্তক্ষেপের সংশয় থাকবে নাÑ উপকমিটির এই ফায়সালা বিষয়ে অবহিত করে দেবেন। কেন্দ্রীয় কমিটি এক্ষেত্রে এটিকে নিজেদের ফায়সালা বলে নয়; বরং উপকমিটির ফায়সালা হিসাবে (অথবা তার সঙ্গে আস্থা ও একমত পোষণ করে, সকলের সর্বসম্মত ফায়সালা বলেও) কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দিতে পারেন। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় কমিটির এই ফায়সালা টেলিফোনে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতেও হতে পারে।” (প্রাগুক্ত : পৃ- ৪০২-৩)
ভিডিও/ভিডিও-কল, ইমু ইত্যাদি : মজার ব্যাপার হলো, পরবর্তীতে যখন ভিডিও, ভিডিও কল বা ইমু কল-এর মাধ্যমে উক্তরূপ বিবাহ-শাদি ও লেনদেন ইত্যাদিতে কেবল ফোনই নয়, শুধু গলার শব্দ শুনে পরিচিতি বা নিশ্চিতই নয়; বরং কথা শোনার পাশাপাশি একে অন্যকে দূর থেকে স্বচক্ষে দেখেও চিনতে পারছেন এবং নিশ্চিত হতে পারছেন; সেক্ষেত্রে তো আর সংশয়, সতর্কতা ও প্রতারিত হওয়ার যুক্তি ও কারণ থাকছে না। সুতরাং জেলা কমিটি বা উপকমিটির সংবাদ, সাক্ষ্যও উক্ত সব আধুনিক ও ডিজিটাল পদ্ধতি অবলম্বনে পৌঁছানো বা সংগ্রহ করা যেতে পারে।
বর্তমানে আমাদের দেশে কি রাষ্ট্রীয়ভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান প্রমুখগণ বিভিন্ন সভা-সমিতি করছেন না? রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা বা আদেশ-নিষেধ প্রদান করা হচ্ছে না? তাতে কী এমন সন্দেহ করা যায় যে, পিএম-এর আকৃতিতে অন্য কাউকে দেখানো হচ্ছে? অথবা গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের স্থলে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসককে দেখিয়ে কেউ প্রতারণা করছে! সুতরাং চাঁদ দেখার সংবাদ বা সাক্ষ্যের ক্ষেত্রেও, শরিয়তের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সামনে রেখে আমরা এসব পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারি।
বিশেষভাবে বিবেচ্য : একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা যেতে পারে, ৬৪টি জেলায় ৬৪টি কমিটি? সুতরাং ঢাকা জেলায়ও একটি কমিটি? সেক্ষেত্রে উদাহরণ, ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বায়তুল মোকাররমের কমিটি আকাশ মেঘাচ্ছন্নের কারণে চাঁদ দেখতে পেলেন না। তাই বলে কি উত্তরায় মেঘের ফাঁকে কারও চাঁদ দেখা অসম্ভব? মুহাম্মদপুরে বা ডেমরায় কারো পক্ষে চাঁদ দেখা অসম্ভব? সাভার বা ধামরাইয়ে কোনো ইমাম-মুয়াজজেন চাঁদ দেখলে কি তা মিথ্যা হবে? মোটেও অসত্য হবে না। সুতরাং তেমন কাউকে ‘ফিতনা’ বলতে যাওয়া , কটাক্ষ করা বা সন্দেহের চোখে দেখা সঠিক হবে না। বরং সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে এবং প্রয়োজনে আমাদের ৬৪ জেলা কমিটিকে ৪৬০টি কমিটিতে বা আরো অধিক সংখ্যায় উন্নীত করতে হবে। আর ইতঃপূর্বে বলা হয়েছে যে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষে তেমনটি বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়।
লেখক : মুফতি, ইফা


আরো সংবাদ



premium cement