২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সন্তান জন্ম দিতে উটের পিঠে ৭ ঘণ্টা ছিলেন নারী

সন্তান জন্ম দিতে উটের পিঠে ৭ ঘণ্টা ছিলেন নারী। - ছবি : সংগৃহীত

মোনার যখন প্রসব যন্ত্রণা শুরু হলো, তখন তার জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায় হয়ে উঠলো একটি উট।

মোনা থাকেন উত্তর-পশ্চিম ইয়েমেনের এক পাথুরে পার্বত্য এলাকায়। সেখান থেকে তার সবচেয়ের কাছের হাসপাতালের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। এ পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে চার ঘণ্টা সময় লাগবে, এমনটাই ভেবেছিলেন ১৯ বছর বয়সী অন্তঃসত্ত্বা মোনা। কিন্তু ওই অঞ্চলে নেই কোনো রাস্তাঘাট। শেষ পর্যন্ত প্রসব বেদনা এবং পথে খারাপ আবহাওয়ার কারণে ওই পথ যেতে তার সময় লাগে সাত ঘণ্টা।

মোনা বলেন, ‘উটের পিঠে সওয়ার হয়ে প্রতিটি কদম আগানোর সময় আমি যন্ত্রণায় ভেঙ্গে পড়ছিলাম।’

যখন উটটি আর আগাতে পারছিল না, তখন তার পিঠ থেকে নেমে মোনা ও তার স্বামী বাকি পথ গেলেন পায়ে হেঁটে।

উত্তর-পশ্চিম ইয়েমেনের মাহুইত প্রদেশে বানি সাদ হাসপাতালটিই সেখানকার হাজার হাজার নারীর জন্য একমাত্র অবশিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। মোনা থাকেন যে গ্রামে, ওই আল-মাকারা থেকে হাসপাতালে যাওয়ার একমাত্র উপায় উটে চড়ে দুর্গম পাহাড়ি পথ বেয়ে বা পায়ে হেঁটে।

মোনা যখন উটের পিঠে চড়ে যাচ্ছিলেন, তখন নিজের ও গর্ভের সন্তানের কথা ভেবে বার বার তার মনে নানা আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছিল।

তিনি বলেন, ‘পথটা ছিল পাথুরে। এমন পথে যাওয়ার সময় শরীর আর মনের ওপর সাঙ্ঘাতিক ধকল যাচ্ছিল। সময় সময় আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম যেন তিনি আমাকে নিয়ে যান, যাতে এ যন্ত্রণা থেকে আমি রক্ষা পাই। তবে আমার সন্তানকে যেন তিনি রক্ষা করেন।’

হাসপাতালে শেষ পর্যন্ত কখন এসে পৌঁছালেন তা আর মোনার মনে নেই। তবে তিনি মনে করতে পারেন, ডাক্তার আর ধাত্রীদের হাতে যখন তার ভূমিষ্ঠ শিশু কেঁদে উঠল, তখন তার মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল।

মোনা ও তার স্বামী শিশুটির নাম রেখেছেন জারাহ, যে চিকিৎসকের হাতে তার জন্ম হয়েছে ওই চিকিৎসকের নামে।

নিকটবর্তী গ্রামগুলো থেকে যেসব পথ ধরে ওই হাসপাতালে যেতে হয়, সেগুলো খুবই সঙ্কীর্ণ।

ইয়েমেনে গত আট বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের ফলে কিছু কিছু রাস্তা একদম ভেঙ্গে-চুরে গেছে, কোথাও কোথাও পথ অবরুদ্ধ। ইয়েমেনের এ যুদ্ধের এক পক্ষে আছে সৌদি জোটের সমর্থন পাওয়া সরকার-পন্থী বাহিনী, অন্য পক্ষে আছে ইরানের মদত পাওয়া হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী।

পাহাড়ি পথ বেয়ে গর্ভবতী নারীদের হাসপাতালে নিতে সময় লাগে অনেক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওই পথ পাড়ি দেয়ার সময় তাদের সাথে থাকে স্বামী বা পরিবারের সদস্যরা।

এক গর্ভবতী নারীকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য সাথে যাচ্ছিলেন সালমা আবদু (৩৩)। তিনি জানালেন, পথে এক গর্ভবতী নারীকে হাসপাতালে নেয়ার সময় তিনি মারা যেতে দেখেছেন।

সালমা মানুষের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন, যেন তারা নারী ও শিশুদের কথা ভেবে অন্তত দয়া করে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের রাস্তা দরকার, হাসপাতাল দরকার, ওষুধখানা দরকার। আমরা এ উপত্যকার মধ্যে আটকা পড়ে আছি। যারা সৌভাগ্যবান, তারা তো নিরাপদে সন্তান জন্ম দিতে পারছে। কিন্তু অন্যরা মারা যাচ্ছে, তাদের এ পথের যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে।’

কিছু পরিবারের হয়ত হাসপাতালের খরচ দেয়ার মতো সামর্থ্য আছে, কিন্তু সেখানে পর্যন্ত পৌঁছানোর সামর্থ্য তাদের নেই।

ইয়েমেনে প্রতি দু’ঘণ্টায় একজন নারী সন্তান জন্ম দেয়ার সময় মারা যায়।

জাতিসঙ্ঘের জনসংখ্যা কর্মসূচির হিচাম নাহরো বলেছেন, এই মৃত্যু প্রতিরোধ-যোগ্য।

হিচাম নাহরো বলেন, ইয়েমেনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর সুযোগ পায় না। তীব্র যন্ত্রণা বা রক্তপাত শুরু না হওয়া পর্যন্ত তারা চিকিৎসকের সাহায্যও চায় না।

জাতিসঙ্ঘ জনসংখ্যা তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, ইয়েমেনে যখন নারীরা সন্তান জন্ম দেয়, তখন তাদের অর্ধেকেরও কম দক্ষ চিকিৎসকের সাহায্য পায়। মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ সন্তান জন্ম দেয় কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। ইয়েমেনের পাঁচ ভাগের দুই ভাগ মানুষ তাদের নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতাল থেকে এক ঘণ্টারও বেশি দূরত্বে থাকে।

গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইয়েমেনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার করুণ দশা ছিল। কিন্তু যুদ্ধের ফলে হাসপাতাল ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে মানুষের যাতায়াতের কষ্ট অনেক বেড়েছে।

হাসপাতালগুলোতে দক্ষ-কর্মীর অভাব আছে, অভাব আছে যন্ত্রপাতি ও ওষুধের। রাস্তাঘাট ও এমন অবকাঠামোর জন্য বিনিয়োগ একদম বন্ধ হয়ে গেছে।

জাতিসঙ্ঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) জানিয়েছে, যেসব স্বাস্থ্য-সেবা ব্যবস্থা এখনো টিকে আছে, তার প্রতি পাঁচটির একটিতেই কেবল নির্ভরযোগ্য মাতৃ ও শিশু যত্নের সেবা পাওয়া যায়।

‘আমার মনে হয়েছিল এটাই শেষ’
ইয়েমেনে সন্তান-সম্ভবা মায়েরা যেসব দুর্ভোগের শিকার হয়, মোনার গল্প তার একটি মাত্র। ইয়েমেনে একটি গাড়ির মালিক হওয়া বেশিরভাগ মানুষের সাধ্যের বাইরে। দেশটির ৮০ ভাগ মানুষ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।

হাইলার স্বামী কাজ করতেন সৌদি আরবে। সেখানে যে সামান্য অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন, তা তিনি ব্যয় করেছিলেন তার স্ত্রীকে একটি ধার করা মোটরসাইকেলে বসিয়ে নিকটবর্তী হাসপাতালে নেয়ার খরচ জোগাতে।

হাইলার যখন প্রসব বেদনার পর পানি ভাঙ্গল, তখন তার দেবর তাকে মোটরবাইকের পেছনে বসিয়ে নিজের সাথে বেঁধে হাসপাতালে রওনা হলেন, যাতে তিনি পড়ে না যান।

যখন তারা ধামারের হাদাকা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছালেন, হাইলাকে দ্রুত সার্জারি ওয়ার্ডে নেয়া হলো।

৩০ বছর বয়সী হাইলা বলেন, ‘আমার তো মনে হচ্ছিল আমার সব শেষ। আমি বা আমার পেটের সন্তানকে বাঁচানোর কোনো উপায় আছে বলে আর মনে হচ্ছিল না।’

গর্ভাবস্থার শুরুতেই হাইলা এমন সতর্কবাণী শুনেছিলেন যে বাড়িতে সন্তান জন্ম দেয়া তার জন্য নিরাপদ হবে না, গর্ভকালীন নানা জটিলতা ও রক্তপাতের ঝুঁকির কারণে।

স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার বললেন, হাইলা ও তার শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল একেবারে শেষ মুহূর্তে।

হাইলা তার শিশুর নাম রেখেছেন আমাল, আরবিতে যার অর্থ ‘আশা’।

হাইলা বলেন, ‘এই অভিশপ্ত যুদ্ধের কারণে আমি তো প্রায় মরতে বসেছিলাম, আমার সন্তানকেও হারাতে চলেছিলাম। কিন্তু আমার সন্তান এখন আমাকে নতুন আশা দিয়েছে।’

ইয়েমেনে আন্তর্জাতিক সাহায্যে কমে এসেছে। ফলে বানি সাদ হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর্থিক চাপের মধ্যে আছে। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীরা মা ও শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ কাকে বাদ দিয়ে কার জীবন বাঁচানোর চিকিৎসা তারা করবেন, তা ভাবতে হচ্ছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
সাজেকে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ শ্রমিক নিহতের খবরে ঈশ্বরগঞ্জে শোক দুর্যোগে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু কেন বাংলাদেশে? জবিতে ভর্তি পরীক্ষায় আসন বেড়েছে ৫০টি বিএনপি ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : ওবায়দুল কাদের মাটির নিচে পাওয়া গ্রেনেড মাইন মর্টার শেল নিষ্ক্রিয় করল সেনাবাহিনী অনির্দিষ্টকালের জন্য অনলাইন ক্লাসে যাচ্ছে জবি, বন্ধ থাকবে পরীক্ষা কুড়িগ্রামে রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ ক্রিকেট খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে দেওয়ানগঞ্জের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শিহাব কিশোরগঞ্জে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ সাতক্ষীরা বৈদ্যুতিক খুটিতে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলআরোহী নিহত বার্সেলোনাতেই থাকছেন জাভি

সকল