১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


ইসির খামখেয়ালিতে হুমকির মুখে যে সব প্রার্থী

-

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) উদাসীনতা ও খামখেয়ালিতে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ ছাড়লেও পদত্যাগ গৃহীত না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না বেশ কয়েকজন প্রার্থী। ইসির স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় পদত্যাগ নিয়েও দ্বিধায় ছিলেন এসব প্রার্থী। তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিয়ে ইসি পরিপত্র জারি করলেও সেখানে সুবিধাভোগীদের পদত্যাগের বিষয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না। ফলে উচ্চ আদালতের আদেশে তাদের প্রার্থিতা বাতিল কিংবা স্থগিত হয়ে গেছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের লড়াই থেকে ছিটকে পড়তে পারেন এসব প্রার্থী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত মিঠাপুকুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন অধ্যাপক গোলাম রব্বানী। নির্বাচিত হওয়ার প্রায় চার বছর পার হলেও চেয়ারে বসতে পারেননি তিনি। এই সময়ের মধ্যে কোনো বেতন-ভাতাও নেননি। অসংখ্য মামলার আসামি হওয়ায় পুরো সময়টা পলাতক কিংবা জেলে ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে শপথ নিলেও পরিষদের প্রথম সভা করতে পারেননি। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে পদ ফিরে পান। এরপর বেশ কয়েক দফা চেষ্টা করেও প্রথম সভা করতে পারেননি তিনি।

ইতোমধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল হলে ২৭ নভেম্বর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি। অনেক লড়াইয়ের পর ইসির বৈধ প্রার্থীর তালিকায় নাম লেখালেও শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রার্থিতা স্থগিত হয়ে যায় বিএনপি মনোনীত রংপুর-৫ আসনের ধানের শীষের এই প্রার্থীর। তার আইনজীবীরা বলছেন, প্রথম সভা করতে না পারায় গোলাম রব্বানী উপজেলা চেয়ারম্যানের পদের কার্যভার গ্রহণ করেননি। এ অবস্থায় তার পদত্যাগের প্রয়োজন ছিল না। তারপরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিতে দেরি করেন। আর পদত্যাগ গৃহীত না হওয়ায় তার প্রার্থিতা স্থগিত আছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ বলেন, গোলাম রব্বানীর বিষয়টি আমি জেনেছি। যেহেতু উনি সরকারি সুবিধা গ্রহণ করেননি তিনি। এজন্য তার প্রার্থিতা স্থগিত হওয়া উচিত না। নির্বাচন কমিশন একবার যাদের প্রার্থিতা গ্রহণ করেছে তাদের শেষ মুহূর্তে বাতিল করলে তারা কিভাবে প্রতিকার পাবেন?

গোলাম রব্বানীর মতো পদত্যাগ গৃহীত না হওয়ায় প্রার্থিতা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন জয়পুরহাট-১ আসনে মো: ফজলুর রহমান (জয়পুরহাট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান), রাজশাহী-৬ আসনে মো: আবু সাঈদ চাদ (চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান), ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে মো: মোসলেম উদ্দিন (আখাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান), ঝিনাইদহ-২ আসনে মো: আবদুল মজিদ (হরিণাকুণ্ডু উপজেলা চেয়ারম্যান) এবং জামালপুর-৪ আসনে ফরিদুল কবির তালুকদার (সরিষাবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান) ছাড়াও অনেকে।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ গৃহীত না হওয়ায় রিটার্নিং কর্মকর্তা তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে ইসি তাদের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করে। পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার আগেই প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণার বৈধতা নিয়ে রিট করা হলে হাইকোর্ট ইসির সিদ্ধান্ত তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। ফলে এখন তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

ভুক্তভোগীরা জানান, স্থানীয় সরকারে যারা নির্বাচিত তাদের কি পদত্যাগ করতে হবে? এর মধ্যে মেয়র হলে কী হবে? উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হলে কী হবে? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়নি ইসি। বিষয়টি নিয়ে সবসময় উদাসীন থেকেছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিদের পদত্যাগ করার নির্দেশনা দিতে চেয়েছিল ইসি। ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এ বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হলেও পরে তা অদৃশ্য কারণে থেমে যায়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও সব রিটার্নিং কর্মকর্তাকেও জনপ্রতিনিধিদের পদত্যাগের বিষয়টি জানিয়ে দেয়ার কথা ছিল। ওই সময় নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, আমাদের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে স্বপদে থেকে তারা সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ সংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চ আদালতের কোনো নির্দেশনা আছে কি না তা স্পষ্ট হওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেবো।

কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত হয়ে ছিল, স্থানীয় স্তরের প্রধান পদধারী জনপ্রতিনিধিরা স্বপদে থেকে এমপি পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। কারণ অফিস প্রফিট হিসেবে এসব জনপ্রতিনিধি লাভজনক পদের অধিকারী। ২৮ নভেম্বর ছিল মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। মনোনয়নপত্র দাখিলের চার দিন আগে ইসি এ সিদ্ধান্ত নেয়। তবে অদৃশ্য কারণে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ইসি। ২৭ নভেম্বর সব রিটার্নিং কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক কর্মকর্তাকে চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘সংবিধান ও দণ্ডবিধির ২১ধারাসহ আইনের অন্যান্য ধারা পরীক্ষা করে রিটার্নিং অফিসারগণ সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন।’

ইসি সূত্রে জানা যায়, তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির পক্ষ থেকে একটি পত্র কমিশনকে দিয়ে এ বিষয়ে স্পষ্টকরণের দাবি জানানো হয়। পরে ইসির সাথে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সাথে সভায় তারাও এ বিষয়ে কমিশনের কাছ থেকে নির্দেশনা চান। কমিশনের ৪০তম সভায় উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের বিষয়ে কমিশন প্রাথমিক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় এ পদটি লাভজনক বিধায় সিটি মেয়রদের মতো উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরমেয়র ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা স্বপদে থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু পরে ইসির পরিপত্রে বিষয়টি অস্পষ্টই থেকে যায়। আর এমন সময় রিটার্নিং অফিসারদের কাছে নির্দেশনা যায় যখন পদত্যাগ করলেও পদত্যাগ গৃহীত হওয়া সুযোগ ছিল না।

৪০তম কমিশন সভার কার্যপত্রে বলা ছিল, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ এর সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধনীর মাধ্যমে ধারা ১২(১)(সি) আরপিওতে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। ওই নির্বাচনে বাছাই ও আপিলে সিটি মেয়র, পৌরমেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের পদে থেকে মনোনয়নপত্র দাখিলকারীদের অযোগ্য করা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক রিট মামলা হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন আদেশ দেয়া হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কয়েকজন প্রার্থী উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যান পদে থেকে সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর আগের পদ থেকে তারা পদত্যাগ করেছিলেন।

ওই কার্যপত্রে, উপজেলা, জেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরমেয়রদের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত অফিস-প্রতিষ্ঠান বা করপোরেশন অথবা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা-কর্তৃপক্ষ এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী মিশনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জাতীয় সংসদের প্রার্থী হওয়ার কত দিন আগে পদত্যাগ করতে হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করার প্রস্তাব করা হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল