১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


ব্যান্ড-গিটারের কিংবদন্তির বিদায়

-

চলে গেলেন ব্যান্ড ও গিটারের কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু। রুপালি গিটার ফেলে গতকাল সকালে চিরবিদায় নেন এই রকস্টার। তার স্বজনেরা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে নিজ বাসায় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
আইয়ুব বাচ্চুর বাসা ও স্টুডিও দুটোই মগবাজারে। স্টুডিওর নাম এবি কিচেন। তিনি স্ত্রী ফেরদৌস চন্দনা এবং দুই সন্তান রেখে গেছেন। ছেলে ফাইরুজ ও মেয়ে তাজওয়ার। তাদের একজন কানাডা ও অপরজন অস্ট্রেলিয়ায় পড়ছেন। দুই ছেলেমেয়ে দেশে ফিরলে আগামীকাল শনিবার চট্টগ্রামে নেয়া হবে জনপ্রিয় এই ব্যান্ড শিল্পীর লাশ। সেখানে আরেক দফা নামাজে জানাজার পর মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা শোক প্রকাশ করেছেন।
আইয়ুব বাচ্চুকে বলা হতো বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত এগিয়ে নেয়ার অন্যতম অগ্রপথিক। ভারতীয় উপমহাদেশে গিটার বাদনে তার খ্যাতি ছিল ঈর্ষণীয়। কনসার্টে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি যেকোনো কনসার্টের সমাপ্তি টানতেন বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত দিয়ে, যা তার দেশপ্রেমের পরিচায়ক।
এলআরবির সদস্য শামিম সাংবাদিকদের জানান, আইয়ুব বাচ্চু কিছু দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। হৃদরোগের কারণে সপ্তাহ দুই আগেও একবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। স্বজনেরা জানান, সকালে নিজ বাসায় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে সোয়া ৯টায় তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যান্ড এলআরবির দলনেতা আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গায়ক, গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। গিটারের জাদুকর হিসেবে আলাদা সুনাম ছিল তার। ভক্তদের কাছে তিনি ‘এবি’ নামেও পরিচিত।
স্বজনেরা জানান, এর আগে ২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর ফুসফুসে পানি জমে যাওয়ার কারণে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। তবে সুস্থ হয়ে আবার সঙ্গীত জগতে ফিরলেও হৃদরোগের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে হার্টে রিং পরাতে হয়েছে তার। সর্বশেষ ১৬ অক্টোবর রংপুর জিলা স্কুলের মাঠে ‘শেকড়ের সন্ধানে’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে কনসার্টে অংশ নেন তিনি। ঢাকায় ফিরে আসার পর ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন আইয়ুব বাচ্চু।
স্কয়ার হাসপাতালের পরিচালক ডা: মির্জা নাজিমুদ্দিন জানান, আইয়ুব বাচ্চু দীর্ঘ দিন ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন। তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ৮টায় বাসাতেই হার্ট অ্যাটাক হয় আইয়ুব বাচ্চুর। ৯টা ৫৫ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।
ডা: মির্জা আরো বলেন, আইয়ুব বাচ্চু বহুদিন থেকে হৃদরোগে ভুগছিলেন। এই রোগের নাম কার্ডিওমাইওপ্যাথি।
ব্যান্ড দল এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং প্লেব্যাক শিল্পী। চার দশক বাংলাদেশের তরুণদের গিটারের মূর্ছনায় মাতিয়ে রাখা এই শিল্পির মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। ভক্ত শ্রোতাদের পাশাপাশি সঙ্গীত জগতের অনেকেই ছুটে আসেন হাসপাতালে।
নব্বইয়ের দশক থেকে ব্যান্ড সঙ্গীতের চর্চা শুরু করেন আইয়ুব বাচ্চু। আইয়ুব বাচ্চু বেশির ভাগ সময়ই নিজের সুর ও স্বরচিত সঙ্গীতে গান করেছেন।
শ্রদ্ধা ও জানাজা শেষে কাল দাফন
মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আইয়ুব বাচ্চুর নামাজে জানাজা আজ শুক্রবার বাদ জুমা জাতীয় ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে সর্বসাধারণের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত লাশ রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধা শেষে লাশ নেয়া হবে জাতীয় ঈদগাহে। সেখানে নামাজে জানাজা শেষে তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর লাশ নেয়া হবে চট্টগ্রামের পৈতৃক নিবাসে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। তিনি ভক্তদের কাছে এবি নামে পরিচিত। তার পারিবারিক ডাকনাম রবিন।
১৯৭৮ সালে ফিলিংস ব্যান্ডের মাধ্যমে সঙ্গীত জগতে তার পথচলা শুরু হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সোলস ব্যান্ডে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে এলআরবি ব্যান্ড গঠন করেন আইয়ুব বাচ্চু। এর প্রথম অ্যালবাম ‘এলআরবি’ বাজারে আসে ১৯৯২ সালে। এটাই দেশের প্রথম ডাবল অ্যালবাম। এলআরবির অন্য অ্যালবামগুলো হলো ‘সুখ’ (১৯৯৩), ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে ’(১৯৯৫),‘ফেরারি মন’ ও ‘স্বপ্ন’ (১৯৯৬), ‘আমাদের’ (১৯৯৮), ‘বিস্ময়’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০১), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নাই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮), ‘যুদ্ধ’ (২০১২) এবং সর্বশেষ ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ (২০১৬)।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘রক্তগোলাপ’ হলো তার প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। তার সাফল্যের শুরুটা হয় দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়ন্থনা’র (১৯৮৮) মাধ্যমে। ১৯৯৫ সালে বাজারে আসে তার তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এর প্রায় সব গানই জনপ্র্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘কষ্ট কাকে বলে’,‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ‘আমিও মানুষ’ গানগুলো। তার অন্য একক অ্যালবামগুলো হলো ‘সময়’ (১৯৯৮), ‘একা’ (১৯৯৯), ‘প্রেম তুমি কি’ (২০০২), ‘দুটি মন’ (২০০২), ‘কাফেলা’ (২০০২), ‘রিমঝিম বৃষ্টি’ (২০০৮), ‘বলিনি কখনো’ (২০০৯) ও ‘জীবনের গল্প’ (২০১৫)।
সেরা দশ গান
১. চলো বদলে যাই, ২. এই রুপালি গিটার, ৩. ফেরারি মন, ৪. হাসতে দেখো, ৫. বাংলাদেশ, ৬. এখন অনেক রাত, ৭. কষ্ট পেতে ভালোবাসি, ৮. আসলে কেউ সুখী নয়, ৯. একদিন ঘুম ভাঙা শহরে, ১০. উড়াল দেব আকাশে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
আইযুব বাচ্চুর মৃত্যুতে পৃথক বার্তায় শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি আইযুব বাচ্চুর রূহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার রূহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
বিএনপির শোক
বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এক শোকবার্তায় তারা বলেন, দেশের সঙ্গীত জগতে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তার গান তাকে গণমানুষের নিকটজন করে তুলেছিল। তার মৃত্যুতে দেশ হারালো অসাধারণ এক গুণী শিল্পীকে যার অভাব সহজে পূরণ হওয়ার নয়। মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করে শোকাহত পরিবারের সদস্য, গুণগ্রাহী, অসংখ্য ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানায় বিএনপি।
এ ছাড়া বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস), সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরসহ অনেকে শোক প্রকাশ করেছেন।
চসিক মেয়রের শোক
জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। জনপ্রিয় এই সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব চট্টগ্রামের সন্তান। এই বন্দরনগরীতেই তার বেড়ে ওঠা।
চসিক মেয়র বলেন, আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে যে শূন্যতা হয়েছে তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। মেয়র নাছির মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।


আরো সংবাদ



premium cement