১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


সৃজনশীল পদ্ধতিতে উল্টো ফল

শিক্ষাব্যবস্থার পর্যালোচনা জরুরি

-

বর্তমান বিশ্বে যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যত বেশি বাস্তবসম্মত এবং যুগোপযোগী, সেই জাতি তত দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। আধুনিক বিশ্বে অন্যান্য দেশের সাথে অর্থনৈতিকসহ সব বিষয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে টেকসই শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষার মাধ্যমেই প্রতিটি দেশ জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তর করে থাকে। সেই লক্ষ্যে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে মুখস্থনির্ভর কারিকুলামে পরিবর্তন এনে ২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে।
দেশের শিক্ষা নিয়ে যারা ভাবেন, তারা আশা করেছিলেন, সৃজনশীলের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত দেশগুলোর মতো ধীরে ধীরে হলেও গুণগত মানে পৌঁছতে পারবে। আর পাবে শক্ত ভিত। অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতায় যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারবে। কিন্তু এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছা দূরের কথা, উল্টো শিক্ষার সূচক নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের মেধা শাণিত না হয়ে, আরো মুখস্থনির্ভর হয়ে গেছে। নিম্নমানের গাইড বইয়ের ওপর তাদের অধিকতর নির্ভরশীলতা এর প্রমাণ। সৃজনশীলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা বাড়ানো অন্যতম লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য পূরণ হওয়া দুরাশায় পরিণত হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলোÑ পদ্ধতিটি সম্পর্কে শিক্ষকদেরও স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। তারাও বাজারে প্রচলিত গাইড বইয়ের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। শিক্ষকদের সৃজনশীল পদ্ধতির ধারণা দিতে বিদেশী সংস্থার অনুদানে ও সরকারি অর্থে কয়েক দিনের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একধরনের দায়মুক্তি নিয়েছে। কিন্তু কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো এ জন্য অপচয় করা হয় বিপুল অর্থ।
নয়া দিগন্তে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদনে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষকের সূত্রে উল্লেখ করা হয়, সৃজনশীলতার নামে এখন যা চলছে, তা আসলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সৃজনশীলতা ধ্বংস করছে। সৃজনশীলতার নামে শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের বিভ্রান্তি আর হয়রানির মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, সৃজনশীলতার কারণে প্রায় সব শিক্ষকেরও এখন নিত্যসঙ্গী বাজারের গাইড। ২০১৬ সালের জেএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে বাংলা বিষয়ের সব সৃজনশীল প্রশ্ন হুবহু গাইড থেকে তুলে দেয়া হয়।
‘সৃজনশীল’ শব্দটি শুনতে খুব ভালো। কিন্তু সত্যিকারার্থে সৃজনশীল বলতে যা বোঝায় আর সৃজনশীলতার নামে যা চলছে তা এক নয়। অনেকেই এখনো এর কিছুই বোঝেন না। সৃজনশীলতার নামে শিক্ষাব্যবস্থায় একধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। শুরুতে সৃজনশীলতার নামে শিক্ষার্থীরা যা মনে চায়, তাই লিখত পরীক্ষার খাতায় এবং এ জন্য শিক্ষকদের নম্বর দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। এখন তা অনেকটা দূর হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যা রয়ে গেছে পাঠ্যবইসহ অনেক কিছুতে।
আমরা মনে করি, আগের শিক্ষাপদ্ধতিতে খারাপ যদি কিছু থাকে, তা ওই সময়ের পরীক্ষাপদ্ধতি। সে কারণে মুখস্থপ্রবণতার আধিক্য ছিল। এ প্রবণতা রোধ করা যেত পরীক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে। কিন্তু মুখস্থপ্রবণতা কমাতে গিয়ে সৃজনশীলতার নামে পাঠ্যবই যেভাবে বদলে ফেলা হয়েছে; তা নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় প্রশ্ন। আগের পাঠ্যবই ঠিক রেখেই শিক্ষাব্যবস্থাকে সৃজনশীল করা যেত পরীক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে।
নড়বড়ে শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে অন্যান্য দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা কঠিন। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষার ওপর যারা কাজ করেন; তাদের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে কথা বলে সৃজনশীল পদ্ধতির পরিবর্ধন, পরিমার্জন কিংবা পরিবর্তন করা প্রয়োজন কি না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশ সরকারের কাছে তুলে ধরবে কমিটি। এর আলোকে সৃজনশীল পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে। এটি যত শিগগির সম্ভব হবে, তত জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে বলে আমরা মনে করি।


আরো সংবাদ



premium cement