১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও সুশাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন আইএমএফ

-

সরকারি ব্যাংকের সুশাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলেছে, সরকারি ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। তা না হলে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কেন বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ হ্রাসের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না। এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নজর দেয়া। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরকারি কর্মকর্তাদের অনুপাত বাড়ানো এবং সৎ ও দক্ষ লোকদের নিয়োগ দেয়ারও পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
গতকাল সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে আইএমএফ প্রতিনিধিদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম এবং আইএমএফের পক্ষ থেকে সংস্থাটির আর্টিকেল ফোর স্টাফ মিশন কর্মকর্তা ডাইসাকু কিহারা নেতৃত্ব দেন।
সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে একজন অতিরিক্ত সচিব সরকারি ব্যাংকের সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো গত বছর এবং চলতি বছরের প্রথমার্ধে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। নরমাল ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কম রেটে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলোকে ঋণ দেয়া এবং চার্জ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক খাতে অংশগ্রহণের মতো কাজও করছে।
গত বছর চারটি সরকারি ব্যাংক মূলধন পর্যাপ্ত পর্যায়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ঝুঁকিভারিত সম্পদের বিপরীতে মূলধন হার (সিআরএআর) সোনালী ব্যাংক ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ রেখেছে। এ ছাড়া জনতা ব্যাংক ১০ দশমিক ০৬ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংক ১২ দশমিক ০৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে রূপালী এবং বেসিক ব্যাংক পর্যাপ্ত পরিমাণ সিআরএআর রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংক দু’টির সিআরএআর হলো যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং (-) ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ।
সরকারি খেলাপি ঋণের চিত্র তুলে ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে আইএমএফকে বলা হয়, চলতি বছরের জুনের শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণের ৩৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এ ছাড়া জনতায় ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ, অগ্রণীতে ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ, রূপালী ২২ দশমিক ৬৪ শতাংশ, বেসিক ব্যাংকের ৫৭ দশমিক দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যার অনুপাত ৫৫ দশমিক ১৭ শতাংশ।
বৈঠকে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়, সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ল কেন। সরকার বা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কি এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করেনি। ব্যাংকিং খাতে কি সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। এ সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা করা হয়, খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কাঠামোগত কিছু সমস্যা থাকার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। ইতোমধ্যে খেলাপি ঋণ কমানোর নতুন করে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আশা করা যায়, এর সুফল আগামী কয়েক মাসে পাওয়া যাবে।
আইএমএফের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরকারি কর্মকর্তাদের অনুপাত কেমন। এটি বাড়ানোর কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি না। আর্থিক বিভাগের কর্মকর্তারা এ সময় বলেন, যোগ্য লোকদেরই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। এখানে যেমন বর্তমানে চাকরিরত সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন, তেমনি অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তারাও বিভিন্ন ব্যাংকের বোর্ডে সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তাই পরিচালনা পর্ষদে সরকারি কর্মকর্তাদের অনুপাত বাড়ানোর সম্ভাবনা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, আইএমএফের সাথে আলোচনার বেশির ভাগ জুড়েই ছিল ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। আইএমএফ প্রতিনিধিরা বারে বারে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। তারা এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে মনে হয়েছে। তারা পরিচালনা পর্ষদ নিয়েও চিন্তিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকায়। জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ যুক্ত হয়েছে খেলাপি হিসেবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ১ লাখ ৫১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪২ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা, যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ।

 


আরো সংবাদ



premium cement