ওজন বেড়ে যাওয়া ও মাসিকের সমস্যা
- ডা: শাহীন আরা আনওয়ারী
- ০৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:০৩
সীমা অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বয়স ২২। আট মাস ধরে মাসিকের প্রচণ্ড অনিয়ম হচ্ছে। প্রায় দুই-আড়াই মাস মাসিক বন্ধ থাকে। পরে মাসিক হয়। প্রথম দিন পরিমাণে খুবই কম। দু-চার ফোঁটা। দ্বিতীয় দিনে একটু থাকে। তিন দিনের মাথায় শেষ। মাঝে মধ্যে তলপেটে ব্যথা থাকে, কিন্তু সেটি ওষুধ না খেলেও ভালো হয়ে যায়। লিখেছেন ডা: শাহীন আরা আনওয়ারী
ইদানীং মাসিকের সমস্যার সাথে আরো কিছু সমস্যা সীমাকে যারপরনাই চিন্তিত করে তুলেছে। ওজন বাড়ছে হু হু করে জোয়ারের পানির মতো, অথচ সীমা খাবার যে খুব বেশি খায় তেমনও নয়। মাঝে মধ্যে বান্ধবীদের সাথে একটু বাইরে ফাস্টফুড খায়। কোল্ডড্রিংকস খাওয়া হয় নিয়মিত। সীমা চাইলেও এড়াতে পারে না। তবে এই তরল পানীয়টি কিন্তু ওজন বাড়তে খুব সাহায্য করে। তলপেটে দাগ পড়ে যাচ্ছে বাড়তি ওজনের জন্য। গলা ও ঘাড়ের কাছের চামড়া মোটা হয়ে গেছে; কিছুটা কালচে ভাব। দেখতে ভালো লাগে না। সীমা যারপরনাই বিব্রত মুখে নতুন করে লোম গজানো নিয়ে; ওপরের ঠোঁট, নিচের ঠোঁট ও চিবুকে অবাঞ্ছিত লোম গজাচ্ছে। সীমার কান্না পায়।
তার ওপর আছে দুই গাল ও কপালে ব্রণের উপদ্রব। কিভাবে চোখের সামনে সীমার উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারাটি অন্য রকম হয়ে গেল। ব্রণের জন্য কত কী ক্রিম ব্যবহার করল, কিন্তু তেমন কাজ হলো না। তার ওজন প্রায় ১০ কেজি বেড়েছে। একটু হাঁটাহাঁটি কিংবা কাজকর্ম করলেই বুক ধড়ফড় করে। ক্লান্তিও আছে সাথে, নিঃশ্বাস ঘনঘন পড়ে। সীমার আগের জামাগুলো এখন পরতেই পারে না। ওজন বাড়ার সাথে সাথে নাভির নিচেও লোম গজিয়েছে, সেটি আগে ছিল না। ইদানীং বুকে ও পিঠেও ব্রণ বের হয়েছে। বান্ধবীরা পরামর্শ দিলো ডাক্তারের কাছে যেতে। ডাক্তার নিয়মিত মাসিক হওয়ার জন্য ওষুধ দিলেন। কারণ, তিন মাস ধরে মাসিক বন্ধ।
সোজা কথায় ডাক্তার যা বললেন, তার মানে হলো ওজন কমানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু ওজন কমানো কি মুখের কথা! সকালে ক্লাস, দুপুরে প্রাকটিক্যাল সেরে বাসায় আসতেই প্রায় সন্ধ্যা। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে সীমা কখনো সন্ধ্যার পরে বাসায় ঢোকে। সপ্তাহে দুই দিন আবার টিউশনি করে নিজের হাতখরচ চালানোর জন্য। হাঁটাহাঁটির সময় পাবে কই? সীমা যে এলাকায় থাকে, সেখানে খোলা মাঠ তো দূরের কথা, রাস্তায় মানুষ গিজ গিজ করে। হাঁটবে কোথায়? বাসায় বসে ব্যায়াম করতে বলেছে ডাক্তার, কিন্তু নানান কাজের চাপে- পড়াশোনা, হোমটাস্ক, এসাইনমেন্ট এসবের চাপে তেমন হয়ে ওঠে না। আর ক্লান্তি ভাব ইদানীং বেশি বেড়েছে যে, শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে মনে প্ল্যান করলেও সীমার ব্যায়াম করা হয়ে ওঠে না। ডাক্তার বলেছেন, হেঁটে কলেজে যাবেন, কিন্তু এত সময় কই? বাসে যেতে মাত্র ১০-১৫ মিনিটের রাস্তা। রাস্তায় জ্যাম থাকে আর বইপত্রসহ ভারী ব্যাগ নিয়ে ফুটপাথের ভিড় ঠেলে সীমার হাঁটতেও ইচ্ছে করে না। সীমার সব কাজেই বিরক্ত লাগে। মাসিক বন্ধ হলে কি মানসিক সমস্যাও বাড়ে? ইদানীং কাজকর্মেও তেমন উৎসাহ পায় না।
বান্ধবীরা মোটা হয়ে যাওয়াতে মাঝে মধ্যে টিপ্পনি কাটে। মা আড়চোখে তাকান। বাধ্য হয়ে রাতের খাবার ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু তাতেও ওজন কমছে না। মাঝে মধ্যে মাথা ঘোরে। ইদানীং ক্লাসের পড়াও মাথায় ঢুকছে না। পড়া শুনতে শুনতে কেমন জানি ঘুম ঘুম লাগে। পড়াশোনার প্রতি জোর করে মন বসাতে চাইলেও পড়া তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয় না। বুদ্ধিশুদ্ধি কি কমে যাচ্ছে? না, এভাবে আর চলতে পারে না। সীমা মনস্থির করে, বড় ডাক্তারের কাছে যাবে। ডাক্তার সব শোনার পর তলপেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা দিলেন, রক্তে হরমোনের কয়েকটি পরীক্ষা দিলেন। মাসিকের দ্বিতীয় দিনের রক্তে দুটো হরমোনের পরীক্ষা দিলেন। খালিপেটে রক্তের দুটো পরীক্ষা করালেন। সবশেষে ধরা পড়ল সীমার শরীরে যে অসুখটি বাসা বেঁধেছে তার নাম ‘পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ’।
এককথায় বলে ‘পিসিও’। ডাক্তার অভয় দিলেন। আশ্বস্ত করলেন। বললেন, শুধু ওষুধে এ রোগ ভালো হয় না। ওজন কমানোর কিছু সহজ পদ্ধতি শিখিয়ে দিলেন। না খেয়ে থাকার কোনো দরকার নেই। ডাক্তার অত্যন্ত সহজভাবে একটি খাবার তালিকাও করে দিলেন। সীমার চোখে আনন্দের হাসি। ডাক্তার যে পরামর্শ দিলেন, সেগুলো একটু চেষ্টা করলেই মেনে চলা যায়। কোল্ডড্রিংকস না খেলে কী এমন আসে যায়!
মন সতেজ রাখতে বললেন। ঘরে বসেই কিছু সহজ ব্যায়ামের পদ্ধতি শিখিয়ে দিলেন। ডাক্তারের ভালো আচরণ রোগীদের অনেক উপকারে আসে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সীমার পরের মাসে নিজে নিজেই মাসিক হয়ে গেল। মুখের ব্রণ আগের চেয়ে কমতে শুরু করেছে। মুখের বাড়তি লোম সারতে কিছুটা সময় নেবে- বলেছেন ডাক্তার। তবে এখন যতটুকু লোম আছে, এটি পার্লারে গিয়ে তুলে ফেলার উপদেশ দিলেন। কত সহজেই এত দিনের ক্লান্তিময় পরিবেশ থেকে মুক্তি পেল সীমা।
সীমার মনে হলো জীবনে আনন্দ নিয়েই বাঁচতে হবে। মোটা হয়েছে তাতে কী? এখন থেকে পজিটিভ দৃষ্টিতে সে জীবনের কাজগুলো করবে, রক্তে হরমোনের একটু সমস্যা ধরা পড়লেও ডাক্তার আশ্বস্ত করলেন, লাইফস্টাইল পরিবর্তন করলে এই রোগ কন্ট্রোলে থাকবে। আর যদি নিয়মকানুন না মেনে চলে, তবে অল্প বয়সেই হার্টের অসুখ, রক্তে চর্বির মাত্রা বেড়ে যাওয়া, অল্প বয়সেই ডায়াবেটিস হওয়ার কথাও শোনালেন। তবে সীমা ঘাবড়াল না। দেখা গেল মাস দুয়েকের মধ্যে সীমার বাড়তি ওজন কমে গেল। খুব যে বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে তা-ও নয়। এখন সীমার মাসিকও নিয়মিত হয়। অথচ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল ওষুধ খাওয়া ছাড়া সীমার মাসিকই হতো না। মানসিকভাবেও সীমা এখন স্বাভাবিক।
সীমার মতো অনেক কুমারী, যুবতী মেয়ে আছেন যাদের অনিয়মিত ও অল্প মাসিক হয়। আবার ওষুধ না খেলে মাসিকও হয় না। একবার মাসিক হলে ১০-১৫ দিনের আগে ভালো হতে চায় না। অনেক সময় চাকা চাকা রক্ত পড়ে। আবার এমনও কেউ আছেন, যাদের মাসিক ভালো হওয়ার ১০-১৫ দিন পরে আবার মাসিক দেখা যায়। এসবই কমন সমস্যা। শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ ইয়াং মেয়ে এই সমস্যায় ভোগেন। তার সাথে ওজন বাড়ার সমস্যা তো আছেই। রক্তে কিছু হরমোন আছে, যার তারতম্য ঘটলেই এ অসুখ হয়। তবে এটাকে অসুখ না বলে লাইফস্টাইল ডিজিজ বলাই ভালো। কারণ, ব্যবস্থা নিলে এটি নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ ধরনের সমস্যায় ভুগলে আপনি অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাবেন।
লেখিকা : স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক, শান্তিনগর শাখা, ইউনিট-২। ফোন: ০১৭১৮২৭১৭১৯
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা