২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সহিষ্ণুতা ও ইসলাম

-

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এমন বিষয়, বর্তমান সময়ে যার গুরুত্ব অপরিসীম। পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, মানবিক সহমর্মিতা ও ইসলামী শিক্ষার আলোকে উন্নত নৈতিকতা ও ধর্মীয় মর্যাদার বিস্তার ঘটানো বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা।
আজকের পৃথিবী উন্নতি-অগ্রগতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগৎ। মানুষ দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে উন্নতি সাধন করছে। অপর দিকে আরো দ্রুতগতিতে মানুষ শঙ্কা ও ভয়, ুধা ও দারিদ্র্য, অত্যাচার, নিপীড়ন ও ত্রাসের জাহান্নামি গর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। যদি বলা হয়, আজকের উন্নত দুনিয়ার নিরাপত্তার ওপর নিরাপত্তাহীনতা ও সর্বপ্রকার পক্ষপাতিত্বের হামলা এমন একটা প্রশ্ন, যা মানবতার সাথে উপহাস করে চলছে, তাহলে অনর্থক হবে না।
মানব সমাজে অশ্লীলতা ও নিরাপত্তাহীনতার বীজ নিজে নিজেই উৎপন্ন হয়নি, বরং তা কিছু মানুষের ভুলের কারণে অস্তিত্ব লাভ করেছে। তারপর দুর্বৃত্তদের অপকর্ম ও ক্রমাগত বিশৃঙ্খলার ফলে তা বৃদ্ধি পেয়ে পূর্ণ গাছে পরিণত হয়েছে। যার শিকড় মানবসমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। স্রষ্টাপ্রদত্ত কানুন ও প্রকৃতির নীতি হলোÑ ‘যেমন বীজ বুনবে, তেমন ফল কাটবে।’
তবে এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশ্বমানবের স্বস্তি ও শান্তি লাভ হয়েছে সে ক্ষেত্রে, যখন মানুষ খোদার নির্দেশিত রাস্তায় চলেছে। এটা এমন কোনো দর্শন বা যুক্তি নয়, যা বোঝা যায় না। বরং পরীক্ষা ও চাক্ষুষ দর্শন এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আসমানি হেদায়েত ও আল্লাহপ্রদত্ত শিক্ষা ছাড়া আর এমন কিছু নেই, যা মানুষকে সঠিক গন্তব্যের পথ দেখাবে। আল্লাহপ্রদত্ত শিক্ষায় অবিচল থাকাতেই মানবতার শান্তি ও নিরাপত্তা আসবে, নতুবা নয়। এ জন্য আজকের উন্নত যুগেও বিশ্বমানবতার শান্তি ও নিরাপত্তার সৌধধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে ওই চিরন্তন, প্রত্যাদিষ্ট, সার্বজনীন অধিকার, কর্তব্য এবং দাওয়াত ও দাবির ভিত্তির ওপর নির্মাণের মাঝে নিহিত, যা আল্লাহপ্রদত্ত প্রধান প্রধান ধর্ম প্রচার করেছে।
আলহামদু লিল্লাহ! আমরা সবাই মুসলমান। এক আল্লাহ, এক নবী এবং এক কিতাবের অনুসারী। হজরত আদম আ: থেকে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত সব নবী ও সমস্ত আসমানি কিতাবের প্রতি আমরা ঈমান রাখি। আল্লাহর তাওহিদ, কুরআন পাক এবং নবী করিম সা:-এর প্রতি ঈমান রাখা আমাদের আকিদার মূল দাবি।
ইসলামে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতি বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সূরা ইউনুসে বলেনÑ আপনার প্রভু যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে পৃথিবীর সব মানুষ অবশ্যই ঈমান আনত। তবে কি আপনি মানুষদের চাপ প্রয়োগ করবেন যে, তারা মুমিন হয়ে যাক? (আয়াত : ৯৯)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ওলামায়ে কেরাম অনেক সুন্দর মতামত পেশ করেছেন। কাউকে চাপ দিয়ে নিজের আকিদা-বিশ্বাস তার ওপর চাপিয়ে দেয়া ইসলামে অপছন্দনীয় ও নিষিদ্ধ। কুরআনের শিক্ষা ও রাসূল সা:-এর জীবনী মূলত ও কার্যত সাব্যস্ত করেছে, কারো ওপর কোনো দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্ম গ্রহণ করা না করার ব্যাপারে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা সব নবীকে মানুষের কাছে শুধু আল্লাহর বাণী ও পয়গাম পৌঁছানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদেরকে আকিদা ও ঈমান গ্রহণের ব্যাপারে বল ও চাপ প্রয়োগের অবকাশ দেননি। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে ইসলাম প্রচারক ও আলেমগণের জন্য দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ম ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়েছেন। যদি ইসলামী বিশ্ব কুরআন পাকের সহিষ্ণুতার পয়গাম এবং নবী করিম সা:-এর পুণ্যময় জীবনাদর্শের আলোকে নুরানি পথে সঠিকভাবে চলত, তাহলে আমরা অবশ্যই অন্যান্য জাতিকে চিন্তা, দর্শন, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ময়দানে নেতৃত্ব ও পরিচালনার দায়িত্ব আনজাম দিতে পারতাম।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বদৌলতেই পাক ভারত উপমহাদেশে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। এ ূভূখণ্ডে ইসলাম তরবারির জোরে আসেনি, বরং সুফিয়ায়ে কেরাম এবং আউলিয়া কেরামের সহিষ্ণুতার ওপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা এবং সাধারণ মানুষের সাথে সম্প্রীতি ও সহানুভূতিমূলক আচরণের বদৌলতে বিস্তার ঘটেছে। উপমহাদেশে ইসলাম আগমনের সময় এখানে ধর্মীয় বিবাদের সরগরম পরিবেশ ছিল। হিন্দুত্ববাদ অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের মাঝে চূড়ান্ত লড়াই চলছিল। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা এমন চরমপর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তারা অকাতরে মানুষ খুন করত। এ অবস্থায় ইসলামের সহিষ্ণুতার ওপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা এবং মুসলিম সুফিয়ায়ে কেরামের আবেগপূর্ণ সহানুভূতির বাণী ইসলাম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। এটা বাস্তব যে, দুনিয়ার যেখানেই ইসলাম প্রসার লাভ করেছে, স্বীয় সহিষ্ণুতা এবং মানবিক সুউচ্চ গুণাবলির ফলেই লাভ করেছে।
আজ প্রয়োজন ইসলামের উৎস কুরআন মজিদ ও রাসূল সা:-এর সুন্নতের আলোকরশ্মি অর্জন করে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক সংহতি ও ঐক্যের পয়গাম ব্যাপক করার সম্ভাব্য সব চেষ্টা করা।
আমাদের ইসলামের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ওপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা বিস্তার করার প্রতি একান্ত মনোযোগী হতে হবে। কেননা, এটা এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। সাথে সাথে সব বড় বড় ধর্মের বিজ্ঞ পণ্ডিত এবং বিশেষজ্ঞগণকে আজকের বস্তুবাদী দুনিয়ার প্রবণতা রোধ করার জন্য সামাজিকপর্যায়ে এমন একটা সংস্থা গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগী হতে হবে, যার মাধ্যমে বাস্তবিক অর্থে বর্তমান দুনিয়ার জন্য সাম্য, ন্যায় ও নিষ্ঠা, অর্থনৈতিক সুব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা ও শান্তির নিয়ামত অর্জন হতে পারে। বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার সমাপ্তি ঘটবে, ব্যক্তিগত শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বস্তি এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা অর্জিত হবে। এমনিভাবে জনগণের মাঝে আন্তরিক ও বুদ্ধিভিত্তিক চেতনার সঞ্চারণ হবে। মানব মর্যাদার সেøাগান উঠবে।
দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ এই সময়ে পৃথিবী থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা ছিনিয়ে নিয়েছে। আরো বড় পরিহাস এই যে, ইসলামকে ত্রাস সৃষ্টিকারী ও ধর্মান্ধতা বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। পৃথিবীর যেখানেই কোনো দুর্ঘটনা বা নাশকতা ঘটে, সেখানেই সেটিকে ইসলাম ও মুসলিমদের ওপর চাপানো হয়। অথচ বাস্তবতা এই যে, প্রকৃত অর্থে ইসলাম বিশ্ব নিরাপত্তার ব্যাপারে ‘সর্বাত্মক’ সজাগ দৃষ্টি রাখে। অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে আচরণই এ ব্যাপারে বাস্তব সাক্ষী ও প্রমাণিত সত্য। নবী করিম সা:-এর শেষ খুতবা বিশ্বমানবতার মর্যাদার সার্বজনীন ঘোষণা, মদিনা মুনাওয়ারায় সম্পাদিত চুক্তি মদিনার সনদ এবং নাজরানের খ্রিষ্টানদের সাথে কৃত চুক্তিই বাস্তব প্রমাণ যে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানবতার কল্যাণের জন্য পরস্পর মিলে মিশে কাজ করা উচিত। যদি সবাই সম্মিলিতভাবে কল্যাণের পথে চলে, তাহলে হিত-মঙ্গল ও সুখ-সমৃদ্ধি অর্জন হওয়া নিশ্চিত। এতেই মানবতা উন্নত হবে। সব ধর্মের দাবি ও আবেদন যেহেতু কল্যাণ ও মঙ্গলের বিস্তার ঘটানো, সুতরাং সে ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকা অনুচিত, যা শান্তি, নিরাপত্তা, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতি এবং কল্যাণ ও সফলতার পরিপন্থী হয়।
সম্প্রীতি ও সহানুভূতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারে ইসলামী শিক্ষা অর্জন করা এবং তা প্রচার করা সময়ের একান্ত দাবি। যে জাতি সময়ের চাহিদার প্রতি মনোযোগ দেয় না, তাদের গলায় দাসত্বের শিকল পেঁচিয়ে যায় এবং এই শিকল তাদের গোলামি জীবন যাপন করতে বাধ্য করে। আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে ওই শিকল নিজেদের গলা থেকে খোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। মুসলিম জাতির কল্যাণের জন্য রাসূল সা: ফরমান ‘ইসলামই উৎকৃষ্ট, তার চেয়ে উৎকৃষ্ট (আর কোনো ধর্ম, দ্বীন, দর্শন) নেই’Ñ এর ফল প্রকাশ করতে হবে।
এটি জ্ঞান ও বিবেকের দাবি। আমাদের সর্বপ্রকার মতানৈক্য ভুলে গিয়ে মুসলিম জাতির শান্তি, প্রগতি ও নিরাপত্তার প্রতি একান্ত মনোযোগ দিতে হবে। এমন একটি মুসলিম সমাজ গড়তে হবে, যা ইসলামের আলো এবং সহিষ্ণুতাপূর্ণ শিক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে, যা সহিষ্ণুতাকামী হবে, যা মুসলমানদের সরল পথ প্রদর্শন করবে এবং যা বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার নেতৃত্ব দেবে। যার অনুসারীদের মাঝে অতি পছন্দনীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমাবেশ ঘটবে। যেখানে আতঙ্ক ও সন্ত্রাস সৃষ্টি হবে না। যেখানে হঠকারিতা, বৈপরীত্য ও অহমিকা থাকবে না। যেখানে বাস্তবতাকে তার সঠিক দৃষ্টিতে বুঝে ব্যক্তিগত কার্যতালিকা প্রস্তুতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হবে।
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement
জুলাইয়ে ব্রাজিল সফরে যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিলো ভানুয়াতু বিতর্কিত ক্যাচের ছবির ক্যাপশনে মুশফিক লিখেছেন ‘মাশা আল্লাহ’ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ৭৩ জনকে বহিষ্কার করলো বিএনপি মিরসরাইয়ে অবৈধ সেগুনকাঠসহ কাভার্ডভ্যান জব্দ মানিকগঞ্জে আগুনে পুড়ে যাওয়া মলিরানীর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বরেকর্ড ইন্দোনেশিয়ার নারী ক্রিকেটার রোহমালিয়ার ‘এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব’ যদি বন্ধু হও, সীমান্তে অহরহ গুলি কেন : ভারতকে ফারুক সাহারা মরুভূমির গরমের মতো অনুভূত হচ্ছে : সরকারকে দায়ী করে রিজভী মধুখালীর পঞ্চপল্লীতে ২ ভাইকে হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ

সকল